গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযোদ্ধারা কি মতাদর্শগতভাবে দ্বিখণ্ডিত?
মুদাসসির হোসেন খান
প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযোদ্ধারা কি মতাদর্শগতভাবে দ্বিখণ্ডিত?
এ কথা অনস্বীকার্য, পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও তার জুলুমবাজ সরকারের অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে জাতিকে মুক্ত করার সংগ্রামে ছাত্র-জনতাসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ হয়ে থাকলেও, সমগ্র জাতির এ মুক্তির আন্দোলনে গুটিকতক স্বাধীনতার যোদ্ধা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সংগঠন, যথা : মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ কর্তৃক দলবদ্ধ উপস্থিতি এ ঐতিহাসিক সংগ্রামে দৃশ্যমান ছিল না। যাদের অতুলনীয় ও অমূল্য ত্যাগের বিনিময়ে অর্ধশতাব্দীর অধিককাল আগে এ দেশ শত্রুমুক্ত হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, দেশকে আবার শৃঙ্খলমুক্ত করে দাসত্ব মোচন ও বহিঃশত্রুর সম্ভাব্য আগ্রাসন নস্যাৎ করার যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাশিত সক্রিয় এবং সরব অনুপস্থিতি কেবল হতাশাব্যঞ্জকই নয়, একাধারে নিন্দনীয় ও বেদনাদায়ক। নানাবিধ প্রলোভন ও ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের বিনিময়ে নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল অবদান বিস্মৃত হয়ে এবং সোনালি ঐতিহ্য ও নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে আদর্শহীন অসংখ্য রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করার ঘৃণিত কর্মকাণ্ডই এ অধঃপতনের মূল কারণ বলে আমি মনে করি।
জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আমার মতো স্বল্প জ্ঞান ও বুদ্ধিসম্পন্ন কিছু মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠ ও অপঠিত লেখনীতে বিরামহীন প্রতিবাদ উত্থিত হলেও ছাত্র-জনতার যুগান্তকারী আন্দোলনে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বৃহত্তর মুক্তিযেদ্ধা পরিবারের এহেন ব্যর্থতা দেশবাসীকে করেছে বিস্মিত ও ব্যথিত।
তাই জনগণের তীব্র আন্দোলনের মুখে লুটেরা একনায়ক উৎখাত হলেও জাতির বুকে এ নজিরবিহীন দুর্যোগ আবির্ভূত হওয়ার কারণে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী হিসাবে সব মুক্তিযোদ্ধাকে এক মঞ্চে একীভূত হয়ে গণঅভ্যুত্থানের অগ্রপথিক ছাত্রছাত্রীসহ জনসাধারণের পাশে দাঁড়িয়ে সব অনিয়ম, অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচার মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে আন্দোলনকে চলমান রেখে আন্দোলনকারীদের অমূল্য ত্যাগের সুফল প্রতিটি নাগরিকের দুয়ারে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে তাদের পরামর্শ ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা একান্ত অপরিহার্য। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ জীবিত মুক্তিযোদ্ধাই বর্তমানে বার্ধক্যে উপনীত হয়ে থাকলেও দেশের বিদ্যমান সংকট ও ক্রান্তিলগ্নে আবার দেশ রক্ষার কাজে তারা নিজেদের সর্বশক্তি বিলিয়ে দিতে পিছপা হবেন না বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
এ প্রসঙ্গে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের প্রবীণ নাগরিক হিসাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান লক্ষ্য কী হওয়া উচিত এবং তা বাস্তবায়নকল্পে সম্ভাব্য কিছু পদক্ষেপ উপস্থাপন করছি-
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান লক্ষ্যগুলো
১) এমন একটি অপরিবর্তনীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে এবং যার মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই শাসনব্যবস্থার সব স্তরে শাসনকার্য পরিচালনা করবেন।
২) শাসনব্যবস্থার ওপর সরকারের অবৈধ প্রভাব বা অন্য কোনো অশুভ শক্তিশালী গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপমুক্ত একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
৩) সংবিধানে কঠোর ও অপরিবর্তনীয় ধারাগুলো সংযোজন, যা ভবিষ্যতে কোনো স্বৈরাচারী শাসককে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেবে না।
৪) দীর্ঘমেয়াদি পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তোলা, যা পারস্পরিক সম্মান এবং সাম্যতার ভিত্তিতে সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সহায়ক হবে, যার মাধ্যমে শেখ হাসিনার ঘৃণিত পুতুল সরকারের ওপর উৎপীড়ক ও সম্প্রসারণবাদী কোনো দেশ এবং কোনো বৃহৎ ও শক্তিধর রাষ্ট্রের আধিপত্যের অধীনে শর্তারোপিত সম্পর্ক মেনে চলবে না।
৫) সার্কের কার্যক্রম পুনরুজ্জীবিত করে নিয়মিতভাবে দ্বিবার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করা, যেখানে সব সদস্য রাষ্ট্রকে সমান মর্যাদায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হবে।
৬) জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা, যা জনগণের প্রকৃত আকাঙ্ক্ষা পূরণের দিকে লক্ষ্য রাখবে।
লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলো
১) গণবান্ধব নির্বাচন সংস্কারের মাধ্যমে একটি বাস্তবসম্মত নির্বাচনি রোডম্যাপ তৈরি করা।
২) জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন ও অর্থ পাচারসহ সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োজনবোধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে তা দ্রুত কার্যকর করা। পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জাতীয় প্রচারাভিযান শুরু করা।
৩) বিচারব্যবস্থায় আমূল সংস্কার আনয়নের মাধ্যমে সব স্তরে সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ বিচারপতি নিয়োগ করা।
৪) মানবতাবিরোধী অপরাধ ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড অপরাধীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা এবং কঠোর শাস্তি প্রদান করা।
৫) স্বৈরাচার আমলে সম্পাদিত সব বৈদেশিক চুক্তি প্রকাশ করা, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে করা চুক্তিগুলোর পুনর্মূল্যায়ন এবং জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি হলে তা বাতিল করা।
৬) বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য প্রবাসী বাংলাদেশি এবং প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিশেষ সুবিধা প্রদান করা।
৭) শিক্ষাক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে ছাত্র ভর্তি ও শিক্ষক নির্বাচন করে বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে মেধাবী শিক্ষক ও ছাত্রদের সর্বোচ্চ সম্ভব আর্থিক সুবিধা প্রদান করা।
৮) সম্পূর্ণ পেশাদারিত্ব ও মেধাকে বিবেচনায় রেখে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার উদ্দেশ্যে এবং সার্বিক জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে নতুন করে সশস্ত্র বাহিনীকে ঢেলে সাজানো। এ লক্ষ্যে প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং সামরিক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
৯) ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সব সক্ষম ব্যক্তির জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, যাতে দেশের প্রয়োজনে সমগ্র জাতিকে অস্ত্র ধারণে সক্ষম করে দেশ রক্ষায় সদা প্রস্তুত রাখা সম্ভব হবে।
১০) স্বাধীনতার অর্ধশতাধিককাল অতিক্রম হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের জন্য কোটাব্যবস্থা অর্থহীন। তাই এ প্রথার অপপ্রয়োগ রোধে তা সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা অত্যাবশ্যক।
১১) মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ করা, যার মাধ্যমে দল-মত নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অবদান রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রেখে লিপিবদ্ধ হবে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন রণাঙ্গনের ওপর ভিত্তি করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থায়নে চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুদাসসির হোসেন খান, বীরপ্রতীক