একজন প্রাথমিক শিক্ষকই পারেন জাতিকে বদলে দিতে
কমোডোর (অব.) জসীম উদ্দীন ভূঁইয়া
প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শিরোনাম দেখে সবারই অবাক হওয়ার কথা, দেশে এত বড় বড় কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকতে একজন সামান্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কীভাবে পারবেন একটি জাতিকে বদলাতে, কীভাবে পারেন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারণ করতে!
শিক্ষা খাত এমন একটি খাত, যা সরাসরি অন্য যে কোনো খাতকে স্পর্শ করে। ছোটবেলা থেকেই আমরা পড়ে এসেছি শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। মানব শরীরের এত সব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষাকে মেরুদণ্ডের সঙ্গে তুলনা করার বিশেষ কারণ রয়েছে। ছোট ছোট কশেরিকা যুক্ত হয়ে গঠিত মেরুদণ্ড যেমন আমাদের পুরো শরীরের নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য রক্ষা করে, ঠিক তেমনি শিক্ষা এমন একটি উপাদান, যা একটি রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরের প্রত্যেক মানুষের তথা পুরো দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। আর সেই গুরুদায়িত্ব পালন করেন একজন শিক্ষক। একজন শিক্ষকের হাত ধরেই একটি রাষ্ট্রের সব সেক্টরের মানুষ, যেমন-সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, ব্যবসায়ী রাজনীতিক বেরিয়ে আসে।
আমাদের দেশে শিক্ষার স্তরকে মোটামুটি চারটি স্তরে ভাগ করা যায়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক। দেশের প্রতিটি সেক্টরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতির কালো ছায়া ঢুকে গেছে, তা রক্ষায় শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
২.
সংস্কার শুরু করতে হবে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। গত বছর আমি গিয়েছিলাম আমার গ্রামের সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, যেখানে আমার একাডেমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছে টিনের একটি ভাঙা ঘরে। শৈশবের দুরন্ত সময়গুলো কেটেছে সেই বিদ্যালয়ের মাঠে। শৈশবের সেই মধুর স্মৃতিগুলো ভেবে দু’চোখ ছলছল করছিল আমার। আমার সেই ভাঙা টিনের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি এখন একটি সুন্দর ভবন। অথচ সেখানে নেই তেমন কোলাহল, হৈ-হুল্লোড়, মাঠে ছোটাছুটির দৃশ্য। হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী পুরো ভবনজুড়ে। বিষয়টি অনেক অবাক করে দিল আমাকে, পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, এলাকার খেটে খাওয়া মানুষ, যেমন-রিকশাচালক, দিনমজুর থেকে শুরু করে প্রায় মানুষই তাদের ছেলেমেয়েকে পাশের একটি নন-এমপিওভুক্ত মাদ্রাসায় মাসিক ৩০০-৫০০ টাকা বেতনে ভর্তি করে দিয়েছে। অনেককে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা পাশেই এত বড় একটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকতে টাকা দিয়ে মাদ্রাসায় কেন পড়াচ্ছেন, তাদের উত্তর ছিল : সরকারি স্কুলে তো এখন আর আগের মতো পড়ালেখা হয় না, বাচ্চারা নিয়মকানুন শেখে না। ঘটনাটি বেশ পীড়া দিল আমাকে।
৩.
একটি শিশুর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম পর্যায় হলো প্রাথমিক শিক্ষা, আর তা শুরু হয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। একটি শিশু হলো নরম কাদামাটির মতো, তাকে ছোটবেলায় যেভাবে গড়া হবে, সেভাবেই সে পরবর্তীকালে বেড়ে উঠবে।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, উন্নত দেশগুলোতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। যেমন, আমরা যদি জাপানিদের দিকে দেখি, তাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার চেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া অনেক কঠিন। তারা জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার গঠনের ভার যার-তার হাতে তুলে দেন না, তাই স্নাতক পাশের পর যারা শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান, তাদের আলাদা একটি বিশেষ কোর্সে ভর্তি হতে হয়। সেই কোর্সে একজন শিক্ষক হতে ইচ্ছুক প্রার্থীকে শিক্ষার্থীর নৈতিক শিক্ষা থেকে শুরু করে শিক্ষক হিসাবে জাতি গঠনে তাদের ভূমিকা কেমন হবে, তার পাঠদান করানো হয় এবং সেই কোর্সে ভালোভাবে পাশ করতে পারলেই কেবল প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার জন্য আবেদন করা যায়।
৪.
একটি যুদ্ধবিধ্বংসী দেশ ছিল জাপান, যেখানে আজ তাদের অপরাধের কোঠা প্রায় শূন্য, যার মূলে রয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। তাদের বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষকরা সবার আগে বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকেন, যাতে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী ছোটবেলা থেকেই শিষ্টাচার, নিয়মানুবর্তিতা সর্বোপরি একটি শৃঙ্খলার মধ্যে বড় হয়। সেখানে তারা একে অপরকে সহযোগিতা, মনুষ্যত্ববোধ, ত্যাগ, শৃঙ্খলা, সততা, বিনয়-শিষ্টাচার, সৌন্দর্যবোধ ও নৈতিক চেতনার শিক্ষা নেয়। আত্মিক বিকাশের এ শিক্ষাই সেদেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য, যার ফলাফল আজকের জাপান। সেখানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থান এর বিপরীত।
আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা দিতে পারে স্নাতক পাশ যে কেউ, বিভিন্ন ধরনের কোটাসহ মাত্র ১০০ মার্কের একটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তারা। তার ওপর থাকে প্রশ্নফাঁস, ডিভাইস পার্টি, ১২-১৩ লাখ টাকায় চাকরি পাওয়ার চুক্তিপত্র, যা সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমগুলোর দিকে তাকালেই চোখে পড়ে। মন চাইল-একটি সার্টিফিকেট আছে, টাকা আছে, এলাকার কোনো এক দালালকে ধরলাম, কয়েক লাখ টাকা দিলাম; ব্যাস, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে গেলাম। এরকম ঘটনা অহরহ দেখা যায় এখন।
৫.
শিক্ষকতা একটি ফ্যাশন, একটি আর্ট। শিক্ষকতা পেশায় মেধার পাশাপাশি নৈতিকতা, কমিউনিকেশন স্কিল, কোনো বিষয় বোঝানোর দক্ষতা কেমন-এগুলো যাচাইয়ের প্রয়োজন অত্যধিক। একটি শিশুমনের বিকাশ ঘটে প্রাথমিক শিক্ষায়, প্রাথমিক পর্যায়ই একজন শিশুর মধ্যে সত্যবাদিতা, সততা, নৈতিকতা, সাহসিকতা, দেশপ্রেমের বীজ বোনার উপযুক্ত সময়, যে বীজটা ধীরে ধীরে তার মধ্যে অঙ্কুরিত হয়ে পরবর্তীকালে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতকে গিয়ে যথাযথ যত্নে বৃক্ষে রূপান্তরিত হয়।
যারা অনৈতিকভাবে শিক্ষকের আসনে বসছেন, তারা নিজেরাই তো দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত; তাহলে তারা কীভাবে তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করবেন? তারা কীভাবে একটি শিশুর মনে দেশপ্রেম, সততা, সত্যবাদিতা, শৃঙ্খলাসহ নৈতিকতার বীজ বপন করবেন? একজন প্রাথমিক শিক্ষকের মূল দায়িত্ব একজন ছাত্রকে নৈতিকতার সঙ্গে ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেওয়া।
৬.
শিক্ষক নিজেই যদি নৈতিকতার ঊর্ধ্বে থাকেন, তাহলে তারা যে তাদের মূল দায়িত্ব পালনে উদাসীন হবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। যার ফলাফল আজকের এই বাংলাদেশ; যেখানে জিপিএ-৫-এর অভাব নেই; কিন্তু অভাব একজন ভালো, নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষের। একটি সুদৃশ্য মজবুত জাহাজের নিচতলায় ছিদ্র রেখে উপরের তলার মানুষ বিশেষজ্ঞ দিয়ে নিচতলার কথা ভুলে গিয়ে উপরের তলাগুলো আরও বেশি সুন্দর করার কাজ করছেন, উপভোগ করছেন, ভাবছেন তারা তো সেইফ, স্বচ্ছন্দে গন্তব্যে পৌঁছাবেন। কিন্তু আদতে কি সম্ভব নিচতলায় ছিদ্র রেখে উপরের তলাকে ডুবানোর হাত থেকে রক্ষা করা?
ভবিষ্যৎ কর্ণধার যদি সঠিক মানুষ হয়ে না ওঠে, তাহলে একটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কী? সেই ভবিষ্যৎ কর্ণধার গড়ার কারিগররাই যদি হয় ত্রুটিযুক্ত, তাহলে ত্রুটিমুক্ত জাতি কীভাবে গড়ে উঠবে? তাই সবার আগে শিক্ষা খাতে সংস্কার প্রয়োজন; আর তার জন্য ভিত্তিটাকে সবার আগে মজবুত করতে হবে।
৭.
যাকে-তাকে ভবিষ্যৎ কর্ণধার গঠনের গুরুদায়িত্ব না দিয়ে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে জাপানিদের মতো পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রতিটি উপজেলা বা থানায় শিক্ষা কর্মকর্তার অধীনে অথবা তৃতীয় কোনো পক্ষের অধীনে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হোক, যার কাজ হবে প্রতিটি থানা ও উপজেলার বিদ্যালয়গুলো প্রতি মাসে তদারকি করা, প্রত্যেক প্রধান শিক্ষক তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন কিনা, ছাত্রছাত্রীদের কতটা নৈতিক পরিবর্তন ঘটছে-এসব দিকে লক্ষ রাখা এবং প্রতিমাসের একটি পারফরম্যান্স রিপোর্ট জেলা পর্যায়ে প্রেরণ করা। কোনো বিদ্যালয়ের উন্নতি না ঘটলে সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে যথাযথ জবাবদিহি করতে হবে এবং প্রয়োজনে সাময়িক বরখাস্ত করা হবে। আবার সেই কমিটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে জেলা পর্যায় থেকে এবং একই আইন ও জবাবদিহিতা থাকবে থানা বা উপজেলার কমিটির ক্ষেত্রেও। এভাবেই প্রতিটি উপজেলা, থানা থেকে শুরু করে জেলা, বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সর্বোপরি পুরো জাতিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে প্রাথমিক থেকে স্নাতক পর্যায়ে বাঙালির বিভিন্ন বিপ্লবে সফল হওয়ার সঠিক ইতিহাস, নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তন করার পাশাপাশি সঠিক পদ্ধতিতে শিক্ষা খাতে মেরুদণ্ড গড়ার কারিগরদের দেশের সবচেয়ে নীতিমান, জ্ঞানী, সাহসী, মেধাবী মানুষ হওয়ার বিকল্প নেই।
কমোডোর (অব.) জসীম উদ্দীন ভূঁইয়া : সাবেক সহকারী নৌ বাহিনী প্রধান; উপ-উপাচার্য, বিইউপি