Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

রাজস্ব আয়ে আয়করের হিস্যা বাড়াতে হবে

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজস্ব আয়ে আয়করের হিস্যা বাড়াতে হবে

কোনো অজুহাতেই কাজ হবে না। মূল্যস্ফীতি, ডিমের দাম, বেগুন-আলুর দাম-কোনো অজুহাতই চলবে না। ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতেই হবে। আর মাত্র ৩০-৪০ দিন। ৩০ নভেম্বর শেষ তারিখ। আগে ছিল সেপ্টেম্বরের শেষ। সদাশয় মুহিত সাহেব নভেম্বরে শেষ করে গেছেন। এটি একটি ভালো কাজ। আরেকটি ভালো কাজ করেছেন সদ্য সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তিনি করহার এবং প্রদেয় করকে দুই বছরের জন্য প্রযোজ্য করে গেছেন। আগে প্রতিবছর করহার, কর নিয়মাবলি পরিবর্তিত হতো। কথা ছিল ৩ বছরের। না, তা হয়নি। করা হয়েছে ২ বছরের জন্য। তবু মন্দের ভালো। করদাতারা একটা ছোটখাটো পরিকল্পনা করতে পারেন। করহার একবার পরিবর্তন হলে ওই বছর করদাতারা আর কোনো সুযোগের ব্যবহার করতে পারেন না। এমনও কথা ছিল যে, সরকার কর বছর (অ্যাসেসমেন্ট ইয়ার) পরিবর্তন করে বৈশাখের দিকে আনবে। না, তা হয়নি। এখন দেশে নানা বছর চালু আছে। ব্যাংকে আর্থিক বছর জানুয়ারি-ডিসেম্বর। ব্যাংকগুলো ডিসেম্বরে তাদের হিসাব ‘ক্লোজ’ করে। মজার ঘটনা, ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘আর্থিক বছর’ আবার জুলাই-জুন। এটা সরকারেরও অর্থবছর। আমাদের বাজেট করার বছর হচ্ছে জুলাই-জুন। এটা চলছে পাকিস্তান আমল থেকে (১৯৪৭ থেকে)। মনে করা হয়েছিল, পাকিস্তানের ‘লিগ্যাসি’ আমরা ছাড়ব। না, তা হয়নি। এদিকে বাঙালির বছর আবার ভিন্ন। বৈশাখ থেকে চৈত্র। বৈশাখ মাসে এখন একটা ফসল ওঠে-বোরো, আমাদের প্রধান ফসল। এছাড়া আমাদের ব্যবসায়ীরা নানা বছর পালন করেন হিসাবের ক্ষেত্রে। এ অবস্থায় আশা করা যাচ্ছিল এই এলোমেলো অবস্থার অবসান ঘটবে। না, তা হয়নি।

তবে মন্দের ভালো, আয়করের বছর পরিবর্তিত হয়েছে। জুনে ‘আয় বছর’ (ইনকাম ইয়ার) শেষ হয়। ৫ মাসের মধ্যে কর বছরের (অ্যাসেসমেন্ট ইয়ার) হিসাব জমা দিতে হয়। কোনো রেহাই নেই। কারও ‘বার্ষিক আয়’ ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার উপরে হলেই সরকারের কাছে হিসাব দিতে হবে। বলতে হবে কত আয় হয়েছে, কোত্থেকে এ আয় হয়েছে, তার কাগজপত্র কোথায় ইত্যাদি। বলতে হবে বছরে খরচ কত হয়েছে-তাও ভাগ ভাগ করে। খাওয়া খরচ, যাতায়াত, বিদ্যুৎ, আপ্যায়ন ইত্যাদি খরচ আলাদাভাবে বলতে হবে। আয়-ব্যয়ের হিসাব দেওয়ার পর বলতে হবে সম্পদের খবর। কত টাকার সম্পদ কার আছে, তাও বলতে হবে। ভেঙে ভেঙে বলতে হবে। জমিজমা, শেয়ার, আমানত, ক্যাশ, ব্যাংক জমা, গাড়ি-বাড়ি সব। ছাড় নেই। হলফনামা দিতে হবে। বলাই বাহুল্য, প্রতি আয়-ব্যয়ের নথিও জমা দিতে হবে। নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে কত বড় কাজ এ মুহূর্তে বাড়িতে বাড়িতে চলছে। যাদের বার্ষিক আয় সাড়ে তিন লাখ টাকা (নারী, ৬৫ ঊর্ধ্ব পুরুষ, মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সামান্য রেয়াত আছে), তাদেরই রিটার্ন দিতে হবে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে। সাড়ে তিন লাখ টাকা মানে মাসে কত হয়? ২৯ হাজার ১৬৬ টাকা মাত্র। বলাই বাহুল্য, মাসিক এই আয়ের মধ্যে আজকের দিনে পরে লাখ লাখ লোক। মাসিক ২৯ হাজার ১৬৬ টাকা আয় মানে দিনে ১০০০ টাকার কম। অনেক ক্ষেত্রে জোয়ান রিকশাওয়ালার দৈনিক আয়ও ১০০০ টাকার উপরে। কাঁচাবাজারের দোকানিদের আয়ও দৈনিক এর চেয়ে বেশি। অনেক শ্রমজীবীও আজকাল এর চেয়ে বেশি রোজগার করেন। এই অর্থে দেশে করদাতার সংখ্যা হওয়া উচিত লাখ লাখ। আসলেই তাই। কয়েক লাখ লোকের ‘ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর’ (টিআইএন) আছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে রিটার্ন জমা দেন খুব কম লোক। নানা বাধ্যবাধকতার কারণে মানুষ টিআইএন নেন, কিন্তু বাস্তব কারণে রিটার্ন জমা দেন না। এটা কিন্তু ‘কর ফাঁকি’। বিশাল অভিযোগ। সত্যি সত্যি আইন মানা হলে দেশে কর ফাঁকিবাজের সংখ্যা হবে হাজার হাজার। আয়-সম্পদের মালিক। বর্তমান বিধানে ৪ কোটি টাকার সম্পদ হলেই ‘সম্পদ কর’ (ওয়েলথ ট্যাক্স) দিতে হয়। তার মানে কী? আমাদের দেশে যারই চার কোটি টাকার সম্পদ আছে, সে-ই সরকারের খাতায় ‘ধনী লোক’। এ হিসাবে দেশে লাখ লাখ লোক ‘ধনী’। দেশে এমন অঞ্চলও আছে, যেখানে এক বিঘা জমির দাম এক কোটি টাকা। আর ঢাকায় অনেক অঞ্চল আছে, যেখানে বিঘা নয়, কাঠাপ্রতি জমির দাম ১০-১৫-২০ কোটি টাকা। এ হিসাবে দেশে ধনী লোকের সংখ্যা কত হবে? লাখ লাখ। না, সরকারের খাতায় তা নয়। ‘আয়কর রিটার্নে’ সম্পদ দেখানো আছে এক কোটি, দুই কোটি, তিন কোটি টাকা-কতজনের? সম্পদ তো দূরের কথা, কতজন লোকের রিটার্নে বার্ষিক আয় দেখানো আছে ৪-৫ লাখ টাকা? একমাত্র চাকরি যারা করেন, তাদের উপায় নেই। তাদের রেকর্ড পাক্কা। তাদের হিসাব বাদে দেখা যাবে দোকানদারের বেচাকেনা দিনে ২০-৫০ হাজার টাকা, তার বার্ষিক আয় মাত্র ৪ লাখ টাকা। এভাবেই চলছে আমাদের জাতীয় সংসার। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর।

ইদানীং ঘটছে আরেক ঘটনা। আমরা ছাত্রজীবনে পড়েছি-তারা কর দেবে, যাদের আয় (ইনকাম) আছে। যার আয় যত বেশি, তার কর তত বেশি। এটাই একটা সমতাকামী সমাজের বিচার। বলা যায় সুবিচার। আয় বেশি, করের হার বেশি। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, ততই দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। এখন ধীরে ধীরে সব সমান হয়ে যাচ্ছে। এই যেমন ‘ভ্যাট’ বলে একটা ‘ট্যাক্স’ আছে, যার পুরো নাম ‘ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স’। প্রায় সব জিনিসেই এটা আছে। এর হারও নির্র্ধারণ করা আছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, একজন গরিব লোক যে হারে ‘ভ্যাট’ দেন, একজন ধনীও সে হারে ‘ভ্যাট’ দেন। কোনো পার্থক্য নেই। এটা কি করনীতির ব্যত্যয় নয়? প্রশ্ন করতে পারি, কিন্তু উত্তর নেই। উত্তর আছে, কিন্তু তা সদুত্তর নয়। মজা হচ্ছে, ‘ভ্যাট’ হচ্ছে পণ্যের ওপর কর। এক কেজি চিনি কিনলে তা হয়তো দিতে হয়। কিন্তু এখানে প্রশ্ন আছে। কেমন প্রশ্ন? পণ্য কেনা মানে কিন্তু ‘ভোগব্যয়’। অর্থাৎ ‘কনজাম্পশন’। এটা আমার ভোগের জন্য ব্যয়। দেখা যাচ্ছে, ভোগের জন্য কর বসছে। নাম ‘ভ্যাট’। সেক্ষেত্রে কেউ প্রশ্ন করতে পারে, কর কি মানুষ দুই দিকে দেবে? আয়েও (ইনকাম) কর দেবে, আবার ভোগের ক্ষেত্রেও কর দেবে? প্রশ্নটি স্বাভাবিক। কারণ আমরা বইয়ে পড়েছিলাম, আয়ের ওপর কর হবে। যত বেশি আয়, তত বেশি কর। এখন দেখা যাচ্ছে, গরিব পণ্য কিনলে যত কর দেয়, ধনীও তা-ই দেয়। এর আরেক মজা হচ্ছে, এ করটি দোকানদার তুলে সরকারের কাছে জমা দেয়। এটাই নাকি নিয়ম। অতএব, আদায় খরচ নেই। রাজস্ব বিভাগ আপসে ঘরে বসে তার কর পেয়ে যাচ্ছে। এটা একদিক থেকে ভালো। ঝামেলা কম। প্রশাসনিক ঝামেলা কম। আদায় খরচ কম। হিসাব খরচ কম। এ কারণেই কি এ নিয়ম করা হয়েছে? জানি না এ কারণেই ‘ভ্যাট’ খুব জনপ্রিয় ‘ট্যাকসেশন পদ্ধতি’ কিনা। ঝগড়াঝাঁটিবিহীন করব্যবস্থা। করদাতা ও রাজস্ব কর্মকর্তার দেখা নেই। অথচ কর আদায় হচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে আমাদের ক্ষেত্রে সুন্দর একটা অবস্থা। দীর্ঘদিন ধরে মোট রাজস্ব আয়ে (রেভিনিউ) আয়করের (ইনকাম ট্যাক্স) হিস্যা বাড়ছে না। আয়কর প্রত্যক্ষ কর। সবাই চায় এটা বাড়ুক। আন্তর্জাতিক মুরব্বি আইএমএফও তা-ই চায়। কিন্তু তা হচ্ছে না। আয়কর কেউ দিতে চান না। বড় বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সিনেমা অভিনেতা থেকে শুরু করে যাদের আয় বেশি, তারা আয়কর দিতে চান না। তারা খোঁজে এমন দেশ, যেখানে কোনো কর নেই। তারা বিনিয়োগ করে এমন দেশে, যে দেশে শ্রমিকদের ঠকানো যায়, আর আয়কর দিতে হয় না। বড়ই বিস্ময়কর ঘটনা বিশ্বে ঘটছে। পৃথিবীতে বহু দ্বীপ দেশ আছে, যেখানে দুনিয়ার তাবৎ ধনীর টাকা রয়েছে-ট্যাক্সহীন টাকা। ওখান থেকে বিনিয়োগকারীরা ডলার নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আয়কর কেউ দিতে চান না।

এর কারণ আছে আমাদের দেশে। আয়কর দিলাম জীবনভর। কিন্তু সরকার প্রতিদানে করদাতাকে কিছুই দেয় না। আজকাল দেখা যায়, আয়করদাতাকে বছরে একটা সর্টিফিকেট দেওয়া হয়। যাক, তাও একটা সান্ত্বনা। কিন্তু প্রশ্ন, যে করদাতা সারা জীবন সুবোধ বালকের মতো চাকরিজীবনে নিয়মিত কর দিলেন, আজ অবসর নেওয়ার পর তিনি কি কোনো সুবিধা সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন? হাসপাতালে কি তিনি কোনো ছাড় পান? পান কোনো সম্মান? দুটি ওষুধ কি তিনি একটু কম দামে পান? ট্রেনের টিকিট কাটতে গিয়ে কি তিনি অগ্রাধিকার পান? না, সাধারণভাবে পান না। কিছুটা অগ্রাধিকার পান বাণিজ্যিক লোকজন। তাদের দাম বেশি। তাদের বলে ‘সিআইপি’। কিন্তু বেসরকারি খাতের যে কর্মচারী-কর্মকর্তা সারা জীবন ট্যাক্স দিল হাজার হাজার টাকা, তিনি কি কিছু পান? না, এমন কিছুর কথা শোনা যায় না। তাদের বেলায় ডাল বরাবর।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম