Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

রোহিঙ্গা প্রশ্নে ত্রিমুখী কূটনৈতিক কৌশল সফল হবে কি?

Icon

ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর উপস্থিতির কারণে স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মিয়ানমার রোহিঙ্গা নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করছে। ২০২১ সালে সামরিক জান্তার ক্ষমতা গ্রহণে এ সংকট আরও প্রকট হয়েছে। বারবার মিয়ানমারের অসহযোগিতামূলক আচরণ বাংলাদেশকে ক্ষুব্ধ করেছে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে পশ্চিম মিয়ানমারে বিদ্রোহী ও সামরিক কর্মীদের মৃত্যু এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টার কারণে নতুন করে আবারও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, গত কয়েক মাসে আট হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ক্রমাগত আন্তর্জাতিক মহলের মনোযোগ আকর্ষণের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, এ সংকটে নজর দেওয়া না হলে তা শুধু বাংলাদেশকেই নয়, বরং সমগ্র অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

আরাকান আর্মি এবং বার্মিজ সামরিক জান্তা রাখাইন রাজ্যে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা চালাচ্ছে এবং বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন, ইউকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অধিকার রক্ষার জন্য দ্রুত এবং সিদ্ধান্তমূলকভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে। ক্রমাগত সহিংসতার কারণে অনেক রোহিঙ্গা নৃশংসতা থেকে বাঁচতে নিরাপদ দূরত্বে যেতে বাধ্য হয়েছে।

প্রত্যাবর্তনের সময় সহিংসতার ভয় রোহিঙ্গাদের মনে চেপে বসেছে। এ ভয়ের কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনসংখ্যা এক সময় মোট জনসংখ্যার প্রায় ত্রিশ শতাংশ ছিল। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছে এবং তাদের বসবাসের অঞ্চলে প্রশাসনিক ভবন তৈরি করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর রোহিঙ্গা শরণার্থীরা শুরু থেকেই অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। তাদের বসবাসের ক্যাম্পগুলো অতিমাত্রায় জনবহুল এবং তারা বেশিরভাগই মানবিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। হাজার হাজার শরণার্থীকে এমন একটি দ্বীপে স্থানান্তরিত করা হয়েছে, যেটি ২০২০ সাল থেকেই ঘন ঘন বন্যার সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেবে, তা-ও সম্ভব নয়। ফলে রোহিঙ্গাদের অনেকেই শিক্ষার মতো মৌলিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট সমাধানের একটিই উপায়, আর তা হলো স্থায়ী প্রত্যাবর্তন। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে তাদের পৈতৃক গ্রামে পদ্ধতিগত ও মানবিক প্রত্যাবর্তনের ওপর বাংলাদেশের অবস্থান অটল। যদিও স্থায়ী এসব শরণার্থীর একটি বিশাল জনসংখ্যা এ দেশের জনগণের কল্যাণকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে বলে বাংলাদেশ বিশ্বাস করে। তবুও বাংলাদেশ এ সমস্যার সমাধানে শুরু থেকেই আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং আসন্ন বিপর্যয়ের কার্যকর সমাধান খুঁজছে। অধ্যাপক ইউনূস সংকটের বর্তমান পদ্ধতির পুনর্মূল্যায়নেরও আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে এবং ভবিষ্যৎ সমাধানের পরামর্শ দেওয়ার জন্য সর্ব-অংশীজনের সমন্বয়ে একটি সম্মেলন আহ্বান করবেন বলেও তিনি প্রস্তাব করেছেন।

বাংলাদেশ শক্ত কূটনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক শূন্যতা পূরণের ব্যবস্থা নিতে পারে বলে অনেকের ধারণা। পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন ও সহায়তা পাওয়ার জন্য শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে পশ্চিমাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা উচিত। রোহিঙ্গা অভিবাসন বন্ধ এবং তাদের অধিকার পুনরুদ্ধারের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে এখন একটি সক্রিয় এবং সু-সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ ও বাংলাদেশের যৌথভাবে পরিচালিত জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন ড. ইউনূস। এ লক্ষ্যে শক্তিশালী রাজনৈতিক সমর্থন প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

গত আগস্ট মাসের শুরুতে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা এবং ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের চ্যালেঞ্জ রয়েছে ড. ইউনূস সরকারের সামনে। পাশাপাশি ইউনূস এবং অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন রোহিঙ্গা ইস্যুসহ অনেক কঠিন নীতিগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তবে আমরা বিশ্বাস করি, শরণার্থী পরিস্থিতি মোকাবিলার সুযোগ বাংলাদেশের রয়েছে। প্রফেসর ইউনূস একজন অর্থনীতিবিদ এবং ক্ষুদ্রঋণের অগ্রদূত, যিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। পশ্চিমা সরকার এবং বিশ্ব দাতা সম্প্রদায়ের সঙ্গে তার দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংকট সমাধানের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, আরও মানবিক ত্রাণের জন্য বিশ্ববাসীকে উৎসাহিত করা। বিদেশে ব্যাপক খ্যাতি এবং সুনামের কারণে ড. ইউনূসের সেই সক্ষমতা রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।

পুনর্বাসন পদ্ধতি হলো দ্বিতীয় এবং জটিল ধাপ। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত হলো, কিছু রোহিঙ্গাকে অনিচ্ছাকৃত মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে হাসিনা প্রশাসনের চেষ্টার নীতিকে সমর্থন না করা। এটি দেশের দ্রুত অবনতিশীল পরিস্থিতির আলোকে স্পষ্ট। এখন পর্যন্ত কয়েকটি দেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। তাই তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পুনর্বাসনের বিষয়ে আলোচনা সহজ হবে না। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ভারতে মিলিতভাবে ৩ লাখ ৪৫ হাজার শরণার্থী অবস্থান করছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসাবে তৃতীয় দেশে দ্রুততম সময়ে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের পরামর্শ দিয়েছেন।

এ পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এবং দাতা সম্প্রদায়ের সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে ড. ইউনূস পশ্চিমা দেশগুলোকে রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। সবকিছু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কৌশলগত নির্দেশের ওপর আবর্তিত হচ্ছে। তাই তাদের চিন্তাভাবনা সম্পর্কে এত তাড়াতাড়ি মন্তব্য করার সময় আসেনি। তবে রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা, দাতা দেশ ও সংস্থার পরস্পরবিরোধী উদ্দেশ্য এবং শরণার্থী গ্রহণে অনেক সরকারের অনীহার কারণে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের আলোচনা সফল হওয়া কঠিন হতে পারে। সাধারণ পরিষদ অধিবেশন চলাকালীন প্রফেসর ইউনূস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যামূলক অপরাধ মোকাবিলার জন্য ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থাকে গুরুত্ব সহকারে সমর্থনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, এ অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কর্তৃক সংঘটিত অবিচারের প্রতিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রোহিঙ্গাদের মানবিক কার্যক্রমের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত প্রচেষ্টা আশা করে। সর্বোপরি, নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং পূর্ণ অধিকারসহ তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে চূড়ান্তভাবে প্রত্যাবাসনের জন্য আশাবাদী বর্তমান সরকার। এর আগেও আনান কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে পূর্ববর্তী সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনের চেষ্টা করেছিল; কিন্তু তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন দেশে সহিংসতা বাড়িয়েছে এবং একইসঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মনে আশার সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু সন্দেহাতীতভাবেই রোহিঙ্গারা এখনো অস্পষ্ট এবং কঠিন ভবিষ্যতের মুখোমুখি। প্রশ্ন উঠছে, অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন রাজনৈতিক সমাধান এবং বাস্তুচ্যুত সম্প্রদায়ের জন্য সম্পদ সুরক্ষায় সমঝোতা করতে সক্ষম হবেন কিনা। অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসন সামনে একটি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে, যেটি দেশের জনগণের ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা এবং এর শরণার্থীদের প্রয়োজনীয় চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে বাধ্য করবে।

রোহিঙ্গাদের দীর্ঘস্থায়ী দুর্দশা দূর করার একটি বিকল্প হলো প্রফেসর ইউনূসের থ্রি-ইন-ওয়ান কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। কূটনীতির ত্রিমুখী পদ্ধতি রোহিঙ্গাদের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আন্তরিক ইচ্ছাকে সাধুবাদ জানায়, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তা দিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর ধারাবাহিক ও সমন্বিত কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তৃতীয় দেশে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের সম্ভাবনার দিকে নজর দেয়। যদি এটি সফল হয়, তবে তা হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের পাশাপাশি শরণার্থীদের বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনার ইতিহাসে একটি সত্যিকারের ঐতিহাসিক কাজ।

ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম