নতুন রাজনীতি ও বিএনপির চ্যালেঞ্জ
এম আবদুল্লাহ
প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নতুন রাজনীতি ও বিএনপির চ্যালেঞ্জ
রাজনীতি রং বদলায়। কখনো সময়ের ব্যবধানে, আবার কখনো বা ক্ষণে ক্ষণে। রাজনীতি-বিজ্ঞানের দীক্ষা যা-ই হোক, বাস্তবে রাজনীতি একই কক্ষপথে চলে কম। বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। হেনরি ফোর্ডের একটি উক্তি স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছেন-রাজনীতিকে সৎ রাখতে পারে একটি মাত্র উদ্দেশ্য, তা হলো দেশের এবং তার জনগণের জন্য ভালো কিছু করার উদ্দেশ্য। এ দেশ ও দেশের জনগণের কল্যাণের যে রাজনীতি, সেটি বাংলাদেশে অনুপস্থিত বহুকাল। আখের গোছানো আর জনগণকে জিম্মি করে গদি টেকানোর রাজনীতির চর্চাই দেখেছে এ দেশের দুর্ভাগা জনগণ।
গত ৫ আগস্টের অভূতপূর্ব গণবিপ্লবের পর রাজনীতি নতুন কক্ষপথে চলছে। দেড় দশকের নিপীড়ক শাসকগোষ্ঠী তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রাজনীতির সমীকরণেও চলছে বদলের হাওয়া। এ ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি ক্ষমতার নিয়ামক শক্তিগুলোর কৌতূহলি দৃষ্টি রয়েছে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর দিকে। সে কারণেই হয়তো নতুন বাংলাদেশে সক্রিয় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বেশ সতর্কভাবে পা ফেলছে। বিদ্বেষ আর হিংসা-হানাহানির রাজনীতির পরিবর্তে উদারতা, সহনশীলতা ও জনবান্ধব রাজনীতির বার্তা দেওয়ার চেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। এটি খুবই আশাব্যঞ্জক।
রাজনীতিকদের রাজনীতি-জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তৃতীয় বিশ্বে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। জর্জ বার্নার্ড শ’র ভাষায়-‘কিছুই জানে না; কিন্তু ভাবে যে, সেসব জানেন। এটি একটি রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।’ অর্থাৎ রাজনীতিকদের প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সম্যক জ্ঞান থাকতে হয়। ভূরাজনীতির মারপ্যাঁচে তালগোল পাকালে চলে না। রাজনীতি এক অর্থে দাবা খেলা। চালে ভুল করলেই রাজা চেক অনিবার্য।
লেখাটা একটু গুরুগম্ভীর হয়ে যাচ্ছে বোধহয়। প্রসঙ্গে আসা যাক। আগস্টের পঞ্চম দিনের পর বাংলদেশের রাজনীতিকরা নতুন পরীক্ষার মুখে পড়েছেন। গতানুগতিক রাজনীতি এখন একেবারেই অচল হওয়ার পথে। ছাত্র-জনতা নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে জাত পলিটিশিয়ানদের সামনে। তীক্ষ্ণ নজরদারিতে রয়েছে ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলগুলো। শত্রু-মিত্র নিরূপণে রাজনীতিকদের নতুন মানদণ্ড বিবেচনা করতে হচ্ছে।
২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনপূর্ব বাংলাদেশ ছিল পরিষ্কারভাবে দ্বিদলীয় রাজনীতির উর্বরভূমি। তৃতীয় ও চতুর্থ রাজনৈতিক শক্তি দ্বিদলীয় রাজনীতির তুরুপের তাস হিসাবে ব্যবহার হয়েছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতার সিঁড়ি হিসাবে কখনো জামায়াত আবার কখনো জাতীয় পার্টিকে ব্যবহার করেছে। বিগত দেড় দশকে সে চিত্র অনেকটাই পালটে যায়। বাকশালের নতুন ও অভিনব সংস্করণ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শেখ হাসিনা বস্তুত একদলীয় রাজনীতির পথে হেঁটেছেন। সব রাজনৈতিক দলেরই নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিলেন তিনি একাই। বিএনপি ও জামায়াতকে নেতৃত্বশূন্য করে এবং জাতীয় পার্টিকে বশীভূত করার মধ্য দিয়ে একনেত্রী, এক দেশ ফর্মুলা প্রায় কায়েম করে ফেলেছিলেন।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব বিপ্লবের পর নতুন ধরনের দ্বিদলীয় রাজনীতি দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ভারতে পলায়নের পর তার দল আওয়ামী লীগ অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। প্রায় দুমাসেও দলটি বিকল্প নেতৃত্বের মাধ্যমে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে রাজনৈতিক উপস্থিতি জানান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ অভাবনীয় পটভূমিতে রাজনীতির মাঠ এখন বিএনপি ও জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে। দুটি দলই সাংগঠনিক শক্তিকে সুসংহত করতে ঘরে-বাইরে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে।
শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকের প্রতিবেদন বলছে-এক সময়ের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নতুন করে মতবিরোধে বিএনপি অস্বস্তিতে পড়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দখল, চাঁদাবাজি ও হাঙ্গামার কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। সংবাদপত্রগুলো এসব ঘটনা ফলাও করে প্রকাশ করে, যাতে বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিযুক্ত করা হয়। এ নিয়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে বিএনপিকে নিয়ে তির্যক মন্তব্য আসে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির নতুন প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে কিনা, তা নিয়ে দলটির ভেতরে-বাইরে আলোচনা শুরু হয়েছে। তারেক রহমানের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে এর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ৪ সেপ্টেম্বর দলের এক ঘরোয়া কর্মসূচিতে তারেক রহমান ‘সাম্প্রতিক সময়ের গজিয়ে ওঠা অদৃশ্য প্রতিপক্ষ মোকাবিলায় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও কৌশল প্রয়োগ করতে’ নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেন।
আলোচিত রাষ্ট্র সংস্কার কর্মসূচির শেষে দেশে যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে, তাতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী যে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হবে, তা এখন অনেকটাই পরিষ্কার। দুদলের ভোটের লড়াই বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি আদর্শের এ দুটি দল মুখোমুখি হোক তা দেশপ্রেমিক জনগণের বড় অংশই চায় না। বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যকার বিরোধ, দূরত্ব ফ্যাসিবাদকে ফেরানোর পটভূমি রচনার আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা।
দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় ও দোলাচলের মধ্যেও আশার কথা হচ্ছে-টানেলের শেষ প্রান্তে আলোর ঝলক দেখা যাচ্ছে। জনগণের ভাষা বুঝতে শুরু করেছেন ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনীতিকরা। নিকট-অতীতেও প্রতিহিংসার যে চর্চা দেখা গেছে, বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে তার বিবর্তন আশাবাদের জায়গা তৈরি করছে। এ প্রসঙ্গে আগামীতে ক্ষমতার দাবিদার বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বক্তব্যের গুণাগুণ বিশ্লেষণ করা যায়। গত পক্ষকালে তারেক রহমানের বক্তব্যগুলো তার সম্পর্কে দীর্ঘদিন চলা আওয়ামী প্রোপাগাণ্ডাকে ভিত্তিহীন ও অসাড় প্রমাণ করছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরাও তারেক রহমানের রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও বিচক্ষণতাকে সমীহ করতে শুরু করেছেন।
আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসে রাজধানীর নয়াপল্টনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রশংসা করে সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় ও মন্তব্য প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। ওই ভাষণে তারেক রহমান অন্তর্বর্তী সরকারকে জনগণের সরকার আখ্যা দিয়ে তাকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে গুম-খুন, সংঘাত-সহিংসতা ও লুটপাটের মাফিয়াতান্ত্রিক রাজনীতির আপাত অবসান ঘটেছে। সাম্য, সম্প্রীতি ও বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের নতুন অভিযাত্রা শুরু হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের ভিত্তি ভূমি নির্মাণের বিশাল দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে চায় বিএনপি। দীর্ঘ সময় ধরে দেশে যে রাজনৈতিক সংকট চলে আসছে, সেটির আর পুনরাবৃত্তি চান না তারা। দলটির চাওয়া, আগামীর বাংলাদেশ হবে স্থিতিশীল বাংলাদেশ, যেখানে সুষম গণতন্ত্রের চর্চা হবে, থাকবে মানুষের বাক ও মৌলিক স্বাধীনতা। এজন্য রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তন আনা দরকার, সেটা তারা আনবে। দলটির নেতারা বলছেন, তাদের এ পরিবর্তনের ভিত্তি হবে ৩১ দফা। আগামীতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে তারা সব দল-মতের লোকদের নিয়ে সম্প্রীতির ‘রেইনবো নেশন’ গড়ে তুলবেন বলেও সংবাদপত্রের প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে।
শুধু এটাই নয়, দলের সাংগঠনিক পর্যায়েও তারা একটা গুণগত পরিবর্তন চান। ৫ আগস্টের বিপ্লবের পর ৫৪ দিনে সমাজবিরোধী ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলাপরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের অন্তত আড়াইশ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কৃতদের মধ্যে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অনেক ত্যাগী নেতাও রয়েছেন। কোনো অনুকম্পা না দেখিয়ে তারেক রহমানের দৃঢ়-কঠোর মনোভাবে একশ্রেণির নেতাকর্মীর উচ্ছৃঙ্খল ও বেপরোয়া আচরণ অনেকটাই কমে এসেছে। আগামীতে নেতাকর্মীদের কীভাবে আরও জবাবদিহির আওতায় আনা যায়, সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।
দেশের বিপুল জনসমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ দেড় দশকের আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। নির্বাসিত জীবনে থেকেও তার সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে, দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলের ঐক্য অটুট রাখা। ফ্যাসিবাদী সরকার বিএনপিকে টুকরো টুকরো করতে হেন অপচেষ্টা নেই, যা করেনি। তারেক রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্ব ও বিচক্ষণ নির্দেশনায় একটি প্রবল স্বৈরাচারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মী অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন।
বিশ্বনন্দিত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের পাশে যেভাবে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি, ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল দাঁড়িয়েছে, তার ধারাবাহিকতা থাকা চাই। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত স্থিতিশীল সরকার না আসা পর্যন্ত এটি থাকতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কার, অর্থনৈতিক সংস্কার ও গণতন্ত্রে উত্তরণে অভূতপূর্ব সহায়তার হাত বাড়িয়ে পাশে দাঁড়াচ্ছে উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাইকা, এডিবি, আইডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা স্মরণকালে এভাবে এগিয়ে আসেনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের আস্থা ও মর্যাদার এ সম্পর্ককে কাজে লাগাতে হবে। দেশকে বিপ্লবের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারের পাশাপাশি দেশপ্রেমিক সব রাজনৈতিক দলকেই অবদান রাখতে হবে।
এম আবদুল্লাহ : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট; সাবেক সভাপতি, বিএফইউজে