যেভাবে সবুজ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম
প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বৃক্ষই মানুষের প্রাণ। যদিও বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বনভূমির পরিমাণ কম। পরিবেশবিদদের মতে, পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশে প্রায় ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা উচিত। কিন্তু আছে মাত্র ১৭ শতাংশ। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির মাধ্যমে বনভূমির পরিমাণ বাড়ানোর বিকল্প নেই। বৃক্ষ বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউজ গ্যাস কমিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন ও মাটির ক্ষয় রোধেও সহায়তা করে থাকে। মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের সংস্থান, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন ধরনের পাখির আশ্রয়স্থল হিসাবেও বৃক্ষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। একটি গাছ বছরে প্রায় ১০ থেকে ৪০ কেজি কার্বন-ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডল থেকে শোষণ করতে সক্ষম। যদি প্রতিটি গাছ বছরে গড়ে ২৫ কেজি কার্বন-ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডল থেকে শোষণ করে, তাহলে দেশে বছরে ৬৪ হাজার গাছ লাগানো হলে ভবিষ্যতে তারা প্রায় ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডল থেকে শোষণ করবে। নিঃসন্দেহে এটি হতে পারে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তথা বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক পরিবেশ গঠনের একটি বাস্তবমুখী পদক্ষেপ।
সবুজায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন একে অপরের পরিপূরক। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হলে শুধু বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের বিদ্যমান পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এ জলাশয়, মাটি, পানি, বায়ু ও শব্দদূষণের প্রভাব থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং আইনের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে। এ আইনে সংকটাপন্ন ইকোসিস্টেম এলাকাকে ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়ায় বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশের সংরক্ষণ সম্ভব। ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এলাকা ছাড়াও অকৃষি জায়গা, বাড়ির ছাদ, রাস্তা ও জলাশয়ের পাশে বৃক্ষরোপণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
জৈব ও অজৈব উপাদানের সমন্বয়েই ইকোসিস্টেম গঠিত। জৈব উপাদান বলতে গাছপালা, পাখি, ফান্জাই, ব্যাকটেরিয়া, জলজ উদ্ভিদ ও অন্যান্য জীবন্ত অর্গানিজমকে বোঝানো হয়েছে। অন্যদিকে ইকোসিস্টেমে অজৈব উপাদান হিসাবে মাটি, পানি, বায়ু, তাপমাত্রা ও অন্যসব অজৈব বস্তুকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব জৈব ও অজৈব উপাদানের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ায় পরিবেশের ভারসাম্য সংরক্ষিত হয়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য পরিবেশে বিদ্যমান সব উপাদানকে দূষণ থেকে রক্ষার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। এ কর্মসূচিতে বায়ুতে গ্রিন হাউজ গ্যাস, কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার-ডাই অক্সাইড, পার্টিকুলেট ম্যাটার ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের নির্গমন কমানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, এসব বায়ুদূষক শিল্পকারখানা, ইটখোলা ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন থেকে প্রতিনিয়ত বায়ুমণ্ডলে নির্গত হচ্ছে। বায়ুদূষণ কমানোর জন্য ব্যাপকভাবে জনসচেতনতা গড়ে তোলা উচিত। এ লক্ষ্যে শহর ও শিল্প এলাকায় বায়ুতে বিদ্যমান অনাকাঙ্ক্ষিত উপাদানের উপস্থিতি প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করা যেতে পারে। পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে একটি সুস্পষ্ট গাইডলাইন তৈরি করা উচিত, যা ভবিষ্যতে সরকারের নীতিনির্ধারণীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে। তাছাড়া সচেতনতার পাশাপাশি বাস্তবমুখী গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়েও পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে মাটি ও শব্দদূষণ রোধেও ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। উল্লেখ্য, রাসায়নিক বর্জ্য, কৃষিতে সুপারিশবিহীন সার ও বালাইনাশক প্রয়োগে মাটিদূষণ বাড়ছে। তাই পচনশীল জৈব পদার্থ ও সুপারিশকৃত বালাইনাশক মাটিতে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এতে দূষণ কমে মাটির উর্বরতা বাড়বে, যা সবুজ বাংলাদেশ গঠনে সহায়ক হবে। অন্যদিকে গাড়ি ও কলকারখানা থেকে উৎপাদিত শব্দ ৫০ ডেসিবলের নিচে রাখার বিষয়ে সুপারিশ থাকা উচিত, যা মানুষকে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে সহায়তা করবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের বাস্তব প্রয়োগের ওপর জোর দেওয়া উচিত।
দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হতে যাচ্ছে। যদিও পরিবেশবিদরা পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়ে কিছু ঝুঁকির কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বিপুল জনসংখ্যার দেশে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিকল্প নেই। তবে সেটি পরিবেশ সংরক্ষণকে গুরুত্ব দিয়েই অব্যাহত রাখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো ইউরেনিয়ামসংশ্লিষ্ট তেজস্ক্রিয় বর্জ্যরে উৎপাদন। যদি ইউরেনিয়ামযুক্ত তেজস্ক্রিয় পদার্থ পরিবেশে যোগ হয়, তাহলে মাটি, পানি ও বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যাবে, যা সবুজ বাংলাদেশ গঠনের অন্তরায় হতে পারে। এক্ষেত্রে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
সবুজ বাংলাদেশ গঠনে বর্জ্য ব্যবস্থাপনারও সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকা উচিত। বর্জ্য সমস্যা হলেও এটিকে সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে বর্জ্যরে চরিত্রগত বিশ্লেষণ শেষে ফোর-আর (৪-জ) সিস্টেমে বর্জ্যগুলোর ব্যবস্থাপনা করা যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, সমগ্র বিশ্বে বছরে প্রায় ৫৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এ উৎপাদিত বর্জ্যরে মাত্র ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ রিসাইক্যাল হয়। তাছাড়া বর্জ্যগুলোকে রিডিউস, রিইউজ, রিসাইক্যাল ও রিকভারির মাধ্যমে সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে একটি দেশকে জিরো বর্জ্যে পরিণত করাও সম্ভব। ফলে ওই বর্জ্য থেকে উৎপাদিত জৈব সার গাছপালার পুষ্টি উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে, যা সবুজ বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারবে।
প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাতীয় দ্রব্যসামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এ ধরনের উপাদান নন বায়োডিগ্রেডেবল হওয়ায় পরিবেশে দীর্ঘদিন থেকে যেতে পারে। এতে পরিবেশের ক্ষতি ও মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে থাকে। সূর্যের আলট্রাভায়োলেট রে-এর প্রভাবে প্লাস্টিক থেকে প্রতিনিয়ত মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবেশে নির্গত হচ্ছে। এ মাইক্রোপ্লাস্টিকে বিসফেনল ও ফালেট্স রয়েছে, যা মানুষের এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের জন্য মারাÍক ক্ষতিকর। অন্যদিকে প্লাস্টিকজাতীয় উপাদান থেকে নির্গত ক্ষতিকর উপাদান হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস ও ক্যানসারের সৃষ্টি করে থাকে। প্লাস্টিকজাতীয় উপাদানে বিদ্যমান ক্ষতিকর পদার্থ মাটির উর্বরতা নষ্ট করে, যা সবুজ বাংলাদেশ গঠনের অন্তরায়। তাই প্লাস্টিকের পরিবর্তে সরকারের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী পরিবেশবান্ধব উপাদানের মাধ্যমে ব্যাগ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী তৈরি করা উচিত। এতে পরিবেশ-সহনশীল সবুজ বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব বলে আশা করা যায়। সেক্ষেত্রে বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক তৈরির ওপর জোর দেওয়া উচিত। এ ধরনের প্লাস্টিক সাধারণত পুনরায় ব্যবহারযোগ্য কাঁচামাল, মাইক্রোব্স ও পেট্রোকেমিক্যালের সমন্বয়ে তৈরি করা যেতে পারে। এ ধরনের প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাতীয় উপাদান মাইক্রোব্সের ক্রিয়ায় অতি সহজেই মাটিতে পচনশীল হবে। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, প্লাস্টিকজাতীয় পদার্থ পরিবেশে প্রায় ৪৫০ বছর পর্যন্ত থেকে যেতে পারে।
আগামী ১০০ বছরে বাংলাদেশ কোথায় পৌঁছবে, এ বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। এ লক্ষ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার মাধ্যমে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে ৮২ বছরের জন্য গৃহীত ডেল্টা প্ল্যানে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এ ডেল্টা প্ল্যানে উপকূলীয় ১৯টি, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চলে ১৮টি, হাওড়ে ৭টি, পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩টি, নদী এলাকায় ২৯টি, নগর এলাকায় ৭টি এবং কম দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় ৬টিসহ মোট ৮৯টি এলাকাকে ‘জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলার জন্য জলবায়ু সহনশীল পরিবেশ গঠন করা যেতে পারে। ডেল্টা প্ল্যান কর্তৃক চিহ্নিত হটস্পটগুলো ছাড়াও অন্যসব এলাকায় বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে সবুজ বাংলাদেশ গঠনের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
ইতোমধ্যে সরকার কর্তৃক পরিবেশের উন্নয়নে ডেল্টা প্ল্যান, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড, এনডিসি বাস্তবায়নে রোডম্যাপ, জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পলিসি এবং বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যানসহ আরও বহু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে এ পরিকল্পনাগুলো পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। তাছাড়া জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলন ‘কনফারেন্স অব পার্টিজে’ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলিসিয়াসের নিচে রাখা এবং উন্নত দেশ কর্তৃক উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বছরে কমপক্ষে ১০০ কোটি ডলার বরাদ্দের বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে।
পরিশেষে, ‘সবুজ বাংলাদেশই’ জলবায়ু সহনশীল পরিবেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। এ লক্ষ্যে প্রতিটি জেলায় যদি ৫০০০ বৃক্ষরোপণ করা হয়, তাহলে সমগ্র বাংলাদেশে ৩ লাখ ২০ হাজার গাছের চারা প্রাকৃতিক পরিবেশে যোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে বায়ুমণ্ডল থেকে প্রায় ৮ হাজার টন কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষিত হবে, যা ভবিষ্যতে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। তাছাড়া সবুজ বাংলাদেশ গঠনে পানি, বায়ু, শব্দদূষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব, পরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ গঠনে গবেষণা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি অব্যাহত রাখা উচিত। গৃহীত কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ জলবায়ু-সহনশীল রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার বিষয়টি নাকচ করে দেওয়া যায় না।
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম : অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
mohammad.alam@wsu.edu