পরিবহণ খাতের নৈরাজ্য বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জনবহুল ও ক্ষুদ্রায়তনের বাংলাদেশ নানামুখী আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত। বিগত সরকারের আমলে পরিবহণ খাতে চাঁদাবাজি চরমে উঠেছিল। জনশ্রুতিমতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যোগসাজশে নষ্ট চরিত্রের কথিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব এসব অপকর্মের জন্য দায়ী ছিল। ছাত্র-জনতার সার্থক গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী পর্যায়ে প্রত্যাশিত ছিল, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবনযাত্রায় স্বস্তি ফিরে আসবে। একই সঙ্গে জীবনমান সুরক্ষায় বাজারব্যবস্থার সুফলও ভোগ করা যাবে।
দুর্ভাগ্যবশত সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা প্রভৃতির কারণে ধান-শাকসবজির উৎপাদন অনেকটাই ব্যাহত হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঊর্ধ্বমুখী পরিবহণ ভাড়া। তুলনামূলকভাবে চাঁদাবাজি কিছুটা কম দৃশ্যমান হলেও এখনো তা সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান বলেই দেশবাসীর ধারণা। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে বাস পরিষেবার ক্ষেত্রে এবং টার্মিনালগুলোয় নতুন দখলদারদের আবির্ভাব ঘটেছে। পরিবহণ খাতসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সরকার পতনের পর তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের জায়গায় এখন এ খাতের নিয়ন্ত্রণ নিতে তৎপর হয়ে উঠেছেন অন্য দলের নেতাকর্মীরা। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পরপরই পরিবহণ খাতে শুরু হয়েছে দখলের লড়াই। রাতারাতি পালটাপালটি দখলের মতো ঘটনাও ঘটেছে। ইতোমধ্যে রাজধানীসহ ঢাকার বাইরের প্রায় সব টার্মিনাল পুনঃদখল হয়েছে। বিগত ১৫ বছর যারা টার্মিনালের বাইরে ছিল, তারাই হঠাৎ টার্মিনালগুলো করায়ত্ত করে নেয়। গণমাধ্যম সূত্রমতে, ১৪ আগস্ট বাস মালিকদের নতুন ৩১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বিগত আমলের পরিবহণ মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের সব পর্যায়ের নেতা পলাতক রয়েছে। রাজধানী ঢাকার পাঁচ শতাধিক পরিবহণ কোম্পানির পরিচালনায় গঠন করা মালিক সমিতির বেশির ভাগ এরই মধ্যে বদলে ফেলা হয়েছে। শুধু ঢাকা নয়, দেশজুড়ে বিভাগ-জেলা-উপজেলা পর্যায়েও ঢেলে সাজানো হচ্ছে পরিবহণের নেতৃত্ব। দ্রুততর সময়ের মধ্যে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার তোড়জোড় অব্যাহত রয়েছে। পরিবহণ শ্রমিক ও চালকদের দাবি, চরম নৈরাজ্যের অবসান এবং সার্বিক পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও চাঁদাবাজি রোধ করা যাচ্ছে না। নতুন নেতৃত্বের বিরুদ্ধেও চাঁদা আদায়ের অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। ৫ মার্চ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে চাঁদাবাজি হয় ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা। এ চাঁদার ভাগ পান দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী, মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা।
বিআরটিএ-এর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত বাণিজ্যিক যানবাহনের সংখ্যা ৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৫৩। এসব যানবাহন থেকে দৈনিক একবার করে ৫০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হলেও এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ কোটি ২৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬৫০ টাকা। এ হিসাবে প্রণয়নকৃত নির্দেশিকার আলোকে ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত শুধু বিআরটিএ-এর নিবন্ধিত বাণিজ্যিক যানবাহন থেকে ৬ হাজার ৯৪ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার ৬৫০ টাকা চাঁদা তোলা হয়েছে। একই চিত্র দেখা যায় পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পণ্য পরিবহণে চাঁদাবাজির কারণে ভাড়া বৃদ্ধি পেয়ে পণ্যের দাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। বিশেষ করে পচনশীল দ্রব্যের ওপর চাঁদাবাজদের নজর বেশি। কারণ, ওই পণ্য আটকে রাখলে ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়েন। তাছাড়াও ওজন স্কেলের নামেও হয় চাঁদাবাজি। হাইওয়েতে ট্রাক আটকে সার্চ করার নামে চাঁদাবাজির দৃষ্টান্তও কম নয়। পৌরসভা এলাকা পার হওয়ার সময়ও পণ্যবাহী ট্রাককে দিতে হয় চাঁদা। ব্যবসায়ীদের সরেজমিন তদন্তে প্রতিফলিত যে, শাকসবজিসহ কাঁচামালের ট্রাকই চাঁদাবাজির শিকার হয় বেশি।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব সংবাদমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে জানান, পরিবহণ খাতে এ চাঁদাবাজি টিকিয়ে রাখার জন্য শাসক দলকে দরকার হয়। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবহণ খাতও অন্যদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। চাঁদাবাজির জন্যই এটি হয়ে থাকে। বাংলাদেশের পরিবহণ ভাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়ে অনেক বেশি। সেবার মান অনেক খারাপ। পাবলিক যানবাহনও নিুমানের। এর কারণ চাঁদাবাজি। চাঁদাবাজির কারণে ভাড়া যেমন বেশি, তেমনই নিত্যপণ্যের দামও বেড়ে যায়। তিনি আরও বলেন, ‘টিআইবি পরিবহণ খাতের চাঁদাবাজির যে হিসাব দিয়েছে, তা আংশিক। তারা শুধু বাস-মিনিবাসের কথা উল্লেখ করেছে। কিন্তু সড়কে সাত-আট ধরনের যানবাহন আছে। আমার হিসাবে এ খাতে বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়।’
পরিবহণ খাতে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা,ভাড়ানৈরাজ্য, মানসম্মত গণপরিবহণ না নামানো, অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিল পতিত সরকার। ফলে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬০ হাজার ৯৮০টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ১ লাখ ৫ হাজার ৩৩৮ জন এবং আহত ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮৪৭ জন। সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়, এর হার ৩৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৭ হাজার ১৫০ জন পথচারী। চালকের সংখ্যা ১৪ হাজার ৯২৮। এ সময়ে আঞ্চলিক মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং জাতীয় মহাসড়কে ৩১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসাবে নিষিদ্ধ-ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চলাচল এবং যানবাহনের বেপরোয়া গতি চিহ্নিত। হাইওয়ে পুলিশের সূত্রমতে, মহাসড়কে পরিবহণসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ১৮ হাজার ৬৩৭টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে নিষিদ্ধ ও ঝুঁকিপূর্ণ যানের বিরুদ্ধে ৪৪ হাজার ৯৭৫টি এবং বেপরোয়া গতির কারণে ৩৪ হাজার ১০৯টি; যা মোট মামলার ৬৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ২০২৩ সালে ২ লাখ ৯০৭টি মামলার মধ্যে নিষিদ্ধ ও ঝুঁকিপূর্ণ যানের বিরুদ্ধে ছিল ৭১ হাজার ৩৭১টি এবং বেপরোয়া গতির কারণে ছিল ৫১ হাজার ১৬৮টি মামলা। আইন অনুযায়ী, মহাসড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার; কিন্তু মানছে না অনেক চালক। বিশেষ করে ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাসের চালকরা। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে তিন চাকার যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হলেও সবই চলছে অবাধে। ৫ আগস্টের পর এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে পরিবহণ খাতের গুরুত্বপূর্ণ সেবা সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) বিরুদ্ধে। টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে গাড়ির নিবন্ধন ও ফিটনেস সনদ হালনাগাদ এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে বিআরটিএতে ঘুস নেওয়ার বিষয়ও উঠে আসে। ২৭ অক্টোবর ২০২৪ সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, টাকা জমা ও পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরও বিআরটিএ ভবনে আটকে আছে ৬ লাখের বেশি প্রার্থীর ড্রাইভিং লাইসেন্স। লাইসেন্স না পেয়ে নানামুখী ভোগান্তিতে নিপতিত গ্রাহকরা। যার ভিত্তিমূল ছিল বিগত সরকারের শাসনামল। তখন পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেওয়ার চেষ্টার কারণে এই জটিলতা তৈরি হয়। কিন্তু বর্তমান সরকার ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্মার্টকার্ড ব্যবস্থাই তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার বদলে দেওয়া হবে সাধারণ মানের প্লাস্টিকের পলিভিনাইল ক্লোরাইডের (পিভিসি)কার্ড। শান্তিতে নোবেলজয়ী বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্ব মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে গঠিত বিভিন্ন কমিশনের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। পরিবহণ খাতে নৈরাজ্য দূরীকরণসহ সামগ্রিক ব্যবস্থাকে জঞ্জালমুক্ত করতে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ও গণসচেতনতার প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী