Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

অন্যমত

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় বসুন

Icon

আবু আহমেদ

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় বসুন

ফাইল ছবি

ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এ সরকারের দুই মাস পার হলো। জনপ্রত্যাশার তুলনায় তারা কিছুটা ধীরগতিতে এগোলেও প্রত্যাশা পূরণে আশাবাদী বিএনপি এবং দেশের অন্য রাজনৈতিক দলগুলো। দেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশে সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত আছে। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন তা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমাদের একটু ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করতে হবে আগামীর নতুন সূর্যোদয়ের জন্য।

একটা বিষয় না বললেই নয়। সেটা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নীতি সুদের হার বাড়িয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে ক্রমাগত বাড়ছে ঋণের সুদহার। এর প্রভাবে শিল্প খাত চরম বিপর্যয়ের মুখে পতিত হচ্ছে। কেননা সুদের হার বাড়ার কারণে একদিকে বাড়ছে পণ্যের উৎপাদন ব্যয়, অন্যদিকে কমছে বহির্বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। এ অবস্থা চলতে থাকলে মূল্যস্ফীতি হয়তো কমে আসবে, কিন্তু শিল্প খাতের বিপর্যয়ের কারণে কর্মসংস্থানহীন হয়ে পড়বে গোটা দেশ। তাই দেশের স্বার্থে সুদহারে স্থিতিশীলতা আনা প্রয়োজন বলে মনে করছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। বাইরের দেশগুলো বর্তমানে সুদের হার কমানো শুরু করেছে। কাজেই আমাদেরও সুদের হার কমাতে সচেষ্ট থাকতে হবে। এ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাবা উচিত বলে মনে করি। তাই আমি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে অনুরোধ করব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। বর্তমান সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের যে দূরত্ব রয়েছে, সেটা কমিয়ে আনতে হবে। সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে ব্যবসায়ীদের নিতে পারলে ভালো হতো। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের কথা বলাটা খুবই দরকার। কেননা দেশের অর্থনীতি চলে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ, উৎপাদন ইত্যাদির মাধ্যমে।

দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। যদি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ে, তাহলে আমাদের টাকা আর মূল্য হারাবে না। এটি দেশের জন্য অবশ্যই ইতিবাচক একটি দিক। কিন্তু দেশের প্রবৃদ্ধির হার আরেকটু উপরের দিকে নিতে পারলে ভালো হয়। ৪-৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বর্তমানে পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে। ৫ শতাংশ যথেষ্ট ভালো। সুতরাং আমাদের ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে।

শেয়ারবাজারে টাস্কফোর্স গঠন করেছে বর্তমান সরকার। এটা অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। এ টাস্কফোর্স শেয়ারবাজারের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করবে। তবে শেয়ারবাজারের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করেই তারা হুট করে কিছু করতে পারবে না। তাই বর্তমান সরকারের কাছে আমার একটা প্রস্তাব আছে, সেটা হলো, স্টেট ওউন্ড এন্টারপ্রাইজেস (এসওই) নামে যে শেয়ারগুলো রয়েছে, সেগুলো বিক্রি করে দেওয়া উচিত। যদিও এগুলো এক সময় ভালো শেয়ারই ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সরকার এগুলোকে চালাতে পারেনি বা পারবেও না। সেজন্য এগুলো এখন খারাপ শেয়ারে রূপান্তরিত হয়েছে। সরকার এগুলো বিক্রি করে দিলে একদিকে সরকারও টাকা পাবে, অপরদিকে এগুলো রি-প্রডাক্টিভ হবে। কারণ যারা এগুলোর মেজরিটি শেয়ার কিনতে চায় বা কিনবে, তারা এগুলোকে ফেলে রাখবে না, তারা অবশ্যই এগুলোকে ‘ফার্দার এডিশনাল ক্যাপিটাল’ হিসাবে খাটাবে। তখন স্বাভাবিকভাবেই এগুলো প্রডাক্টিভ হবে।

স্টেট ওউন্ড এন্টারপ্রাইজেসের অনেকগুলোই এখন সরকার ভর্তুকি দিয়ে চালাচ্ছে। যেমন ইস্টার্ন কেব্লস। এটা ইতোমধ্যেই শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি। ওসমানি গ্লাস শিটের মতো কোম্পানিগুলো ইন্ডাস্ট্রি হিসাবে বসে গেছে। সুতরাং এগুলোকে ‘ফার্দার এডিশনাল শেয়ার’ হিসাবে বিক্রি করলে যারা এগুলো নেবে তারা মেজরিটি শেয়ার নিয়ন্ত্রণ করে ওগুলোকে সক্রিয় করার চেষ্টা করবে। যখন এগুলো রি-অ্যাক্টিভেট হবে এবং প্রডাক্টিভ হবে, তখন এগুলো দেশের জিডিপিতে অবদান রাখবে। ফলে জিডিপি বাড়বে। অর্থাৎ স্টেট ওউন্ড এন্টারপ্রাইজগুলো বিক্রি করার কারণে একদিকে সরকার টাকা পেয়ে গেল, অপরদিকে দেশের জিডিপিও বাড়ল। সুতরাং এ বিষয়টি সরকারের জন্য অবশ্যই ইতিবাচক হবে। শুধু তাই নয়, সরকারের ঘাটতি বাজেটের যে চাপ আছে, সেটা কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে। তখন শেয়ারবাজারেও অনেকটা চাঙা ভাব ফিরে আসবে। বর্তমান শেয়ারবাজারে ভালো শেয়ারের যে অভাব রয়েছে, সেটা কিছুটা পূরণ হবে।

বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। মধ্যবিত্ত, নিুমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির জনগণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে দ্রব্যমূল্য। সুতরাং বর্তমান সরকারকে দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানতে হবে। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়টি অনেকটা সিজনাল। এ বিষয়টি আমাদের দেশের জনগণের মনে রাখতে হবে। তবে সরকারকে বাজার মনিটরিংয়ের বিষয়টিতে জোর দিতে হবে। মার্কেট সুপারভিশন ব্যবস্থাটি সচল রাখতে হবে, যাতে করে অসাধু ব্যবসায়ীরা কোনো অজুহাত দাঁড় করিয়ে পণ্যের মূল্য বাড়াতে না পারে। তবে এ বিষয়গুলো ব্যবসায়ীরা ভালো বোঝে। সেজন্য আমি সরকারকে প্রস্তাব দেব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনার জন্য।

বর্তমান সরকার ব্যাংক খাতের পুরোনো বোর্ডগুলো ভেঙে দিয়েছে, এটা অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। তবে সমস্যা হচ্ছে, যে বোর্ডগুলো ভেঙে দিয়েছে, সেগুলো আগে থেকেই আস্থার জায়গাটিতে এত বেশি ঘাটতি করে রেখেছে যে তা পূরণ করা মুশকিল হচ্ছে। বর্তমানে ব্যাংক খাতে একটা অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। একটা তারল্য সংকট চলছে। যে কারণে অনেক ব্যাংকই গ্রাহকের টাকা দিতে পারছে না। তবে একটা বিষয় ব্যাংক গ্রাহকদের মাথায় রাখতে হবে : সবাই যদি ব্যাংক থেকে একসঙ্গে টাকা তুলে ফেলে, তাহলে তো ব্যাংকগুলো চলবে না, বন্ধ করে দিতে হবে। তাদের একটু সময় তো দিতেই হবে। বর্তমানে যাদের হাতে ব্যাংক খাতের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেটা ঠিকই আছে। যোগ্য হাতেই এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। ব্যাংক খাতে লুটেরারা এখন আর নেই। সুতরাং জনগণের টাকা লুট হওয়ার আশঙ্কা আর নেই বললেই চলে। তবে জনগণকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে। ব্যাংক গ্রাহকদের ভয় পেলে চলবে না। এটা একটু সময় নেবে, পরে ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। যেহেতু বাংলাদেশ সরকারের একটা অলিখিত নির্দেশ আছে, কোনো ব্যাংককেই ফেল করতে দেওয়া হবে না, সেহেতু সরকারের এ নির্দেশের প্রতি আমাদের বিশ্বাস বজায় রাখতে হবে। এ বিষয়টি ব্যাংকের আমানতকারীদেরও বুঝতে হবে।

আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে। কারণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে নিুগামী প্রবণতা ছিল, এর বেশিরভাগই হয়েছিল পুঁজি পাচার থেকে। পুঁজি পাচারটা এখন আর হবে না। মানে পুঁজি পাচারটা বন্ধ হয়েছে, এটা ধরেই নিয়েছি আমরা। সুতরাং পুঁজি পাচার বন্ধ হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াটাই স্বাভাবিক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের অর্থনীতির সূচকগুলো আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আরও ইতিবাচক ইঙ্গিত দেবে। রপ্তানিও বাড়বে। এ সবকিছুর জন্য আমি আবারও সরকারকে অনুরোধ করব ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনার বিষয়ে। এতে করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভালো হবে। আরেকটি বিষয় না বললেই নয়। সেটা হচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত টিসিবির মাধ্যমে ট্রাক সেল বাড়াতে হবে। যাতে করে নিুবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির জনগণের মাঝে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে। (অনুলিখন : জাকির হোসেন সরকার)

আবু আহমেদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ; চেয়ারম্যান, আইসিবি

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম