Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শিক্ষায় কম গুরুত্ব দিয়ে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়

Icon

ড. আলা উদ্দিন

প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষায় কম গুরুত্ব দিয়ে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়

বৈষম্যমুক্ত সমাজ নির্মাণের অন্যতম প্রধান ভিত্তি পাকাপোক্ত হয় শিক্ষার মাধ্যমে। অসম শিক্ষা, সদা পরিবর্তনশীল শিক্ষাধারা সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার অন্তরায়। সমতা, ন্যায্যতা ও অসাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার স্থায়ী, অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমতাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা-যার দারুণ অভাব বেশ কয়েক বছর ধরে সর্বমহলে চরমভাবে অনুভূত হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষাব্যবস্থার সংকট নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হলেও বাস্তবসম্মত গতি পায়নি পরম প্রয়োজনীয় শিক্ষাব্যবস্থা। কখনো কখনো শিক্ষাব্যবস্থায় আকস্মিক বড় ধরনের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলেও তা নিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষাবিদরা প্রায়ই তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কারণ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং যথাযথ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আলোচনা বা তাদের মতামতের ভিত্তিতে নেওয়া হয় না; বেশিরভাগ সময় এটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সরকারি কর্তৃপক্ষের নিজস্ব দ্রুত চিন্তার ফসল। তাই আকস্মিক পরিবর্তনগুলো প্রায়ই শিক্ষাবান্ধব হয় না। তাই তা শেষ পর্যন্ত শিক্ষার গুণগত উন্নয়নের জন্য সহায়ক নয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য বিজ্ঞানমনস্ক ও বাস্তবসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে স্বাধীনতার পরপর বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে একটি ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন’ গঠন করা হয় (১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই)। তবে এ কমিশন প্রণীত প্রস্তাবনা ও সুপারিশগুলো (১৯৭৪ সালের মে মাসে প্রকাশিত) বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এর পরিবর্তে পূর্বেকার ধারায় আমলা-উৎপাদনমুখী চাকরিবান্ধব শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। পরীক্ষায় নকল করার প্রবণতা এ সময়ে বিশেষ মাত্রা পায়।

১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের পর বেসরকারি, বাণিজ্যনির্ভর ও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা সমধিক অগ্রাধিকার পায়, অদ্যাবধি যা অব্যাহত রয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে এ+, জিপিএ ফাইভ ও নানা নামকরণ তথা ‘ভালো’ ফলাফলের প্রতিযোগিতা। আগে যেখানে ভালো শিক্ষার ওপর প্রাধান্য দেওয়া হতো, এখন তা অনেকাংশে ফলাফলকেন্দ্রিক। ‘ভালো’ ফলাফলকেন্দ্রিক শিক্ষার যাত্রা শুরু হয় ১৯৯১ সালের পরপর। ১৯৯২ সাল থেকে প্রথমবারের মতো এসএসসি পরীক্ষায় প্রতি বিষয়ের ১০০ নম্বরের স্থলে ৫০ নম্বরের জন্য নির্দিষ্ট প্রশ্নব্যাংক (৫০০ প্রশ্ন) প্রচলন শুরু হয় (গণিত ব্যতীত)। এ নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। কারণ, এ প্রশ্নব্যাংক আদতে শিক্ষা বা জ্ঞানার্জন অপেক্ষা মুখস্থবিদ্যাকে উৎসাহিত করেছে।

পাঁচ বছর আগেও শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি নম্বর প্রদানের জন্য কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার কথা জানা যায়, যা অতীতে কখনো ঘটেনি; অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফলের জন্য শিক্ষকদেরও বিশেষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে-পাঠদানের মাধ্যমে নয়, নম্বর প্রদানের মাধ্যমে। ফলে এক যুগ আগেও যেখানে কোনো গ্রামে চার-পাঁচজনের বেশি প্রথম বিভাগ কিংবা আট-নয়জনের বেশি এ+ পেত না; এখন যতজন পরীক্ষার্থী তার অর্ধেকের বেশি এ প্লাস বা জিপিএ ফাইভ পায়। অথচ প্রতিযোগিতামূলক কোনো পরীক্ষায় তাদের ফলাফল খুব হতাশাজনক। স্কুল অপেক্ষা মাদ্রাসা এবং গ্রাম অপেক্ষা শহরের দিকে পাশের ও ‘ভালো’ ফলাফলের হার বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে পাঠ্যক্রম, পরীক্ষা ও ফলাফল ইত্যাদি নিয়ে নিত্যপরিবর্তন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের বিষিয়ে তুলেছে। জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

এর মধ্যে একটা অংশ এইচএসসি পাশ করার পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হয়। কিন্তু ক্লাসে তাদের বেশিরভাগের কর্মদক্ষতা দেখে সংশয় জাগে-এরা তো অন্তত এসএসসি পাশ করেছিল! তাদের অনেকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও হচ্ছে। এ অবস্থায় আবার কোনো কোনো শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক করার জন্য দরকার হলে শিক্ষক নিয়োগের বিদ্যমান নীতিমালার বদল কিংবা স্থগিতও করা হয় (এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রগণ্য)। আর যারা শিক্ষক হতে পারে না; তাদের বেশিরভাগের মূল লক্ষ্য থাকে বিসিএস পরীক্ষা পাশ করে প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা তথা সরকারি ক্যাডার হওয়া। এ প্রবণতা সাম্প্রতিক। প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হতে পারা (বিশেষ করে প্রশাসন ও পুলিশ) মানে যেন বিশ্বজয় করা। আর যেন পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। আজ থেকে এক যুগ আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষক পাওয়া যেত, যারা কিনা সরকারি চাকরি ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। বর্তমানে ঘটছে তার উলটোটা। একদিকে আর্থিক, প্রশাসনিক (ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা), অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি বিবেচনা তথা সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অপেক্ষা সরকারি কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেওয়া হয় অনেক বেশি।

বাণিজ্য ও প্রশাসননির্ভরতার কারণে ধীরে ধীরে সরকার আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে। ফলে শিক্ষকদের পূর্বে প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও আমলাদের অবস্থান সম্মুখসারিতে। এ যদি হয় উচ্চশিক্ষার অবস্থা; উচ্চমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও প্রাথমিকের অবস্থা কল্পনাতীত শোচনীয়। কলেজের শিক্ষকদের পদোন্নতির গতি অত্যন্ত শ্লথ; আর মাধ্যমিক ও প্রাথমিকের শিক্ষকদের সংকটের কথা না-ই বললাম। এ যদি হয় শিক্ষকদের অবস্থা, তাহলে এ মানুষ গড়ার কারিগরের কি-ই-বা ক্ষমতা সত্যিকারের সুনাগরিক গড়ার! শিক্ষকদের কান ধরানো, পানিতে ডুবানো, প্রহার করাসহ নানা ঘটনার কথা জেনে কেবল লজ্জিত হতে হয়। এ অপমানজনক অবস্থা থেকে শিক্ষকদের মুক্তি বুঝি নেই। অবশ্য শিক্ষকদের মধ্যেও কিছুসংখ্যক রয়েছেন, যারা অপ/রাজনীতিসহ নানা রকমের অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত। তারাও শিক্ষার মান ও শিক্ষকদের সম্মান নষ্টের জন্য দায়ী।

শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষকের সংখ্যা এসব বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। আর একমুখী শিক্ষার পরিবর্তে নানামুখী জগাখিচুড়িময় শিক্ষার ধারায় এর থেকে বেশি কিছু আশা করাও অনুচিত। শহর-গ্রামের অব্যাহত বৈষম্যের কারণে দেখা যায় শহরের শিক্ষার্থীরা এসএসসি ও এইচএসসিতে তুলনামূলক ভালো ফলাফল করে। কিন্তু উচ্চশিক্ষার স্তরে এসে তারা সেই ধারা আর ধরে রাখতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বরং গ্রামের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে ভালো ফলাফল করে। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও সচিবালয়ে গ্রামে এসএসসি পাশ করা শিক্ষক/সচিবের সংখ্যা বেশি। বিদ্যমান বৈষম্যের অবসানে পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রশ্নফাঁস আরেকটি বড় ধরনের সমস্যা। প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিসিএস, মেডিকেলসহ প্রায় সব পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস না হওয়া (বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা এ ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকভাবে ব্যতিক্রম) এখন রীতিমতো অবাক করা খবর। হাজার থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকায় প্রশ্ন বিক্রির কথা শোনা যায়, যা একেবারেই অমূলক নয়। আগে কেবল চাকরির জন্য আর্থিক লেনদেনের কথা শোনা গেলেও এখন প্রশ্ন, চাকরি এবং বদলির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

নিত্যপরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে শিক্ষা নিয়ে, পরিকল্পনার অভাব নেই, অথচ বাজেট কমছে; গুরুত্ব হারাচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা ও অনুকূল-নিরাপদ ক্যাম্পাস। যত্রতত্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুরুত্ব হারাচ্ছে। কারণ, পাশ করে বেকার হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। যেখানে প্রধান চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগ্য শিক্ষক দেওয়া কঠিন, সেখানে এত এত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উপযুক্ত শিক্ষক কোথায়!

শিক্ষার আরেকটি সংকট হলো শিক্ষাঙ্গনে নিরাপত্তা। ছাত্ররাজনীতি এবং নারী নির্যাতন এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা এবং বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে নিরাপদবোধ করে না। কিছুদিন পরপর সংঘর্ষ, হতাহত হওয়ার ঘটনা, নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং যৌন সহিংসতার খবর পাওয়া যায়। যেহেতু যথাযথ বিচারের নজির কম, তাই যারা সংঘাত ও সহিংসতার শিকার, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের বদলে খুব অসহায় বোধ করে।

আশির দশকে শুরু হওয়া সেশনজটের কথা বলাই বাহুল্য। এটি আজও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য; যেটি দূর করার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করলেও শিক্ষকদের দায়বদ্ধতার জায়গাটা দুর্বল বিধায়, সেশনজটমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ে তোলা কঠিন হয়ে পড়েছে। অবশ্য করোনা মহামারির অবসান ঘটলেও শিক্ষাঙ্গনে এটি রেখে গেছে বড় ধরনের ক্ষত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ, কর্মসংস্থানের সুযোগ ইত্যাদি বিবেচনায় বর্তমানে শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশের মাঝে, বিশেষ করে যাদের আর্থিক সংগতি রয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়মুখী প্রবণতা লক্ষণীয়।

এই আলোচনা থেকে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার নানাবিধ সংকট সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া গেল। যে শিক্ষাব্যবস্থায় গ্রাম-শহর, নারী-পুরুষ, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষার মাঝে অব্যাহত ব্যবধান বা বৈষম্য সৃষ্টি করে, কর্মসংস্থান ও ব্যক্তি উদ্যোগ অপেক্ষা বেকারত্ব সৃষ্টি করে মোট জনশক্তির প্রায় ৫ শতাংশ, (যা উচ্চশিক্ষিতদের মাঝে বেশি), শিক্ষিতদের নিজ সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, গ্রামের শিক্ষিতরা গ্রাম বা শিকড়হীন হয়ে যায়, দেশ সেবার মনোভাবসম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়ার জন্য শিক্ষাব্যবস্থার আশু আমূল সংস্কার অতি আবশ্যক। তাছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রেখে এবং মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীদের সন্ত্রস্ত রেখে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ কিংবা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুযোগ গ্রহণ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা নয়; বিদ্যমান সংকটগুলো নিরসনকল্পে নিত্যপরিবর্তনশীল শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে বাস্তবসম্মত, বিজ্ঞানভিত্তিক ও একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন অপরিহার্য। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এটাই জাতির প্রত্যাশা এবং সময়ের দাবি।

ড. আলা উদ্দিন : অধ্যাপক ও সাবেক সভাপতি, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

alactg@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম