Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

অপরাধের তদন্ত যেন ত্রুটিমুক্ত হয়

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অপরাধের তদন্ত যেন ত্রুটিমুক্ত হয়

ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান দেশের ইতিহাসে যুগান্তকারী অধ্যায় নির্মাণ করেছে। সময়ের আবর্তনে অযৌক্তিক বৈষম্যের বেড়াজালে কোটাভিত্তিক নিয়োগ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। ২০১৮ সালে ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন জনগণকে সচেতন করেছিল। চলতি বছরের জুলাই মাসের প্রথম থেকে তরুণ শিক্ষার্থীরা নতুন করে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করে। তারা ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে অদম্য চেতনায় উজ্জীবিত। জীবন বিসর্জন দিয়ে হলেও আগামী প্রজন্মের জন্য চলমান প্রজন্মের প্রতিশ্রুতি ছিল অভাবনীয়। বৈষম্যের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেঙে মেধা-প্রজ্ঞা-সমতার ভিত্তিতে যোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারণই ছিল তাদের লক্ষ্য।

শেষ পর্যন্ত বিগত সরকারের দাম্ভিকতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও অহংবোধ পরাভূত হতে বাধ্য হয়। জয়যুক্ত হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলন। ফলে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দেশের স্বার্থে অরাজনৈতিক এক বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে অভিষিক্ত করা হয়। শান্তিতে নোবেলজয়ী সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বপরিমণ্ডলে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসাবে ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত। সৃজনশীলতা-মননশীলতা-মানবিকতার অপূর্ব সম্মিলনে ইতঃপূর্বে কোনো ধরনের রাষ্ট্রক্ষমতা না নিয়েও তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্বনন্দিত। গত মাসের শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদান, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনায় তার অংশগ্রহণ বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে অনন্য উচ্চতায় সমাসীন করেছে।

আমাদের সবার জানা, বিগত সরকার আমলে অনাচার-দুর্বৃত্তায়নের বিস্তার ঘটেছিল দেশে। সরকারি বিভিন্ন সেবা সংস্থাসহ সর্বত্র অশুভ শক্তির অপতৎপরতা জনগণের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। ঘুস-দুর্নীতি-হয়রানির কারণে মানুষের জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার হয়ে যায়। বিগত সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় কতিপয় লুটেরা বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকানা দখল করে। অর্থ-ক্ষমতালিপ্সু মানুষগুলোর আত্মতৃপ্তির কোনো চৌহদ্দি ছিল না। যে কোনো অবৈধ ও অনৈতিক পন্থায় অর্থ উপার্জনই ছিল তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। ব্যক্তিস্বার্থে লোভ-লালসা চরিতার্থে জনগণের জমাকৃত অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠনে তারা বিন্দুমাত্র সংকোচবোধ করেনি। বিশেষ কিছু ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান পারস্পরিক যোগসাজশে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেনি; বরং নানামুখী কদর্য প্রক্রিয়ায় ঋণপ্রাপ্ত হয়েছে। পুনঃতফসিলীকরণের নামে সুদমুক্তি এবং অধিক মাত্রায় ঋণ প্রদানের অপসংস্কৃতি দেশের অর্থব্যবস্থাকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছে। শেয়ারবাজার থেকে শুরু করে প্রতিটি খাত ছিল এদের প্রভাবের আওতায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ গ্রহণের বিপরীতে জুন ২০২৪ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত থাকা খেলাপি ঋণের তুলনায় জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। ১৬ আগস্ট গণমাধ্যমে প্রকাশিত জিএফআই’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা; যার সিংহভাগ কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য ও আরব আমিরাতসহ ১০ দেশে পাচার হয়েছে বলে সংস্থাটির ধারণা। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিগত সরকারের কতিপয় প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি-আমলা বিপুল পরিমাণ এ অর্থ পাচারে জড়িত। সরকার পতনের পর জনগণ এতদিন আড়ালে থাকা অনেক বিষয় সম্পর্কে সম্যক অবগত হচ্ছেন। বিভিন্নভাবে নানামুখী অপরাধে জড়িত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের দুর্বৃত্তায়ন সম্পর্কে নতুন তথ্য-উপাত্ত প্রতিদিনই প্রকাশ পাচ্ছে।

বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ছাত্র-জনতার গণজাগরণে সরকার পরিবর্তনের পরপরই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পতিত সরকারের মন্ত্রী-এমপি, সাবেক-বর্তমান উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের পৃথক অনুসন্ধান শুরু করে। গত ১৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এ অনুসন্ধান তালিকায় এক মাসের মধ্যে ৭৬ জনের নাম প্রকাশ পায়। ইতোমধ্যে তাদের সম্পদের তথ্য চেয়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), নিবন্ধন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসসি), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চিঠি দিয়েছে দুদক। সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমে জানান, যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে, তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তি ও নিকটাত্মীয়দের নামে সম্পদ আছে কিনা, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে হাতে পাওয়া বেশ কয়েকজনের সম্পদসংক্রান্ত নথিপত্র যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। অবৈধভাবে দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়েছেন, এমন অভিযোগের ভিত্তিতে অনেকের বিদেশযাত্রার ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

এছাড়াও অভ্যুত্থানে বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতার মৃত্যুর ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ বহু প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি-আমলা-ব্যবসায়ী-নেতাকর্মী ও পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। ২০ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্রমতে, বিগত তিনটি সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ দলীয় এমপিদের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৭৪১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে হয়েছে ২২৭টির বেশি মামলা। বাকি ৫১৪টি মামলা হয়েছে অন্যান্য জেলায়। এসব মামলার মধ্যে প্রায় ২০০টিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আসামি করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে পরিবেশিত মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণী পর্যালোচনায় পরিলক্ষিত হয়, প্রতিটি মামলায় আসামির তালিকা প্রায় একই ধরনের। শুরুতে কিছু নাম উল্লেখ করে পরে কয়েক হাজার অজ্ঞাতনামাকে আসামি করে মামলাগুলো করা হয়েছে। জনশ্রুতিমতে, অনেক ক্ষেত্রে আসামি করার পেছনে মামলার বাদী কিংবা পরামর্শদাতা তাদের ব্যক্তিগত ক্ষোভ-আক্রোশ-বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। বাদী নিজেই জানে না অথচ থানায় মামলা হয়ে গেছে মর্মে ঘটনার তথ্যও রয়েছে।

বিভিন্ন মামলা দায়েরের প্রবণতা ও প্রক্রিয়া দেখে সুবিচারপ্রাপ্তির বিষয়ে আইনজ্ঞরা সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাদের অভিযোগ, সারা দেশেই মামলা হচ্ছে। মামলা করা ভিক্টিমের অধিকার হলেও সেই মামলায় আসামি করা হচ্ছে শত শত মানুষকে; যা সুবিচার নিশ্চিতের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। অভিযোগ প্রমাণেও বিঘ্ন ঘটাতে পারে। দায়েরকৃত মামলাগুলোর বেশিরভাগই ত্রুটিপূর্ণ। এ ত্রুটির সুফল পাবে আসামিপক্ষ। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারমূলক প্রতিশ্রুতি। এ প্রেক্ষাপটে অপরাধী ব্যক্তির বিচারের মুখোমুখি না হয়ে পার পেয়ে যাওয়া অগ্রহণযোগ্য। প্রকৃত সব অপরাধী যাতে শাস্তি পায়, বর্তমান পুলিশ প্রশাসন, বেসামরিক প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে তা নিশ্চিত করতে হবে। মামলার আর্জি কখনো ক্ষোভ-ঘৃণা-প্রতিশোধপরায়ণতা প্রয়োগের ক্ষেত্র নয়। অপরাধী যে অপরাধটি করেছে, সাক্ষ্য-প্রমাণসাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে সেই অপরাধের মামলা দায়েরই সুবিচার নিশ্চিত করতে পারে। মনে রাখতে হবে, কোনো নির্দোষ বা নিরপরাধ ব্যক্তি ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে কোনোভাবেই যেন হয়রানির শিকার না হয়। অপরাধের তদন্ত সামগ্রিকভাবে ত্রুটিমুক্ত না হলে আইন কাঠামোয় বিচার দুর্বল হয়ে পড়বে। আইনের ফাঁকফোকরে অপরাধীরা সাজামুক্ত থাকবে। তাই বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে যথাযথ উদ্যোগ জরুরি। একইসঙ্গে মিথ্যা-বানোয়াট-ভিত্তিহীন-হয়রানিমূলক মামলার অভিযোগকারীর বিরুদ্ধেও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অতীতের সুবিধাভোগী গোষ্ঠী নানা অশুভ-অবৈধ কর্মযজ্ঞে জড়িয়ে পড়েছে। দখল-লুট-সন্ত্রাস ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপতৎপরতা চালাচ্ছে। প্রতিহিংসা, প্রতিশোধপরায়ণতা ও অর্থলোভ কতিপয় দুর্বৃত্তকে বেপরোয়া করে তুলেছে। সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে ঘোষিত হয়েছে, অকাট্য তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কোনো মামলা বা অভিযোগ নেওয়া সমীচীন নয়। দেশের প্রত্যেক মানুষ মনে করে, ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে যারা হত্যা-গণহত্যা, নির্দেশ প্রদান এবং নির্বিচারে অসংখ্য মানুষকে পঙ্গু করে দেওয়ার মতো জঘন্য অপরাধ করেছে, তারা ক্ষমার অযোগ্য। তাদের বিরুদ্ধে দেশের আইনি কাঠামোয় যথার্থ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে সাজা নিশ্চিত করতে হবে। সময়ের জোরালো দাবি-সমগ্র জনগণের ঐক্যবদ্ধ সমর্থনে প্রস্তাবিত সব সংস্কার কার্যক্রম সফলভাবে সুসম্পন্ন হোক। রাষ্ট্র মেরামতের সুফল যাতে প্রত্যেক নাগরিক পেতে পারে, তার সুব্যবস্থাই কাম্য।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম