বাইফোকাল লেন্স
পার্বত্যের অশান্ত পরিস্থিতি কীসের আলামত?

একেএম শামসুদ্দিন
প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের জন্য সব সময়েই একটি স্পর্শকাতর অঞ্চল হিসাবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। স্বাধীনতার পর প্রায় দুই দশক ধরে পৃথক ভূমির দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সশস্ত্র তৎপরতা চলেছিল, তা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সফল সামরিক অভিযান ও সরকারের রাজনৈতিক পদক্ষেপের ফলে সে সময় দেশ রক্ষা পায়। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পাহাড়ের সশস্ত্র বিপথগামীরা অস্ত্রসমর্পণ করে সামাজিক জীবনে ফিরে আসে। সে সময় একটি শান্তিচুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। সে চুক্তির বেশকিছু বিষয় বাস্তবায়ন হলেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে ভূমি সমস্যা অন্যতম। ভূমি জরিপের মাধ্যমে যথাযথ যাচাই করে জায়গা-জমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করা এবং সেখানকার জনগণের ভূমি মালিকানা চূড়ান্ত করে তাদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার কাজটি আজও অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। এ চুক্তির অন্যান্য ধারা নিয়েও বিতর্ক আছে। কিছু কিছু ধারা বৈষম্যমূলকও। যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামের যে কেউ সমতল ভূমিতে জমি ক্রয় করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারলেও সমতল ভূমির কেউ পার্বত্য চট্টগ্রামে জমি ক্রয় করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারবেন না। চুক্তির এ ধারাটি বাংলাদেশের সংবিধানবিরোধী। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এমন বৈষম্যমূলক ধারা আছে। এ ধরনের কিছু বিতর্কিত বিষয় থাকায় শান্তিচুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের এক বছরের মধ্যেই এ চুক্তির বিরোধিতা করে গঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফ নামে উপজাতীয় একটি সশস্ত্র দল। চুক্তির পক্ষের জনসংহতি সমিতি বা জেএসএসের সঙ্গে ইউপিডিএফের রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হয় তখন থেকেই। এ রক্তক্ষয়ী সংঘাতে দুই দলের পাঁচ শতাধিকেরও বেশি নেতাকর্মী নিহত হয়। ব্যক্তিস্বার্থ ও ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে এ দুই দলের নেতাকর্মীদের ভেতর অন্তর্দ্বন্দ্বও শুরু হয়ে যায়। যার জেরে ২০১০ সালে জেএসএস ভেঙে গঠিত হয় জেএসএস (লারমা) নামের নতুন দল। এরপরেই শুরু হয় ত্রিমুখী সংঘর্ষ। পরবর্তী পাঁচ বছরে এ তিন দলের আরও প্রায় চার শতাধিক নেতাকর্মী নিহত হয়েছে। মতপার্থক্য ও দ্বন্দ্বের এখানেই শেষ নয়। ২০১৭ সালে ইউপিডিএফ ভেঙে ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’ নামের নতুন আরেকটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
আলাদা হওয়ার পর ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দল জেএসএস (লারমা)-এর সঙ্গে জোট বেঁধে মূল ইউপিডিএফ এবং জেএসএস উভয় দলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে দেয়। ফলে পাহাড়ে আরও সংঘাত শুরু হয়ে যায়। এবার ইউপিডিএফ মূল দল ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলকে সহায়তার জন্য জেএসএস (লারমা)কে দোষারোপ করে। ফলে, ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয় চতুর্মুখী সংঘাত, যা আজও চলমান।
পাহাড়ের অনেকেই মনে করেন, শান্তিচুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি বলে শান্তি ফিরে আসছে না। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, চুক্তির অনেক বিষয় বাস্তবায়ন হলেও গুরুত্বপূর্ণ চারটি বিষয় এখনো অমীমাংসিত থাকায় একটি স্বার্থান্বেষী মহল পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ চারটি বিষয় হলো, ভূমি সমস্যা, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি, পাহাড়ি জনগণের মধ্যে বিভেদ এবং বাঙালি-পাহাড়িদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভূমি সমস্যা। পার্বত্য চট্টগ্রামে জমির মালিকানা নিয়ে অনেক সমস্যা আছে। এসব জমির মালিকানার বিষয়ে সেই ব্রিটিশ আমলে বিশেষ কিছু আইন করা হয়েছিল। সেই আইন অনুসারে ভূমির মালিক হবেন প্রথাগতভাবে সেখানে বসবাসরত পাহাড়ি জনগণ। এসব ভূমির মালিকানার কোনো দলিলপত্র নেই তাদের কাছে। এ আইনে পাহাড়ের আদিবাসী বাঙালিদের ভূমি পাওয়ার বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু বলা ছিল না। পরবর্তীকালে সমতল ভূমি থেকে পাহাড়ে গিয়ে বাঙালিরা বসবাস শুরু করলে ভূমি নিয়ে আরও বেশি বিরোধ শুরু হয়।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে শান্তিচুক্তিতেও এ বাঙালিদের বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। চুক্তিতে এমন কিছু ধারা অন্তর্ভুক্ত আছে, যা নাগরিক হিসাবে বাঙালিদের মৌলিক অধিকার হরণ করেছে। পাহাড়ে বাঙালিদের জমি ক্রয় ও বসতি স্থাপনে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে, যা সংবিধানপ্রদত্ত নাগরিক মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগ ‘মৌলিক অধিকার’-এর ৩৬ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘আইন মোতাবেক দেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, এর যে কোনো স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে’। অপরদিকে ২৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন করা যাবে না। আর যদি করা হয়, তবে তা স্বতঃসিদ্ধভাবে বাতিল হয়ে যাবে। মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি সব আইন সাংবিধানিকভাবে অবৈধ বলে বিবেচিত হবে।’ এ ক্ষেত্রে শান্তিচুক্তিতে পাহাড়ে বসবাস এবং বসতি স্থাপন থেকে বাঙালিদের বঞ্চিত করে সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে। এ ধরনের কিছু মৌলিক বিষয় অমীমাংসিত থাকায় শান্তিচুক্তি অনুযায়ী, দীর্ঘদিন আগে ভূমি কমিশন গঠন করে এতদসংক্রান্ত আইন প্রণয়ন এবং সে আইন নিয়ে পালটাপালটি তর্ক-বিতর্কের পর পুনঃসংশোধন করেও ভূমি সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়নি।
শান্তিচুক্তি অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাক্যাম্প কমিয়ে সেনানিবাসের আদলে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় সীমিতসংখ্যক সেনাছাউনি রাখার কথা। নানাবিধ কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল জেএসএসের সঙ্গে। তখন মনে করা হয়েছিল, জেএসএস সমগ্র পার্বত্যাঞ্চলের নাগরিকদের পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই এর বিরুদ্ধে যে সশস্ত্র প্রতিপক্ষ দাঁড়িয়ে যাবে, তা কেউ ধারণা করেনি। হঠাৎ করেই ‘ইউপিডিএফ’ নামক একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল। পাহাড়ের অনেকেই বলে থাকেন, এ সংগঠনটি সরকারের সৃষ্টি। বিষয়টি তেমন নয়। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে নষ্ট করার জন্য ভারত একসময় যেমন নিজের ভূমিতে আশ্রয়-প্রশ্রয়, অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খুলে দিয়ে ‘শান্তিবাহিনী’ সৃষ্টি করেছিল, সেই ভারতের হাত ধরেই ইউপিডিএফ-এরও জন্ম। ইউপিডিএফ সৃষ্টি করেই তারা বসে থাকেননি, এ সংগঠন সৃষ্টির পেছনে সরকারের হাত আছে এমন মিথ্যা ধারণা খুব সূক্ষ্মভাবে পাহাড়ি জনগণের মনে গেঁথে দেওয়ার কাজটিও তখন সুসম্পন্ন করেছিল। পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসুক অথবা পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যটনের অপার সম্ভাবনা নিয়ে সামনের এগিয়ে যাক, ভারত তা কখনো চায়নি। কারণ, এ অঞ্চলের মানুষের উন্নত জীবনযাপন মানে মণিপুর, নাগাল্যান্ড কিংবা মিজোরামের মতো পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলোর দীর্ঘকালের সশস্ত্র সংগ্রামকে আরও বেশি উৎসাহিত করা; এ ভয় তাদের সবসময়েই ছিল এবং এখনো আছে। কাজেই তারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে সার্বক্ষণিক অশান্ত রাখার কূটকৌশল আঁটে; যা তাদের জন্য মঙ্গলজনক। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে শান্তিবাহিনীর মতো ইউপিডিএফকেও অস্ত্রের জোগান দিয়ে পাহাড়ে সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। এ অবস্থায় চুক্তি অনুযায়ী, সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বরং সেনা উপস্থিতির কারণে ওই অঞ্চলে অবাধ চলাফেরায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণ থাকায় আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে আরও বেশি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়েছে। তবুও একশ্রেণির পাহাড়ি নেতা প্রচার করে বেড়াচ্ছেন, পাহাড়ে সেনাশাসন চালু রাখার জন্যই সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হচ্ছে না, যার সঙ্গে বাস্তবতার খুব কমই মিল আছে।
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, পাহাড়ি জনগণের মধ্যে বিভেদ। আগেই বলেছি, শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর এযাবৎ আঞ্চলিক দলগুলো নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়। এ আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, চাঁদা আদায়, ভাগবাঁটোয়ারাকেই সংঘাত-হানাহানির মূল কারণ বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দা, নাগরিক সমাজ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতারা। এসব অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও নেতাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিজেদের মধ্যে ফাটলের সৃষ্টি করেছে, যা চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাহাড়ি অনেক নেতা দাবি করেন, চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে মানুষের ভেতর হতাশা বেড়েছে, ধৈর্যহারা হয়ে যার যার স্বার্থ নিয়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়েছে। কথাগুলো যে পাহাড়ি নেতাদের মুখরক্ষার চেষ্টা, তাতে সন্দেহ নেই। যে জেএসএস শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছে, স্বার্থের দ্বন্দ্বে সেই দলের অনেক সিনিয়র নেতাই এখন দল ভেঙে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছেন। আঞ্চলিক দলগুলোর এ সংঘাতের পেছনে আদর্শিক কোনো কারণ নেই। আসল কাজ রেখে স্বার্থ ও আধিপত্য বিস্তারই এখন তাদের মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাঙালি ও পাহাড়ি জনগণের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্ত পরিস্থিতির জন্য দায়ী। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর একের পর এক ইস্যু নিয়ে দেশকে অস্থির করে তোলার শুরুতেই অনুমান করা হয়েছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামকেও অশান্ত করে তোলা হবে। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাঙালি ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরাজমান অবিশ্বাস ও আস্থার ঘাটতিকে কাজে লাগানো হয়েছে। প্রথমে মোটরসাইকেল চুরির ঘটনাকে পুঁজি করে সব পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু কি তাই! এ ক্ষেত্রে অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে পাহাড়ি নারীদের ব্যবহার করা হয়েছে। পাহাড়ি নারীরা দায়িত্বরত সেনা ও বিজিবি সদস্যদের প্রকাশ্যে লাঠির আঘাত করে তাদের ওপর চড়াও হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। এ দৃশ্য ফেসবুক ও ইউটিউবের বদৌলতে দেশবাসী দেখেছে। পাহাড়ি নারীদের এ উগ্র আচরণের আসল উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার। তারা মনে করেছিলেন, পাহাড়ি নারীদের লাঠির আঘাতে উত্তেজিত হয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা যদি কোনো অ্যাকশনে যায়, তাহলে এ ঘটনাকে আন্তর্জাতিক ইস্যু বানানো সহজ হবে। এ ধরনের কিছু হতে পারে এমন আগাম তথ্য জানা ছিল বলে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের আগে থেকেই বলে দেওয়া হয়েছিল। এজন্যই তারা ফাঁদে পা না দিয়ে সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। ফলে স্বার্থান্বেষী মহলের পরিকল্পনা মার খেয়ে যায়। তারপর, পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হতে না হতেই স্কুল শিক্ষার্থী ধর্ষণের অভিযোগ তুলে খাগড়াছড়িতে আবারও কিছু উগ্র পাহাড়ি বাঙালি এক শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করে। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের যে অভিযোগ উঠেছে, তা কি মেডিকেল টেস্টের মাধ্যমে প্রমাণ করা হয়েছে? প্রমাণিত হলেও কি তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে? এ ঘটনায় সেখানকার বাঙালিরা উত্তেজিত হলেও স্বার্থান্বেষী মহলের পরিকল্পিত ফাঁদে তারা পা দেননি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে দেশের বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে সামরিক ও রাজনৈতিক অনেক বিশ্লেষকই মনে করছেন। একটি কথা স্মরণ রাখা ভালো, গত শতাব্দীর দু’দশক ধরে ভারত শান্তিবাহিনীকে সরাসরি ও পরিপূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এ পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত রেখেছিল। এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে অনেক দেনদরবার করেও ভারতের অনিচ্ছার কারণে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করা যায়নি। অথচ, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার দেড় বছরের মাথায় সেই সমঝোতা করা সম্ভব হয়েছে। এ সময় ভারত কোনো বাধা দেয়নি। শেখ হাসিনার পতনের পর এখন আবার পাহাড়কে অশান্ত করার চেষ্টা চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছু ঘটলে যখন দিল্লিতে মিছিল বের হয়, সে দেশের ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ‘বাংলাদেশকে ভাগ করে আরেকটি দেশ গড়ার ক্ষমতা ভারতের আছে’ বলে যখন হুমকি দেয়, তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে কাদের হাত থাকতে পারে, তা অতি সহজেই অনুমান করা যায়। বাঙালি ও পাহাড়ি জনগণের ভেতর পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গায় আঘাত করতেই খাগড়াছড়িতে সংঘাত ঘটতে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে চাকমা সার্কেলের রাজা দেবাশীষ রায়ও তাই মনে করেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘সাধারণ পার্বত্যবাসী মনে করে, সেখানে সংঘাত ঘটতে দেওয়া হয়েছে।’ স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পলায়নের পর দেশের বিভিন্ন সেক্টরে একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে যেভাবে বেকায়দায় ফেলানোর চেষ্টা হচ্ছে, ঠিক একই কায়দায় পাহাড়েও একের পর এক অশান্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হবে। ষড়যন্ত্রের এ চোরাগলি সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এ বিষয়ে আরও বেশি সচেতন এবং কৌশলী হয়ে এগোতে হবে। কেননা, একের পর এক ষড়যন্ত্র করে ব্যর্থ হয়েও তারা যে তাদের চক্রান্তের জাল বিস্তার কখনো থামাবে, সেই চিন্তা করা বৃথা। তবে, সমগ্র দেশ যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, দেশের জনগণ যদি সচেতন হয়, তাহলে ষড়যন্ত্রকারী যেই হোক, তাদের সেই অশুভ পরিকল্পনা তারা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে না।
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, কলাম লেখক