Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

আশেপাশে চারপাশে

দেশে শিক্ষার নিম্নমান ও তরুণদের বিদেশমুখিতা

Icon

চপল বাশার

প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দেশে শিক্ষার নিম্নমান ও তরুণদের বিদেশমুখিতা

বাংলাদেশের তরুণ সমাজ, বিশেষ করে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার ঝোঁক রয়েছে অনেকদিন থেকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা উন্নত দেশগুলোয় উচ্চশিক্ষার জন্য যান, কয়েক বছর লেখাপড়া করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হন। তারপর আর দেশে ফিরে আসেন না, বিদেশেই থেকে যান, সেখানে চাকরি করেন ভালো বেতনে। দেশের মেধাবী সন্তানরা এভাবেই দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। একেই বলা হয় মেধা পাচার। এর ফলে দেশ ক্রমেই মেধাশূন্য হয়ে যাচ্ছে।

মেধা পাচার নিয়ে বিজ্ঞজনরা কথা বলে আসছেন, বক্তব্য দিচ্ছেন, লেখালেখিও কম হয়নি। কিন্তু মেধা পাচার বন্ধ হচ্ছে না, কমছেও না। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাই বেশি বিদেশমুখী। স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পরই বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর চিন্তাচেতনায় থাকে কীভাবে বিদেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ভর্তি হওয়া যায়। যারা মেধাবী, তারা সহজেই বিদেশের কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়ে যান। তাদের অভিভাবকরা আপত্তি করেন না, বরং সন্তানকে যথাসাধ্য আর্থিক সহায়তা দেন। কষ্ট করে হলেও অভিভাবকরা সন্তানের লেখাপড়ার জন্য বিদেশে টাকা পাঠান। প্রয়োজনে ধারকর্জ করেন, সম্পত্তি বিক্রি করেন। তাদের আকাঙ্ক্ষা থাকে একটাই-সন্তান যেন উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অভিভাবকের টাকায় বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে অনেকেই আর দেশে ফিরে আসেন না। মাঝেমধ্যে দেশে আসেন মা-বাবাকে দেখতে, আবার ফিরে যান। বিদেশে থেকেই মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। কিন্তু অভিভাবকরা সন্তানের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হন। এমন পরিবারও আছে, যাদের সব সন্তানই বিদেশে গিয়ে স্থায়ী হয়েছে। বৃদ্ধ মা-বাবা নিঃসঙ্গ অবস্থায় বাড়িতে পড়ে আছেন। তারপরও অভিভাবকরা সন্তানকে বলেন না, ঘরে ফিরে এসো। কেন বলেন না?

কেন ওরা বিদেশমুখী

অভিভাবকরা কেন সন্তানকে বিদেশ ছেড়ে দেশে ফিরতে বলেন না, এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে আগে বুঝতে হবে কেন তারা বিদেশমুখী। আমাদের সন্তানরা বিদেশমুখী হয়েছে এবং হচ্ছে পরিস্থিতির কারণে। মেধাবী শিক্ষার্থী, যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী, তারা দেশে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ও পরিবেশ পান না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেও সেখানে মন দিয়ে লেখাপড়া করার পরিবেশ কি আছে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় লেখাপড়া করার সুষ্ঠু পরিবেশ কবে ছিল, সেটা জানতে হলে গবেষণা করতে হবে। অতীতের দিকে ফিরে তাকালে আমরা কী দেখি? প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘাত ও গোলযোগ ছিল নিয়মিত ঘটনা। শিক্ষাঙ্গনে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ছিল সাধারণ দৃশ্য। শিক্ষক-অধ্যাপকরাও দলাদলির ঊর্ধ্বে থাকতে পারেননি। এ সবকিছু আমাদের শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করেছে।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উচ্চশিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণার সুযোগ-সুবিধাও সীমিত অথবা নেই। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা শেষে কোনো শিক্ষার্থী পিএইচডি গবেষণায় আগ্রহী হলেও পর্যাপ্ত সুবিধা দেশে পান না। তখন তারা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং সুযোগও পেয়ে যান। পিএইচডি করার পর অনেকে বিদেশেই চাকরি পেয়ে থেকে যান। যারা দেশে ফিরে আসেন, তারাও ভালো চাকরি না পেয়ে আবার বিদেশমুখী হন।

মেধাবীরা দেশে উপযুক্ত মর্যাদা ও কাজের সুযোগ না পেলে বিদেশমুখী হবেন, এটাই স্বাভাবিক। রাষ্ট্র ও সরকারের কর্তব্য মেধাবীরা যাতে দেশেই থাকেন, এর ব্যবস্থা করা। এজন্য তাদের যথাযথ মর্যাদা দিয়ে দেশে রাখতে হবে, যাতে তারা রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারেন।

বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে আমরা নেই

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষাবিষয়ক সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই) প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং প্রকাশ করে। সম্প্রতি তারা যে তালিকা প্রকাশ করেছে, এর প্রথম ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশ নেই। সেরা ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আছে আমাদের প্রতিবেশী ভারতের ২২টি ও পাকিস্তানের ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের দেড়শ বিশ্বদ্যিালয়ের মধ্যে একটিও এ তালিকায় স্থান পায়নি। কত বড় লজ্জা আমাদের জন্য! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে গর্ব করতাম একসময়। সেই গর্ব কবেই ধুলোয় মিশে গেছে। এখন সেরা ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকার শেষ প্রান্তেও আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেল না। স্থান পেয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। আমরা, অর্থাৎ ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী ও জনগণ লজ্জা পাচ্ছি। কিন্তু কর্তাব্যক্তিরা, যারা নীতিনির্ধারক এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, তারা লজ্জা পাচ্ছেন কি? মনে হয় না। টিএইচই বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ধারণ করে যেসব বিষয়ের ভিত্তিতে, এর মধ্যে অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিবেশ, গবেষণার মান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও গ্রহণযোগ্যতা। এসব মানদণ্ডের কোনোটিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় টিকতে পারেনি। তাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

গবেষণার পরিবেশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। সরকার বিপুল অর্থ ব্যয় করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। তাই ঢাবি নিয়ে দু-একটি কথা বলতে চাই সবিনয়ে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ধারণের জন্য প্রথমেই দেখা হয় সেখানে গবেষণার সুযোগ-সুবিধা-পরিবেশ কতটুকু এবং শিক্ষক-গবেষকদের প্রকাশনার মান কেমন। ঢাবিতে গবেষণার সুযোগ-সুবিধা কাগজে-কলমে, খাতাপত্রে আছে। কিন্তু বাস্তবে যা আছে তা খুবই নগণ্য। আর পরিবেশ? যেখানে লেখাপড়া করার পরিবেশই নেই, সেখানে গবেষণার পরিবেশ আশা করা বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার চেষ্টামাত্র। অতীত থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের পরিবেশ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ঢাবিতে সবসময়ই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করেছে। এ অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মোটেই শিক্ষাগ্রহণের অনুকূল নয়, গবেষণা পরের কথা। ঢাবির শিক্ষকরা প্রকাশনার বিষয়ে কতটা আগ্রহী, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

টিএইচই-এর মানদণ্ডের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা কেমন, তথা কোন মানের। ঢাবির মাননীয় শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই, তারা কি শিক্ষার্থীদের যথাযথ বা উপযুক্ত শিক্ষাদান করছেন? তারা নিজেরাই তো ছাত্রছাত্রীদের মতো দলাদলিতে ব্যস্ত থাকেন। অভিভাবকদের অভিযোগ, তাদের সন্তানরা শিক্ষকদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা পায় না। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অনেকের অভিযোগ, তারা ছাত্ররাজনীতি তথা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত। সে কারণেই শিক্ষাঙ্গনে গোলযোগ। শিক্ষকরাই কি রাজনীতি থেকে মুক্ত?

দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ কেন?

ঢাবি ও অন্যান্য সরকারি উচ্চ শিক্ষালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রশ্ন আছে। অভিযোগ আছে, এসব উচ্চ শিক্ষালয়ে মেধার ভিত্তিতে না নিয়ে দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। দলীয় বিবেচনায় যাদের নেওয়া হয়েছে বা নেওয়া হয়, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিবেচনা না করে দলীয় আনুগত্য দেখা হয়। যখন যে দল বা সরকার ক্ষমতায় থাকে, তারা তাদের প্রতি অনুগত বা সমর্থক শিক্ষকদের নিয়োগ দেন। এ অভিযোগ অনেক পুরোনো। এভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা ছাত্রদের শিক্ষাদানের চেয়ে রাজনৈতিক দলাদলিতে বেশি মনোযোগ দেবেন, সেটাই স্বাভাবিক। এ মানদণ্ড নিয়ে ঢাবি কীভাবে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ের তালিকায় স্থান পাবে? এ সমস্যা থেকে ঢাবিকে মুক্ত করতে হলে অবশ্যই দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত করতে হবে। শুধু ঢাবি নয়, সব শিক্ষাঙ্গনকেই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা প্রয়োজন। শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি বা শিক্ষাঙ্গন নিয়ে রাজনীতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার মানকে ক্রমেই পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

মেধা পাচার নিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান নিয়ে কিছু বলতেই হলো। আমাদের উচ্চ শিক্ষালয়গুলোর যে অবস্থা, তাতে বিদেশ থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীরা এখানে আসতে আগ্রহী হয় না। বরং আমাদের শিক্ষার্থীরাই বিদেশে যেতে বেশি আগ্রহী। যাদের বিদেশে যাওয়ার সুযোগ বা সামর্থ্য নেই, তারাই দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ খোঁজে। সেখানেও সুযোগ না পেলে ব্যয়বহুল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়।

দেশ মেধাশূন্য হচ্ছে

আমাদের তরুণদের বিদেশমুখী হওয়ার আরও কারণ আছে। দেশে কর্মসংস্থানের অভাব এর মধ্যে একটি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষ করে তরুণরা চাকরির জন্য ছোটাছুটি করে। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরির চেষ্টা করে। বেসরকারি খাতে অনেকে চাকরি পায়, কিন্তু মেধা অনুযায়ী বেতন পায় না। ফলে তাদের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে এবং শেষ পর্যন্ত চলেও যায়। মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে যাওয়ায় তাদের মেধার সুফল বাংলাদেশ পায় না, পায় অন্য দেশ। দেশ যে ক্রমেই মেধাশূন্য হচ্ছে, এ বাস্তবতা সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে।

মেধাশূন্যতা থেকে দেশকে বাঁচাতে মেধা পাচার রোধ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে সরকার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সবাইকে। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষালয়কে যুগের চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন করা দরকার, যাতে যে কোনো বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে উপযুক্ত স্থান পায়। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নতি হবে। আমাদের সন্তানরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশমুখী হবে না, মেধা পাচারও রোধ করা যাবে।

চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক

basharbd@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম