পুলিশ সংস্কার নিয়ে কিছু কথা
এরশাদুল আলম প্রিন্স
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পুলিশ রাষ্ট্রের এক অপরিহার্য বাহিনী। পুলিশ ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্র চলতে পারে না। দেশে আজ পুলিশ বাহিনীর যে অবস্থা, তার জন্য যৌথভাবে বিগত সরকার ও পুলিশ বাহিনী উভয়ই দায়ী। সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য পুলিশকে ব্যবহার করেছে আর পুলিশও তার পেশাদারত্বের বাইরে গিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। এর বিনিময়ে অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নানা সুবিধাও বাগিয়ে নিয়েছে। বিগত সরকারের আমলে পুলিশের অনেকেই বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছে। এ কারণে আমরা শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগের আগেই বেনজীরকে দেশ ত্যাগ করতে শুনেছি। আরও অনেকে পলাতক রয়েছেন।
বিগত সরকারের আমলে পুলিশ বাহিনী তার পেশাদারত্ব হারিয়ে সরকারদলীয় এক বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। বিরোধী রাজনৈতিক দলকে দমন করতে গিয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার নতুন নয়। ব্রিটিশ আমল থেকেই পুলিশের এ রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবহার শুরু হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটেই প্রণয়ন করা হয় পুলিশ আইন। ব্রিটিশ সরকার এদেশ ও এদেশের মানুষের ওপর শাসন ও শোষণ নির্বিঘ্ন করতেই পুলিশ আইন তৈরি করে। সেই থেকে ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সব সরকারই পুলিশকে সেভাবেই ব্যবহার করেছে।
সবশেষ গত অভ্যুত্থানে পুলিশের ভূমিকা আমরা সবাই জানি। সরকারের আদেশে পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্যই গণহত্যায় জড়িয়ে পড়েছিল। দেশের একটি বেসামরিক বাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে এভাবে অস্ত্র ধারণ করতে পারে না। এটি নজিরবিহীন ঘটনা। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে। প্রয়োজনে তারা জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য প্রচলিত নন-লিথাল অস্ত্রও ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু উন্মুক্তভাবে গুলি চালিয়ে এভাবে মানুষ হত্যা করা পুলিশের কাজ নয়। অপেশাদারি মনোভাবের কারণেই পুলিশ এভাবে তার কার্যপরিধির বাইরে গিয়ে সরকারের পক্ষে ও জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র চালনা করতে পেরেছে। বিগত ১৫ বছরে পুলিশের ভূমিকার খতিয়ান অতিদীর্ঘ-যার বিবরণ এখানে সম্ভব নয়।
তাই কথা উঠেছে পুলিশের সংস্কার নিয়ে। এ লক্ষ্যে কাজও শুরু হয়েছে। সরকার পুলিশ সংস্কার নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে। পুলিশকে একটি জনবান্ধব ও যুগোপযোগী বাহিনী হিসাবে গড়ে তোলা আজ সময়ের দাবি। সংস্কারে পুলিশে জনবল নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া পুলিশের প্রশিক্ষণে সামাজিক, মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বিষয়গুলোকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। সব সংস্কার আইন দিয়ে হয় না। আমরা সংস্কারে শুধু আইনের ওপরই গুরুত্ব দিই। কিন্তু সংস্কারের মূল বিষয় হচ্ছে মূল্যবোধ।
বিগত সরকারের আমলে পুলিশ নানাভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে তাদের ভূমিকার জন্য পুলিশের মনোবল এখন একেবারে ভেঙে গেছে। পুলিশ একটি বেসামরিক বাহিনী, যারা জনগণের পাশে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে। জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অপরাধী যাতে পুলিশকে ভয় পায় সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি পুলিশকে যাতে জনগণ বন্ধু ভাবে, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। এ দুই অবস্থানের মধ্য থেকে পুলিশকে কাজ করতে হয়।
পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে আনা ও তাদেরকে একটি জনবান্ধব শৃঙ্খলা বাহিনী হিসাবে গড়ে তোলা এখন সবচেয়ে বড় কাজ। অভ্যুত্থানের পর অনেক পুলিশ এখনো কাজে যোগ দেয়নি। তাদের সেসব শূন্যপদে অতিদ্রুত নিয়োগ দিতে হবে। ইতোমধ্যে লোকবল নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
যে কোনো সংস্কারের জন্যই সময় অপরিহার্য। সেখানে রাষ্ট্র সংস্কার তো আরও ব্যাপক বিষয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর অসহযোগিতামূলক মনোভাব সরকারের জন্য সংস্কারের কাজটিকে আরও কঠিন করে দেবে। তার ওপর পরাজিত শক্তি নানাভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে। তবে সংস্কারের জন্য সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। তাদের মধ্যে পুলিশ প্রশাসনে সংস্কার অন্যতম। সরকার এ লক্ষ্যে একটি কমিশন করেছে, যার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব দিয়েছেন সফর রাজ হোসেনকে। তিনি এর আগে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র সচিব ছিলেন। এ কমিশনের অধিকাংশ সদস্যই সাবেক আমলা। পুলিশ সংস্কারের মূল বিষয়টি হচ্ছে জনপ্রশাসন থেকে পুলিশ প্রশাসনকে স্বাধীন ও পৃথক করা। কারণ, সরকারের পক্ষে কাজ করাই আমলাদের কাজ। পুলিশ আমলাদের সাহায্য করবে। কিন্তু পুলিশ আমলাদের অধীনে থাকবে, এটা কাম্য নয়। স্থানীয় প্রশাসনে আমলারা জেলার আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু পুলিশ কাজ করবে তার ঊর্ধ্বতনের অধীনে। সেটা ঢাকায় হোক বা ঢাকার বাইরে। প্রশাসন বা সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার পুলিশ হতে পারে না। আমলারা পুলিশ সংস্কার চাইবে, এটা সহসা হওয়ার কথা নয়। তাই কমিশনে পুলিশের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আধিক্য থাকলেই ভালো হতো। ২০০৭ সালে যে কমিটি করা হয়, সেখানে পুলিশ সদস্যই বেশি ছিলেন। কিন্তু এ কমিশনে শুধু দুজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আর চারজন আমলা। সরকার যদি মনে করে, এদের দ্বারা স্বাধীন পুলিশ কমিশন বা পুলিশ সংস্কারের প্রস্তাব আসা সম্ভব, সেটি ভিন্ন কথা। কিন্তু সাধারণভাবে এখানে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাদের থাকাই বেশি যুক্তিযুক্ত ছিল।
স্মর্তব্য, ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারও পুলিশ সংস্কার নিয়ে একটি কমিটি করে। ১৫ সদস্যের ওই কমিটিতে ১২ জনই ছিলেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা। ২০০৭ সালের অধ্যাদেশটি আলোর মুখ দেখেনি। কারণ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক পর্যালোচনা কমিটির নানা পর্যালোচনা ও সুপারিশের ভারে সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।
সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক। তারপরও আশা, এ সরকার পুলিশ সংস্কারের একটি ভালো প্রস্তাব জাতিকে উপহার দিতে পারবে। দেশের পুলিশ সংস্কার হলে অনেক কিছু আপনাআপনি সংস্কার হয়ে যাবে। তবে একটি বাহিনীর সংস্কার এত সহজ কাজ নয়। দীর্ঘদিন ধরে যে সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে একটি বাহিনী ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে, রাতারাতি তার পরিবর্তন সম্ভব নয়। আইন দিয়ে একটি সংস্থাকে কিছুটা স্বাধীনতা দেওয়া যেতে পারে; কিন্তু তার সংস্কৃতি বা আচরণ রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। দুদিন আগেও যে মানুষটি উৎকোচ গ্রহণ করত, দুদিন পরে আইন যতই কঠোর হোক না কেন, ঘুস খাওয়ার জন্য সে বিকল্প পথ খুঁজবেই। কিন্তু তারপরও তো আমাদের আইন ও বিধি পরিবর্তন করতে হবে। পাশাপাশি সংস্কৃতি ও আচরণবিধির পরিবর্তনের চেষ্টাও চালিয়ে যেতে হবে। আঁধার বলে তো আর পথ চলা বন্ধ করা যায় না।
বর্তমান কমিশনের কাজ অনেকটাই সহজ করে দিয়ে গেছে আগের কমিটি। একটা খসড়া প্রণয়ন করাই আছে। সেটার কিছু প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন করলেই কাজটি অনেকটা এগিয়ে যাবে। এছাড়া অন্যান্য দেশের পুলিশ কীভাবে কাজ করে সেটিও দেখা দরকার। অন্যান্য দেশের পুলিশ প্রশাসনের ভালো রেফারেন্স আমরা পর্যালোচনা করতে পারি।
রাষ্ট্রের সব জরুরি কাজই পুলিশের ওপর নির্ভরশীল। দেশের বিচার ব্যবস্থার এক অপরিহার্য অংশ হচ্ছে পুলিশ। প্রস্তাবিত সংশোধনীর সময় বিদ্যমান ফৌজদারি বিধি ও দণ্ডবিধির কথাও মনে রাখতে হবে। ফৌজদারি আইন ও দণ্ডবিধির পরিবর্তন যেহেতু আরও ব্যাপক ও সময়সাপেক্ষ তাই আপাতত শুধু পুলিশ আইন ও বিধিরই সংশোধন হবে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু সে সংশোধন বা সংস্কার যাতে বিদ্যমান অন্যান্য আইনের প্রয়োগকে বাধাগ্রস্ত না করে সেদিকেও নজর থাকতে হবে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা, অপরাধ ও অপরাধীদের নিয়ে পুলিশ কাজ করে। এ কাজ করতে গিয়ে পুলিশের কোনো কোনো সদস্য নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আইনে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের ব্যবস্থা থাকতে হবে ও তার ভিত্তিতে পুলিশের বিচারও হতে হবে। পুলিশের অপরাধ তদন্তের কাজ পুলিশকে দিয়ে করালে সেখানে সঠিক তদন্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। পুলিশের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ সাধারণ নাগরিকের অপরাধের অভিযোগের চেয়েও গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে হবে। সরল মনে দায় মোচনের অজুহাতে পুলিশের অপরাধ এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। পুলিশের অপরাধের বিরুদ্ধে শুধু প্রশাসনিক বা বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণই যথেষ্ট নয়।
পুলিশের ওপর রাজনৈতিক খবরদারির সুযোগ বন্ধ করা জরুরি। একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন করার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। কমিশনের পৃথক সচিবালয়ও থাকা দরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পুলিশ থাকলেও পুলিশ কাজ করবে তার কর্মপরিধি ও গাইডলাইন অনুযায়ী; শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আদেশে নয়। কোনো দল বা ব্যক্তির রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য পুলিশ কাজ করবে না। এটি নিশ্চিত করতে হবে।
পুলিশ কমিশন হতে হবে স্বাধীন। এ কমিশনে সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যদের সমান অংশগ্রহণ জরুরি। এছাড়া নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিও থাকতে হবে। সার্বিকভাবে পুলিশ কাজ করবে কমিশনের অধীনে। নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি থাকবে কমিশনের অধীনে। দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা ইত্যাদির ভিত্তিতে পুলিশের বদলি ও পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে।
বিগত সরকারের আমলে দেখা গেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার নির্দেশে মামলা নেওয়া হতো বা নেওয়া হতো না। কাজেই, সরকার বা কোনো ব্যক্তির নির্দেশে যাতে পুলিশ কাজ না করে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
পুলিশ সংস্কারে নারী ও শিশুদের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। তাদের জন্য পৃথক থানার দরকার নেই। তবে পৃথক অফিসার ও বিভাগ থাকা জরুরি। নারীরাও যেন নির্ভয়ে তাদের সমস্যা নিয়ে থানায় যেতে পারে সে ব্যবস্থা থাকা চাই। থানাগুলো যেন হয় জনগণের প্রাথমিক আশ্রয়স্থল। পুলিশ যেন হয়ে ওঠে জনগণের প্রথম ভরসাস্থল। পুলিশের অর্জন অনেক, ত্যাগও অনেক। পাশাপাশি গ্লানিও কম নয়। অতীতের সেই গ্লানি মুছে গিয়ে পুলিশ হয়ে উঠুক জনগণের ভাই-বন্ধু। সবাই মিলে দেশটাকে নতুনভাবে গড়তে চাই।
এরশাদুল আলম প্রিন্স : আইনজীবী, প্রাবন্ধিক