ফিরিয়ে দাও আমার খেজুর, শঙ্খ আর পদ্ম
নাভিদ সালেহ
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। একদল এতে মহাপ্রলয়ের ডঙ্কাধ্বনি শুনতে পায়; আর অন্যদল একে দাঁড় করায় উন্নয়নের প্রতিপক্ষ হিসাবে। একদল প্রতিটি গ্রীষ্মের অসহনীয় তাপদাহকে, প্রতিটি কালবৈশাখীকে, প্রতিটি বন্যাকে ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলাফল’ লেবেল দিতে বিলম্ব করে না; আর অন্যদল বৈজ্ঞানিক উপাত্তের ভিড়ে খুঁজে বেড়ায় অসঙ্গতির ইঙ্গিত, যাতে উষ্ণায়নের পুরো ধারণাটাকেই ভ্রান্ত, মনগড়া বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়। বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ উষ্ণায়নকে উন্নয়নের রাজপথে ‘বামঘেঁষা-ব্যারিকেড’ বলে নাকচ করে দিতে চান। ইতিহাসবিদদের অনেকেই ভূতাত্ত্বিক সময়ের ব্যাপ্তিকে সামনে রেখে নৃতাত্ত্বিক সময়সীমার ক্ষণস্থায়িত্বকে যুক্তি হিসাবে দেখান। তারা বলার চেষ্টা করেন, কোটি কোটি বছর ধরে বেঁচে থাকা ধরিত্রীর বিবর্তনে কয়েকশ বছরের পুরোনো শিল্পবিপ্লব ও তার সৃষ্ট প্রভাব নগণ্য। আর তাত্ত্বিক তর্কের ভিড়ে এসে জুড়ে পরিসংখ্যানের সংখ্যাগত জটিলতা। তথ্য, তত্ত্ব আর সংখ্যার ধূম্রজালে জলবায়ু পরিবর্তনকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে যে, এর প্রকৃত চিত্র সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলাই যাচ্ছে না। প্রাকৃতিক এ বিপর্যয়কে ঠেকাতে জনমত তৈরি করা তাই প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। নিবন্ধটি এ অসম্ভবকে সম্ভব করার দিকে এক ধাপ এগোনোর প্রচেষ্টা নিয়েই। প্রথমেই বাঙালির আটপৌঢ়ে জীবনের অনুষঙ্গের অবতারণার মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আলোচনায় থাকছে, যা বিষয়টিকে খানিকটা সহজবোধ্য, খানিকটা মানবিক করে তুলবে। আর তা সম্ভব হলেই শুধু অবতারণা করা যাবে উষ্ণায়নের দার্শনিক বিতর্কের; উপস্থাপন করা যাবে চিন্তার সমসত্ত্বতার আলোচনা।
সাধারণ বাঙালি জীবনের কেন্দ্রে বাস করে বিশ্বাস। ধর্ম বা আচারের ওপর বিশ্বাস। বিশ্বাসকে ঘিরে তাই দরকার হয়ে পড়ে নানা উপঢৌকন। বাঙালি মুসলমানদের রমজানের ইফতারে জরুরি হয়ে পড়ে খেজুর। বাঙালি হিন্দুর শারদীয় উৎসবে আর কালীপূজার সময় ভাইফোঁটার আশীর্বাদকালে শঙ্খ না হলে চলে না। শঙ্খে ঢেলে দেওয়া ফুঁক যেন সৃষ্টির নাদ, মানবের সঙ্গে স্রষ্টার সৃষ্টি সম্পর্ককে সুদৃঢ় করা। একইভাবে, তথাগত বুদ্ধের বাঙালি-শিষ্যেরা পদ্মের ভেতর খুঁজে পায় সত্য ও নির্বাণের শক্তি। পদ্ম প্রস্ফুটন থেকে এর বিকাশের স্তরগুলো যেন ধারণ করে জ্ঞানলাভ থেকে মোক্ষ অর্জন পর্যন্ত পরিক্রমার ইতিহাস। বাঙালি মুসলমান, হিন্দু আর বৌদ্ধদের আধ্যাত্মিক জীবনের অপরিহার্য এ অনুষঙ্গগুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে-এ সত্য যদি জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতায় দাঁড় করানো যায়, তাহলে জনমত গড়তে তেমন কসরত করতে হবে বলে মনে হয় না।
জামে আত-তিরমিজির এক হাদিসে বলা হয়েছে, খেজুর দিয়ে রোজা ভাঙা সুন্নত। যদি খেজুর না থাকে, তবে শুষ্ক খেজুর দিয়ে রোজা ভাঙা যেতে পারে। আর যদি তা-ও না থাকে, তবে পানি পান করে রোজা ভঙ্গের কথা বলা হয়েছে। আগামী দুই দশকের ভেতর এ খেজুর উৎপাদন ব্যাহত হবে চরমভাবে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ খেজুর উৎপাদক মিসরের তাপমাত্রা এ সময়ের ভেতর ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে আর বৃষ্টিপাত কমবে ১০ মিলিমিটারেরও বেশি। খেজুর মরুভূমির ফল হলেও তাপদাহ ও বৃষ্টিপাত-হ্রাস এ ফলের উৎপাদন ব্যাহত করে। ২০২১ সালে পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত একটি গবেষণা নিবন্ধ বলছে, ক্লাইম্যাক্স মডেল অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে খেজুর উৎপাদন হ্রাস পাবে প্রায় ১০ শতাংশ। আর এ শতাব্দীর শেষে এক-তৃতীয়াংশ কমে যাবে এর ফলন। ধনী মুসলমানের ওপর হয়তো এর প্রভাব নগণ্য, তবে মধ্যবিত্ত আর প্রান্তিক রোজদারের ইফতারে খেজুরের প্রাপ্যতা কমতে শুরু করবে।
একইভাবে, শঙ্খের জন্ম ও বৃদ্ধি রোহিত হচ্ছে সাগরের তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাদের অর্চনায় যে শাঁখ ব্যবহার করেন, তা ‘টারবিনেলা পাইরাম’ প্রজাতির শঙ্খ। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রবাল প্রাচীর (কোরাল রিফ) থেকে মূলত এ শঙ্খ সংগৃহীত হয়ে থাকে। তামিলনাড়ু প্রদেশের পূর্বে এবং ভারত-শ্রীলংকার মধ্যবর্তী রামসেতুর কাছাকাছি অঞ্চলে অবস্থিত মানার উপসাগর। এর প্রবাল প্রাচীরই ভারতবর্ষে শঙ্খ সংগ্রহের প্রধান গন্তব্য। সাগরের তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবাল প্রাচীর কোরাল-ব্লিচিংয়ের মধ্য দিয়ে প্রাণহীন হয়ে পড়তে থাকে আর এর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে থাকে প্রবালকে ঘিরে গড়ে ওঠা বাস্তুসংস্থান, আর এর ওপর নির্ভরশীল জীব, যেমন শঙ্খ। ১৯৯৭-৯৮ সালের এলনিনো-যা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শতবর্ষের তীব্রতম সংঘটন বলে ধরা হয়-মানার উপসাগরের প্রবাল প্রাচীরের ব্যাপক ক্ষতি করে। গড় তাপমাত্রা থেকে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে যেখানে প্রবাল প্রাচীর ব্লিচ করতে শুরু করে, সেখানে ১৯৯৮-এর এলনিনোও সাগরের উষ্ণতা প্রায় ২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলাফল প্রবাল প্রাচীরের বিনষ্টি। সেই থেকে শুরু। ভারতবর্ষের প্রবাল প্রাচীর হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে শুরু করে শঙ্খের আবাসস্থল। হিন্দু রীতির চর্চা আর শাঁখারিদের জীবন-নিনাদ এই ‘অনাদি শঙ্খ’কে ভবিষ্যতের রীতি অনুসারীদের জন্য যদি রেখে যেতে চাই, তাহলে উষ্ণায়ন নিয়ে বিচলিত হওয়ার প্রয়োজন আছে।
জলপদ্মের ভাগ্যও অনেকটা একইরকম। ভূতাত্ত্বিক সময়ের বিচারে বরফ যুগে ইউরোপ আর মধ্য এশিয়া থেকে পদ্ম হারিয়ে গেছে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যার তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পদ্ম বা ‘নেলুম্ব নুসিফেরা’ বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেও। ২০১৪ সালে মালয়েশিয়ার একটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ এমনটিই বলেছে। আইপিসিসির মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রায় ৪০ শতাংশ উপমহাদেশীয় জলাভূমি বন্যার জলে কিংবা খরার তীব্রতায় অচিরেই বিনষ্ট হবে; আর এর সঙ্গে সঙ্গে আমরা হারাব পদ্মের ফলন। বুদ্ধপূর্ণিমায় নৈবদ্যের থালায়, কিংবা পদ্মপূজায় ব্যবহার্য পদ্ম জোগাড় করতে হাঁপিয়ে উঠতে হবে হয়তো অচিরেই। তথাগতের জন্য পদ্মের প্রাপ্তির জন্য হলেও আমাদের উষ্ণায়ন নিয়ে ভাবা দরকার।
মানুষ যে ধর্মই অনুসরণ করুক না কেন, তাদের আবাসভূম একটিই-এই ধরিত্রী। আর তার এ আবাসস্থলে সহাবস্থান করে প্রকৃতি। মানববলয় ও প্রাকৃতিক বলয়ের মিথস্ক্রিয়া নিয়ে চিন্তাগত আলোচনার দরকার আছে। প্রখ্যাত ব্রাজিলীয় নৃতাত্ত্বিক এডুয়ার্ডো ভিভেইরস ডি ক্যাস্ট্রো তার ‘দ্য এন্ডস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ গ্রন্থে আধুনিক সমাজের প্রকৃতি-বিচ্ছিন্নতার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলছেন, এ ধরণিকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি শুধু মানুষের একার দখলে নয়। প্রাণী ও উদ্ভিদকূলেরও জগৎকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। আর যখনই মানুষ নিজেকে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে স্থাপন করে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ ও তাকে ব্যবহার করায় লিপ্ত হয়, তার সম্পদ নিঙড়ে ‘সভ্যতা’ গড়ার সংকল্প করে, তখনই ধরিত্রীকে উপেক্ষা করে উন্নয়ন, পৃথিবীকে অবজ্ঞা করে সভ্যতা। আর এমন চিন্তার সমসত্ত্বতার ফলাফল শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী উষ্ণ পৃথিবী। প্রখ্যাত দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী তার ‘ওয়ান প্ল্যানেট মেনি ওয়ার্ল্ডস’ গ্রন্থে ডি ক্যাস্ট্রোর চিন্তার সম্প্রসারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি পৃথিবীকে অবিচ্ছিন্ন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, তবে এ সংকটের মোকাবিলায় স্থানীয় জগৎ ও সেগুলোর বাস্তবতাকে মাথায় রাখতে হবে। যেমন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র ফিজি, ভানুয়াতু আর বঙ্গোপসাগর-উপকূলবর্তী বাংলাদেশ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিকে যেভাবে নেবে-নেপাল, ভুটান কিংবা আফগানিস্তানকে তা নিয়ে তেমন বিচলিত না হলেও চলবে। তবে নেপালে হিমবাহের গলন থেকে বন্যা, ভুটানে অতিবৃষ্টি থেকে ভূমিধস আর আফগানিস্তানে পানির স্বল্পতা ও খরার ঝুঁকি নিয়ে যে নিনাদ শোনা যাবে-ফিজি, ভানুয়াতু কিংবা বাংলাদেশে হয়তো ততটা শোরগোল হবে না। তদুপরি একটি দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বৈষম্য ও ভৌগোলিক অবস্থানগত বাস্তবতা সমসত্ত্ব কোনো পরিকল্পনা গ্রহণে উৎসাহ দেয় না। তাই জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক প্রশমন বা অভিযোজন পদক্ষেপ যদি একটি একক চিন্তা থেকে করা হয়, সবার জন্য এক সমাধান দেওয়ার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়, তবে তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। অধ্যাপক চক্রবর্তী এ বৈশ্বিক বনাম স্থানীয় বলয়ভিত্তিক চিন্তার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মুক্তিকামিতাকে (বা ইমানসিপেটরি এসপিরেশন) গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন, আমরা যদি হকার, পথকলি, রিকশাচালক ও খুচরা বিক্রেতাদের তাপদাহ থেকে রক্ষা পাওয়ার কথা ভেবে নগর উন্নয়নের কথা ভাবি, তাহলে স্থানীয়ভাবে প্রকৃতি নিয়ে ভাববার অবসর এ প্রান্তিক মানুষদেরও থাকবে। জলবায়ু পরিবর্তন তখন শুরু উচ্চমধ্যবিত্ত আর ধনীদের বসার ঘরের চায়ের কাপে ঝড় তোলা বিতর্কের বিষয় হয়ে রইবে না।
এ ধরিত্রী ও এর অধিবাসীরা এক ও অভিন্ন সত্তা। মৌসুম বা ঋতু-বিন্যাসই বলি কিংবা বলি ধর্মীয় আচারগত উপঢৌকনের কথা, ধরিত্রী ও তার পরিবেশ মানবজীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবেই জড়িয়ে আছে। প্রকৃতিকে উন্নয়নের বা অর্থনৈতিক মুক্তিকামিতার প্রতিপক্ষ করে দেখার অবকাশ নেই। প্রকৃতিকে ঘিরেই আমাদের চাষাবাস, বাণিজ্য, আচার ও উৎসব আবর্তিত হয়। আমাদের সাহিত্য, এমনকি মনন গড়তেও প্রকৃতির ভূমিকা অবিচ্ছিন্ন। তাই জলবায়ু ঝুঁকির এ সময়ে নিজ সংস্কৃতি, আচার, নিদেনপক্ষে নিজ ধর্মের জন্য হলেও প্রকৃতিকে আমাদের জীবন ও চিন্তার কেন্দ্রে স্থান দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, যা বা যাকে নিয়ে আমরা ভাবি না, তা বা তাদের অবহেলা করা ততটাই সহজ হয়ে দাঁড়ায়। এ অবহেলা আমাদের জন্য কোনো মঙ্গলবার্তা বয়ে আনবে না নিশ্চিত। তাই বলতে হয় : ফিরিয়ে দাও আমার খেজুর, শঙ্খ আর পদ্মের পবিত্রতা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের ক্ষেত্রে যেন থাকে আমাদের সবার স্থানীয় চিন্তার প্রতিফলন।
নাভিদ সালেহ : অধ্যাপক, পুরঃ, স্থাপত্য ও পরিবেশ কৌশল অনুষদ, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিন, যুক্তরাষ্ট্র