Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

পুলিশের মনোবল ফেরানো খুব জরুরি

Icon

জেহসান ইসলাম

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পুলিশের মনোবল ফেরানো খুব জরুরি

বাংলাদেশে সরকারি বা বেসরকারি যত চাকরি আছে, সবচেয়ে কঠিন, কষ্টকর ও বিব্রতকর হলো পুলিশের চাকরি। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই পুলিশ প্রতিনিয়ত জনসাধারণের সঙ্গে মারামারি ও যুদ্ধ করে আসছে।

এমনও দেখা গেছে, দু’পক্ষ মিলে মারামারি করছে, পুলিশ তা থামাতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে দু’পক্ষ এক হয়ে পুলিশের বিরুদ্ধেই মারামারি শুরু করেছে। দার্শনিক টমাস হবস বলেছিলেন, মানুষের অবস্থা হচ্ছে, প্রতিটি মানুষ প্রতিটি মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত যুদ্ধে লিপ্ত (The condition of man is a condition of war of everyone against everyone-Thomas Hobbes)। বাংলাদেশে পুলিশের অবস্থা প্রায় এ রকমই।

অন্য কোনো চাকরির ক্ষেত্রে কি এ রকম ঘটে? সব সমালোচনা বাদ দিয়ে একবার আমরা চিন্তা করে দেখি, কেবল গত কয়েক মাসে পুলিশ বাহিনীকে কী পরিমাণ মারামারি করতে হয়েছে জনগণের সঙ্গে। এর চেয়ে কঠিন ও কষ্টকর চাকরি আর কী হতে পারে? এর চেয়ে আরও বড় সমস্যা হলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বৈধ বা অবৈধ নির্দেশ পালন করতে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়া।

সাধারণ পুলিশ সদস্যদের পক্ষে কি সম্ভব সব সময় যাচাই করা, কোনটা কর্তৃপক্ষের বৈধ আর কোনটা অবৈধ নির্দেশ? দেশে কি কখনো এমন পরিস্থিতি ছিল বা আছে, চাইলেও একজন পুলিশ সদস্য কর্তৃপক্ষের অবৈধ নির্দেশ পালন না করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন?

সবসময় সাধারণ মানুষ পুলিশকে শত্রুভাবাপন্ন মনে করে আসছে। কেন সাধারণ মানুষ পুলিশকে শত্রুভাবাপন্ন মনে করে? কারণ বহুবিধ হলেও অন্যতম হলো পুলিশের প্রধান কাজ নিরপেক্ষভাবে ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’ করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি বিচ্যুতি অথবা এর বিপরীত চিত্র। কিন্তু কী কারণে এত বেশি বিচ্যুতি ঘটছে, তা ভেবে দেখার সময় হয়েছে।

পুরো সমাজকেই এর দায় নিতে হবে। সবচেয়ে বেশি দায় নিতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে। যে দেশে সব রাজনৈতিক নেতা, কর্মী, এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যেও সুযোগ পেলেই ক্ষমতা দেখানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও মানসিকতা বিরাজমান এবং পুলিশকে দিয়ে এ আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার প্রয়াস চালানো হয়, সে দেশে পুলিশের দায়িত্ব পালনের ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য তাদেরই কেবল দায়ী করা অবশ্যই সুবিচার নয়।

একথা ঠিক, পুলিশের হাতে অনেক ক্ষমতা আছে। সামরিক বাহিনীকে বাদ দিলে ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি পুলিশের চাকরিতে। প্রকৃত অর্থে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুলিশের ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর চেয়েও বেশি। কারণ তারা সরাসরি জনসাধারণের সঙ্গে কাজ করার এবং জনগণের বেপরোয়া অংশের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করার জন্য আইনগতভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত।

রাষ্ট্র নিজের প্রয়োজনেই পুলিশকে এ ক্ষমতা দিয়েছে। পুলিশ তো অনেক পরে, বাল্যকালে আমরা অনেকেই চৌকিদারেরও অনেক দাপট গ্রামাঞ্চলে দেখেছি, যার কারণে নিরীহ কোনো এক মহিলাকে সাহায্য করার কারণে ওসি সাহেবকে চৌকিদার বানানোর জন্য বিধাতার কাছে প্রার্থনা করার গল্প চালু আছে।

যে কোনো সভ্য, গণতান্ত্রিক দেশের জননিরাপত্তার জন্য পুলিশ বাহিনী থাকতেই হবে। কারণ স্বাভাবিক সময়েও সমাজের দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে জনসাধারণের নিরাপত্তা বিধানের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই পলায়নপর পুলিশের অনুপস্থিতি এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, যে কোনো বিপ্লবোত্তর সময়ে যে কোনো দেশে বা সমাজে যা স্বাভাবিক, পুলিশের অত্যাবশ্যকীয়তার বিষয়টি আরও বেশি করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও উঠছে, পুলিশের মনোবল কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায়। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের বিরোধী অংশের প্রতিবাদ ও বিরোধিতা দমনের জন্য, নিরুপদ্রবভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য, ক্ষমতাকে অবৈধভাবে ধরে রাখা বা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য সব সরকারই কম-বেশি পুলিশকে ব্যবহার করেছে। আবার পুলিশেরও কিছু কিছু উচ্চাভিলাষী সদস্য, বিশেষ করে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা, নিজেদের ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ দিতে অতি উৎসাহী হয়েছেন, পরিণতির কথা ভাবেননি। তবে বিগত সাড়ে পনের বছরে হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে পুলিশকে স্রেফ একটি দলীয় বাহিনীতে পরিণত করেছে।

এমনকি, তারা পুলিশকে একটি বিশেষ জেলার বাহিনীতেও রূপান্তরিত করেছে। এখানেই শেষ নয়, যে পুলিশ যত বেশি অপকর্ম করেছে, ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে, সরকারবিরোধীদের নিপীড়ন ও নির্যাতন করেছে, সে পুলিশ তত বেশি পদোন্নতি, ভালো পোস্টিং, মেডেল ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে। ফলে পুলিশই শুধু নয়, প্রজাতন্ত্রের সব কর্মচারীর মধ্যে নানা রকম অপকর্ম করে সরকারের সুদৃষ্টি লাভের তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

এ দৌড়ে অনেকে সাময়িকভাবে সাফল্য লাভও করেছে। তাই দেখা যায়, সরকার পতনের পরপরই নজিরবিহীনভাবে তাদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা। আর পুলিশে এ ঘটনা ঘটেছে প্রায় গণহারে। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। পুলিশ এখন জনগণের মুখোমুখি হতে ভয় পায়।

সমাজের সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধীর বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পুলিশ থাকে দোদুল্যমান। কিন্তু ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লবের পর আমরা যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সভ্য সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখছি, একটি জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী ছাড়া যে তা সম্ভব নয়, সেটা সবাই বুঝতে পারছি। আর এজন্যই অন্যান্যের মধ্যে পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের কথা এসেছে এবং সরকার ইতোমধ্যে একজন সাবেক সচিবকে প্রধান করে কমিশন গঠন করেছে।

কমিশন কী ধরনের সংস্কার প্রস্তাব করবে এবং তা কতদিনে বাস্তবায়িত হবে, বলা কঠিন। তবে দীর্ঘ সময় যে লাগবে সেটা বলা যায়। কিন্তু ততদিন কি রাষ্ট্র এভাবে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকবে? দীর্ঘ সময় এভাবে থাকা কি সম্ভব? সম্ভব নয়। সেজন্য দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নিয়ে বর্তমানে কর্মরত পুলিশকে দিয়ে চালিয়ে নিতে হবে আর এজন্য অবশ্যই তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে জরুরিভাবে।

প্রথমত, যেসব পুলিশের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, দ্রুত তদন্তসাপেক্ষে তাদের চাকরি থেকে বিদায় করতে হবে। হতে পারে বাধ্যতামূলক অবসর, যা এরই মধ্যে কতিপয় কর্মকর্তার ক্ষেত্রে করা হয়েছে অথবা অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে দ্রুত চাকরিচ্যুতিসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়া। একই কথা জনপ্রশাসনের অন্যদের বেলায়ও প্রযোজ্য হতে পারে। কথায় আছে, দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো।

দ্বিতীয়ত, প্রতিটি থানা ও জেলায় পুলিশকে নাগরিকদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। প্রতিটি ক্ষেত্রে নাগরিক কমিটি হতে পারে। যাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ফৌজদারি অভিযোগ নেই, সমাজে সজ্জন হিসাবে পরিচিত, অরাজনৈতিক, বিভিন্ন পেশার শিক্ষিত সচেতন, সমাজহিতৈষী ব্যক্তিদের নিয়ে এরূপ নাগরিক কমিটি গঠন করা যেতে পারে।

পুলিশ ও নাগরিক কমিটি মিলে আওতাধীন এলাকার সামগ্রিক নিরাপত্তার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। পুলিশকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, নাগরিক কমিটিতে এ রকম ব্যক্তিদেরও সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে যে তাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই এবং সরকার ও জনগণ সবসময় তাদের সঙ্গে থাকবে, এ নিশ্চয়তা দিতে হবে। প্রয়োজনে সব ধরনের মিডিয়ায় প্রচার-প্রচারণা জোরদার করতে হবে।

তৃতীয়ত, ইতোমধ্যে যা হওয়ার হয়েছে। অতীতকে পেছনে ফেলে এবং সব জড়তা দূর করে পুলিশকে আগের চেয়ে এখন আরও বেশি করে জনসম্পৃক্ত হওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। অতীতের ভুলগুলো তাদের স্বীকার করতে হবে এবং পরিশুদ্ধ হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। জনসাধারণের বিশ্বাস অর্জনের জন্য তাদের পুরোপুরি দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। তাদের অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বুঝতে হবে, হাতে যত ভয়ংকর অস্ত্র বা যত ক্ষমতাই থাকুক, সাধারণ মানুষ বিগড়ে গেলে তাদের সামনে ওইসব কিছুই না।

চতুর্থত, পুলিশ বাহিনীতে, বিশেষ করে কনস্টেবল ও অন্যান্য নিম্নপদের সদস্যদের দুর্দশার কথা শুনতে হবে, যেগুলো দ্রুত সমাধান করা সম্ভব, সেগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে। যেমন-থাকার পরিবেশ, খাওয়ার ও পোশাকের মানোন্নয়ন ইত্যাদি। অন্য যেগুলো করতে সময় লাগবে, সেগুলোর বিষয়ে তাদের বুঝিয়ে আস্থা তৈরি করতে হবে।

পঞ্চমত, কনস্টেবল ও অন্যান্য নিম্নপদে দ্রুত নিয়োগের ব্যবস্থা ও তাদের আধুনিক প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। আধুনিক প্রশিক্ষণে পুরোনোদেরও সম্পৃক্ত করা যায়। প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হতে না পারলে প্রশিক্ষণার্থীকে দায়ী না করে প্রশিক্ষকবৃন্দকে দায়ী করতে হবে। প্রশিক্ষণে পাশ না করানো নিয়ে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ আছে।

ষষ্ঠত, পুলিশকে অহেতুক বিরক্ত করা, পুলিশকে অশ্রদ্ধার বা হেয় চোখে দেখা, তাদের আইনানুগ কাজে বাধা প্রদান করা ইত্যাদি থেকে সবাইকে নিবৃত্ত করতে হবে। সবাইকে আইন মেনে চলার জন্য বাধ্য করতে হবে। এজন্য বিচার বিভাগের সহযোগিতায় ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ে এলাকায় এলাকায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে। যে কোনো জনবিরক্তিকর কর্মকাণ্ড, এমনকি যত্রতত্র পোস্টার সাঁটানো, ময়লা-আবর্জনা ফেলা, ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করা ইত্যাদি থেকে নিবৃত্ত করতে মোবাইল কোর্ট কাজ করবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আইন মানা-না মানা তিন শ্রেণির লোক আছে; এক. যারা আইন না জেনেও বিবেকের তাড়নায় আইন মেনে চলে; দুই. জেনেও পার পেয়ে যাবে ভেবে আইন ভঙ্গ করে, কিন্তু বাধ্য করলে আইন মেনে চলে; তিন. কোনো অবস্থাতেই আইন মেনে চলতে চায় না, এমনকি দণ্ডারোপ করলেও এদের ব্যাপারে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। এ তিন শ্রেণিকে তিনভাবে মোকাবিলা করতে হবে।

যথাযথভাবে আইন প্রয়োগ করলে যে সবাই ঠিক হয়ে যায়, তার বড় উদাহরণ ক্যান্টনমেন্ট এলাকা। একই শহরের মধ্যে জাহাঙ্গীর গেটের পর এক অবস্থা আর তার আগে আরেক অবস্থা। অধৈর্য হলে হবে না, লেগে থেকে ধৈর্য ধরে জনগণকে আইন মানার জন্য উদ্বুদ্ধ ও বাধ্য করে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। সব দেশ যদি পারে, আমাদের না পারার কোনো কারণ নেই।

পুলিশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। আমাদের জীবনে যা কিছু অপরিহার্য, যেমন-পানি, বাতাস ইত্যাদি বিশুদ্ধ হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন, না হলে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুঝুঁকিতেও পড়তে হয়, তেমনি রাষ্ট্রের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য এর প্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্যই পরিশুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠান পরিশুদ্ধ হয় তখন, যখন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা পরিশুদ্ধ হন, এর বিধিবিধান সঠিকভাবে প্রণীত হয় এবং সেগুলো সঠিকভাবে মেনে চলা হয়, সর্বোপরি ব্যত্যয়ের জন্য মূল্য দিতে হয়; এমনকি অপরাধ করলে তো অবশ্যই, ভুল করলেও।

বর্তমানে আমরা এক দারুণ অস্থির সময় পার করছি। সরকারকে যৌক্তিকভাবে কঠোর হতেই হবে। কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দ্রুততম সময়ে পুলিশকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সুসংগঠিত করে দ্রুততম সময়ে তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে হবে। আর সময়ক্ষেপণ করা ঠিক হবে না।

জেহসান ইসলাম : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম