Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার গণিতশাস্ত্র

Icon

মোহাম্মদ হোসেন

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাঙালির গণিত ও বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়ে হাস্যরসাত্মক কিছু কথাবার্তা প্রচলিত আছে; যা আমরা বিশ্বাস করতে চাই না বা বিপরীত মত পোষণ করি। তবে কখনো কখনো মনে হয়, এসবের কিছু বাস্তবতা হয়তো আছে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার যে আন্দোলন, তার থিমটি দেখে আমার ওই গণিত-বিজ্ঞান অজ্ঞতার ধারণাটি যেন দৃঢ়তা পাচ্ছে।

অনতিদূর অতীতে আমাদের দেশে ৩ বছরের অনার্স যা স্নাতক হিসাবে এবং ১ বছরের স্নাতকোত্তর-গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে যখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ম্যাচিং করা হতো, তখন বেশ একটা ঝক্কি-ঝামেলাই পোহাতে হতো শিক্ষার্থীদের। এসব নিয়ে আলোচনা, সভা-সেমিনার করে ৪ বছরের অনার্স অর্থাৎ স্নাতক চালু করার ফলে ম্যাচিং ঝামেলা থেকে মুক্ত হওয়া গেল। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ১৬ বছরের গ্র্যাজুয়েশনের ম্যাচিংয়ের সমস্যাটির সমাধান হলো। সবাই জানেন, এ ১৬ বছরের হিসাব হলো প্রাথমিকে ০৫ বছর, মাধ্যমিকে ০৫ বছর, উচ্চমাধ্যমিক ০২ বছর এবং স্নাতক ০৪ বছর। বর্তমান সরকারি বিধান অনুসারে ১ম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীর বয়স হবে ৬ বছর বা ৬+, যা স্বাভাবিকভাবে ৬-৭ বছরের মধ্যে ধরা হয়। তাহলে যে শিক্ষার্থী তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হবে, তার বয়স হবে ৯-১০ বছরের মধ্যে।

আমাদের পড়ালেখা এখন অনেকটাই শহরকেন্দ্রিক। ঢাকা শহরের প্রায় সব অভিভাবক, এমনকি ঢাকার বাইরের অনেক অভিভাবক ঢাকার ৭/৮টা স্কুলে তাদের সন্তানদের পড়াতে চায়। স্কুলের মানের ক্রমাবনতিক্রমে অন্যান্য স্কুলেও ছাত্রছাত্রীরা পড়ে। ওইরূপ সমমানের স্কুলে নিকট অতীতে যে ছাত্রছাত্রীরা ভর্তির জন্য প্রতিযোগিতা করতে নামত, তাদের বয়সের রেঞ্জ ৯-১২, এমনকি ১৩ বছরও হতে পারে। কিন্তু যাদের বয়স ১০ বছরের বেশি অর্থাৎ ১১/১২ বছর, তারাও ভর্তির সময় তঞ্চকতার মাধ্যমে বয়স ৯ বা ১০ বছরই দেখিয়ে জন্মসনদ বানিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেলে ভর্তি হয়ে যেত। এখানেই একজন মানুষকে জীবনে ৩-৪ বছর সময় পিছিয়ে দেওয়া হয়। এ ধরনের একটি তঞ্চকতার সঙ্গে বাবা-মা বা অভিভাবকরা জড়িয়ে থাকেন। ১২ বছরের যে শিশুটি ৩য় শ্রেণিতে ভর্তি হলো, মনে করি সব ক্লাসে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে যখন সে স্নাতক পরীক্ষা সমাপ্ত করে, তখন তার প্রকৃত বয়স হয় ২৫/২৬ বছর এবং সার্টিফিকেটের বয়স হয়তো ২৩ বা ২৪ বছর। ফলাফল বের হতে হতে হয়তো আরও ৩/৪ মাস লেগে যায়, যদিও স্নাতক পরীক্ষার্থী (appeared) ঘোষণা করে স্নাতক পর্যায়ের চাকরির জন্য, বিশেষ করে বিসিএস পরীক্ষায় আবেদন করা যায়। এরপর তিনি পাশাপাশি স্নাতকোত্তর পর্যায় পড়ালেখাও চালিয়ে যেতে পারেন। এখন যিনি ২৪ বছর বয়সে স্নাতক পর্যায়ের চাকরির আবেদন শুরু করতে পারেন, তিনি ৩০ বছর পর্যন্ত অর্থাৎ ৬ বছর ধরে চাকরির আবেদন করতে পারেন। ৬ বছরের মধ্যে অনেকেরই চাকরি হয়ে যায়। প্রথম ২/৩ বছরে স্নাতক শিক্ষাগত যোগ্যতার পর্যায়ের চাকরি না হলে তখন অনেকেই স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাশ করার পরও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের চাকরিতে আবেদন করতে শুরু করেন। এরপরও চাকরি না হলে যখন তার সার্টিফিকেটের বয়স ২৯ বছর পূর্ণ হয়, তখন তিনি মাধ্যমিক পাশের যোগ্যতার চাকরিতে আবেদন করতে শুরু করেন, যা তিনি চাইলে আরও ২৯-১৮= ১১ বছর আগেই করতে পারতেন; যা হোক, তার বয়স ৩০ বছর পূর্ণ হওয়ার শেষ দিনটিতে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বা স্নাতক যে পর্যায়ের চাকরির জন্যই তিনি আবেদন করে থাকেন না কেন, ওই আবেদনের ফলাফল নিষ্পত্তি হওয়ার জন্য আরও অন্তত ২ বছর অপেক্ষায় থাকেন। যদি তার শেষ আবেদনের ফলাফল ভালো হয়, তাহলে তিনি হয়তো কোনো অফিসের অফিস সহায়ক (যোগ্যতা স্নাতকোত্তর), নয়তো কোনো অফিসের অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, নয়তো বা প্রশাসন ক্যাডারের সহকারী কমিশনার হিসাবে চাকরিতে নিয়োগপত্র পেলেন।

তার এ সাফল্যের ফলে তিনি ব্যক্তিজীবনে, সামাজিক জীবনে এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে কী কী উপহার দিলেন তার একটি ছোট তালিকা নিুরূপ হতে পারে :

১. তিনি একজন সরকারি কর্মচারী হলেন;

২. এ সময়ে তার সার্টিফিকেটের বয়স ৩২+ এবং প্রকৃত বয়স ৩৩ বা ৩৪ বা ৩৫+ বছর হলো;

৩. তিনি বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২+ বছরের মধ্যে (৩৪-২৪) =১০ বছর পর্যন্ত একটি সরকারি চাকরির জন্য নিজে কসরত করলেন, পরিবারকে কসরত করালেন, হতাশা বৃদ্ধি করলেন, এর মধ্যে যদি বিয়ে করে থাকেন, তাহলে স্ত্রীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে যারপরনাই কসরত করালেন;

৪. কত নেতার বাড়ি, মন্ত্রীর বাড়ি ধরনা দিয়ে আত্মসম্মান খোয়ালেন;

৫. বাপের জমি বেচে কাউকে হয়তো টাকা-পয়সাও দিলেন;

৬. তাদের ২৪ বছর বয়স থেকে ৩৪ বছর বয়স পর্যন্ত একজন ব্যক্তি মানুষের জীবনে সোনালি সময় কর্মহীন, আনন্দহীন, হতাশাপূর্ণভাবে উবে গেল মহাকালের অসীমে;

৭. সামাজিক জীবনে তিনি বেকার হিসাবে চিহ্নিত হয়ে মানুষের কাছে অবজ্ঞার পাত্র হয়ে থাকলেন;

৮. ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তার সোনালি সময়ে এক অনুৎপাদনশীল উচ্ছিষ্টভোগী হয়ে থাকলেন। কেননা, এ সময় তিনি নিজের অন্ন-বস্ত্রের সংগ্রামের জন্য যতটুকু উপার্জন লাগে, তা-ও তিনি করেননি। হয় বাপেরটা, না হয় ভাইয়েরটা, না হয় শ্বশুরেরটা খেলেন। রাষ্ট্রের জিডিপিতে তিনি ঘাটতি যোগ করেছেন অর্থাৎ জিডিপিতে তার অবদান ঋণাত্মক হলো।

৯. তালিকার ৮নং দফায় উল্লিখিত বিষয়টির ক্ষয়ক্ষতির ব্যাখ্যার জন্য কিছু হিসাব ধরে নিতে হবে। মনে করি, একজন ব্যক্তি ১৬ বছর বয়সে এসএসসি পাশ করেছেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি চাকরির আবেদন করেছেন এবং ২০ বছর বয়সে তিনি অফিস সহায়কের চাকরি পেয়েছেন। বর্তমান বেতন স্কেল হিসাবে তিনি মাসে ১৭,৫০০ টাকা মোট বেতন-ভাতা পান। বিভিন্ন নিয়ম-পদ্ধতির জটিলতার স্কেল হিসাব করলে আমরা সেগুলোর মধ্যে না গিয়ে প্রতি নতুন বছরে ৫ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি ধরে আমরা তার বেতন হিসাব করে একটা ন্যূনতম আয় বের করার চেষ্টা করব। যিনি ২০ বছর বয়সে অফিস সহায়ক হয়েছেন, তার (৩৩-২০)=১৩ বছরে মোট ন্যূনতম আয় কত? আমি একটি সাধারণ পদ্ধতির অঙ্ক কষে দেখেছি, ৩৩ বছর বয়সে অফিস সহায়কের চাকরি পেয়েছেন এমন ব্যক্তি যদি ২০ বছর বয়সে ওই চাকরিতে যোগদান করতেন, তাহলে বর্তমান মূল্যে তার ১৩ বছরের আয় হতো কমপক্ষে ৪০ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এর ওপর এ সময়ে যদি সরকারি নিয়মে দুটি পে-স্কেল দেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ মূল্যে তার এ আয় ১ কোটি টাকার উপরে হতো। এর সঙ্গে চাকরির বিভিন্ন বৈধ আনুষঙ্গিক সুবিধার কথা তুললাম না। তিনি যদি দক্ষতা দেখাতে পারেন, তাহলে এই ১৩ বছরে অন্তত দুটি ঊর্ধ্ব ধাপের বেতন সুবিধা এবং একটি পদোন্নতি পাবেন। এ হলো অতি সরল অঙ্কের হিসাবে। এ ধরনের ১০ লাখ যুবকর্মী যদি ১৩ বছর ধরে ন্যূনতম উৎপাদনশীলতা স্থগিত করে একটি সবচেয়ে ছোট সরকারি চাকরির জন্য অপেক্ষা করে, তাহলে রাষ্ট্র বা সমাজের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ কোটি টাকা; ১০ লাখ জনূ১৩ বছর=১৩০ লাখ কোটি টাকা নগদে, অন্যান্য বাদ। এত গেল ৩৩ বছর বয়সে অফিস সহায়কের কথা। এছাড়া অন্যান্য উচ্চতর পদে চাকরি প্রার্থীদের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখীন হয় ব্যক্তি নিজে, পরিবার, সমাজ এবং সমন্বিত যোগফলে রাষ্ট্র।

এরপর ধরি ৩৩ বছর বয়সের যে ব্যক্তি ওই ন্যূনতম যোগ্যতার চাকরিটিও পেলেন না, তখন তিনি নতুনভাবে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে শুরু করেন। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মহিলা অধিদপ্তর বা বিভিন্ন এনজিওতে। তারপর ঋণ নিয়ে বেকারত্ব ঘোচাতে নতুন যাত্রা শুরু হয় ৩৪ বছর বা ৩৫ বছর বয়সে। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি পালন, সেলাই, অ্যাম্ব্রয়ডারি ইত্যাদি এসব সবারই জানা। কিন্তু তিনি যদি ২০ বছর বয়সেই এ পেশার শুরু করতেন, তাহলে ওই ৩৪ বছর বয়স পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অন্ততপক্ষে গড় মূল্যে (১ কোটি+৪০ লাখ) ২=৭০ লাখ টাকা উপার্জনে সক্ষম হতেন অর্থাৎ গড়ে তার মাসিক আয় অন্তত ৪০ হাজার টাকা হতো, যা তার ব্যক্তি জীবনে, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। যে হিসাব দেখানো হলো তা সরলীকৃত, এর যে কত লগারিদম আর ফাংশন, ক্যালকুলাস আছে, সে আরও গভীরভাবে গবেষণার দাবি রাখে। এরপর যারা উচ্চতর পদে চাকরি পাচ্ছেন, যেমন ধরুন বিসিএস কোয়ালিফাই করেছে, যারা ২৪ বছর বয়সে আবেদন করেছিল, তার সঙ্গে যারা ৩০ বছর বয়সে আবেদন করেছে, উভয় বয়সের মধ্য থেকে দুজন প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে চাকরি শুরু করলেন, যাদের একই ব্যাচে বয়সের পার্থক্য হয় অন্তত ৫ থেকে ৬ বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ডিপার্টমেন্টের ৬ বছরের সিনিয়র চাকরি জীবনে এসে ব্যাচমেট হিসাবে যখন চাকরি করেন, তখন তারা প্রচণ্ড রকম একটি মনস্তাত্ত্বিক চাপের মধ্যে সময় পার করেন; যা পেশাগত জীবনে অনেক জটিলতা তৈরি করে; এ বিষয়ে এখানে আর বেশি বলছি না।

সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটে এক ভয়াবহ রূপলাভ করে। ফলে ৩ বছরের অনার্স শেষ করতে ৬ বছর লেগে গিয়েছে। এরশাদ পতনের পর এ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য ছাত্রদের দাবির মুখে তৎকালে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর করা হয়। এ সর্বোচ্চ বয়সসীমার ক্ষয়ক্ষতির ফলাফলের একটি নমুনা ওপরে বর্ণনা করেছি। ফলে একটি সরকারি চাকরি পাওয়ার আশায় আমাদের যুব সমাজের একটি বড় অংশের মধ্যে স্বেচ্ছা বেকারত্বের ঘেরাটোপে জীবনের সোনালি সময়ে ৬-১৩ বছর সময় নিষ্ফল হয়ে যায়।

এ আলোচনার আলোকে যদি আমরা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর নির্ধারণের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করি, তাহলে তার গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক ফলাফল কী দাঁড়ায়? প্রথমত, বর্তমানে স্বেচ্ছা বেকারত্বের ৬-১৩ বছরের মেয়াদটি বেড়ে ১১-১৮ বছরে বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ স্বেচ্ছা বেকারত্ব আরও ৫ বছর বৃদ্ধি পাবে। একজন যুব কর্মক্ষম মানুষ একটি সরকারি চাকরির আশায় ৩৮ বছর বয়স পর্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন, একজন মানুষের জীবনের সোনালি (২৪-৩৮ বছর বয়স) সময়ের ১১-১৮ বছর পর্যন্ত সময় বেকারত্বের অভিশাপ এবং উপার্জনের অক্ষমতার মধ্যে কেটে যাবে।

সরকার হয়তো রাজনৈতিক বিবেচনায় চাকরিতে প্রবেশের আবেদন করার সর্বোচ্চ বয়সসীমা বৃদ্ধির চিন্তাই করবে। কমিশনও সরকারের সম্ভাব্য সিদ্ধান্তের সহায়ক প্রতিবেদন দেবে। কিন্তু তাতে চাকরিপ্রার্থীদের চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তা হবে না। এতদিন চাকরির চেষ্টা করে যারা ক্লান্ত হয়ে গেছেন, স্বচ্ছ প্রতিযোগিতায় নবীনদের সঙ্গে তাদের পেরে ওঠার সম্ভাবনাও অনেক কম। এরপর হয়তো যারা নিচু গ্রেডের চাকরি পেয়েছেন, তারা উচ্চ গ্রেডে চাকরির দরখাস্ত করে সফল হলেও হতে পারেন। তাতে গুটিকয়েক হয়তো চাকরি পাবেন আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে, কয়েকজন হয়তো পূর্বের চাকরিজীবী। কিন্তু নিচু গ্রেডের ওই শূন্যপদ আবারও পূরণের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগেই আবারও অনেকের বয়স ফুরিয়ে যাবে। আবার হতাশা তাদের আচ্ছন্ন করবে। চূড়ান্ত ফলাফলে আন্দোলনকারী অধিকাংশ ব্যক্তি, তাদের পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র অনেক বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক, পারিবারিক এবং রাষ্ট্রীয় অস্থিতিশীলতা আরও বৃদ্ধি পাবে। তৃতীয়ত, রাষ্ট্র তার কাঙ্ক্ষিত জিডিপি অর্জন করতে না পারায় ভবিষ্যতের বিনিয়োগ হ্রাস পাবে; ফলে বেকারত্ব আরও বহু মাত্রায় বৃদ্ধি পাবে।

আমরা যদি জাতীয় উন্নয়ন এবং বেকার সমস্যার সমাধান করতে চাই, তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে হবে। আর সরকারি নিয়োগ বিধিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন-

১. শিক্ষাব্যবস্থায় দ্বাদশ গ্রেড পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যমে কর্র্মী বা উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা অন্তত নিজের জীবিকা নিজে উপার্জন করতে পারে। আমাদের সেরূপ শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে।

২. সরকারি নিয়োগবিধি এমনভাবে করতে হবে, যাতে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ও যোগ্যতা অর্জনের বয়সের সঙ্গে ম্যাচিং করা যায়। যেমন, অফিস সহায়ক পদে প্রবেশের যোগ্যতা এসএসসি ১৮ বছর হলে সে চাকরির আবেদন করতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে ২০ বছর বয়সের পরে কেউ যাতে অফিস সহায়ক পদের জন্য আবেদন করতে না পারে, সে ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ১৮ বছর বয়সে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে, কাজেই ২১ বছর বয়সের পরে উচ্চমাধ্যমিক পাশের যোগ্যতার কোনো চাকরিতে আবেদন করতে পারবে না; এ ধরনের বিধান করা প্রয়োজন। যেসব চাকরিতে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা স্নাতক, সেসব চাকরির জন্য স্নাতকে ফলাফল ঘোষণার পর তিন বছর পর্যন্ত বা ২টি বিসিএস পরীক্ষায় আবেদন করতে পারবে। অনুরূপভাবে স্নাতকোত্তর ফলাফলের পরে ২ বছর পর্যন্ত চাকরির আবেদন করতে পারবে মর্মে বিধান করা হলে স্বেচ্ছা বেকারত্বের সময়ের পরিমাণ কমিয়ে আনা যাবে। সবারই যার যেমন মেধা, পরিশ্রমের সক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা নিয়ে স্বেচ্ছা কর্মে নিয়োজিত হবে বলে আমি মনে করি। তাতে অন্তত এমএ পাশ করে এইচএসসি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার সনদপত্র গোপন করে তঞ্চকতার মাধ্যমে অফিস সহায়কের চাকরি করার মতো অপমানজনক কাজ থেকে যুব সমাজকে বিরত রাখা যাবে। চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ভূতুড়ে দুর্নীতিও কমানো সম্ভব হতে পারে। ফলে রাষ্ট্র পাবে উৎপাদনশীলতা ও জিডিপি, ব্যক্তি ও পরিবার পাবে জীবিকা ও সচ্ছলতা।

আমি লেখার শুরুতে গণিত ও বিজ্ঞান শব্দ দুটি ব্যবহার করেছি যৌক্তিকতা বোঝানোর জন্য। এ মুহূর্তে চাকরি প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর নির্ধারণের পেছনে কোনো গাণিতিক বা বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই। যদি থাকে কিছু রাজনীতি থাকতে পারে। আমি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে যতটুকু গণিত ব্যবহার করেছি, তা অত্যন্ত সরল হিসাব। অর্থনীতির বহুমাত্রিক বিশ্লেষণে আমাদের দেশে যে বেকারত্ব বিদ্যমান, কর্মসংস্থানের অভাব, দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের কশাঘাত; এসব থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের একটি জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। চাপ-তাপের ফলে রাষ্ট্র কোনো ভুল নীতি গ্রহণ করলে তা জাতি গঠনে, জাতির অগ্রযাত্রায় ভয়ংকর রকম ক্ষতির কারণ হবে। রাষ্ট্রের একটি ভুল সিদ্ধান্ত জাতিকে অনেক পিছিয়ে দেয়। রাষ্ট্র যা কিছুই করুক না কেন, তার একটি বিপক্ষ দল থাকবেই। আবার রাষ্ট্রে যে কোনো সিদ্ধান্তের ফলাফলের পরিণতিতে একটা কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহল সৃষ্টি হয়। সিদ্ধান্তটি ভুল হলেও ওই কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় ও চাপে ওই ভুল সিদ্ধান্তটি আর সংশোধন করা সম্ভব হয় না। কাজেই রাষ্ট্রকে অবশ্যই ভূত-ভবিষ্যৎ ভেবে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের চেষ্টা করতে হবে। সুবোধ জনগণেরও উচিত রাষ্ট্র যাতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে, তাতে সাহায্য করা। রাষ্ট্র সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরে কোনো চাপে পড়লে রাষ্ট্রকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করা নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য। আর না হলে রাষ্ট্রের ভুল সিদ্ধান্তের কুফলে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয় নাগরিক, জনগণ। আশা করি, সবারই শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। মুক্ত নতুন বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।

মোহাম্মদ হোসেন : লেখক ও বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম