নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বর্তমান সরকারের বয়স দুই মাসের মতো। যেহেতু এটা অন্তর্বর্তীকালীন অনির্বাচিত সরকার, তাই এ দুই মাসকে তাদের ‘হানিমুন পিরিয়ড’ হিসাবে ধরা যেতে পারে। তারা কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, তার কিছু আভাস থাকলেও প্রকৃতপক্ষে কতদিন শেষ পর্যন্ত থাকবেন, তা আমরা কেউ জানি না। দেখা যাচ্ছে তারা ইতোমধ্যেই অনেক কাজে হাত দিয়েছেন। যেমন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইলিশ মাছ রপ্তানির ক্ষেত্রে আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে আছে-বেশ কয়েকটি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন, রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী অপসারণ, ব্যাংক খাত সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠন। বলা হয়েছে, কমিশনের কাজ দেরি হবে, তাই টাস্কফোর্স।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকে গৃহীত হয়েছে দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এর একটি হচ্ছে ডলার বিক্রি। আগে রিজার্ভ থেকে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ডলার বিক্রি করা হতো। তা আর এখন থেকে হচ্ছে না। দুর্দশাগ্রস্ত কয়েকটি ব্যাংককে আগে ‘ক্যাশ সাপোর্ট’ দেওয়া হতো ‘টাকা ছাপিয়ে’, অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ দিয়ে। এখন তা বন্ধ। পরিষ্কার কথা, দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে এখন থেকে আর নোট ছাপিয়ে কোনো ক্যাশ সাপোর্ট দেওয়া হবে না। তারা এখন থেকে ‘কলমানি মার্কেট’ থেকে আন্তঃব্যাংক লোন নিতে পারবে। এক্ষেত্রে যাতে অসুবিধা না হয়, সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘গ্যারান্টার’ হিসাবে কাজ করবে। আবার নীতি সুদহারেও পরিবর্তন এসেছে। সর্বশেষ তা ৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৯ শতাংশ করা হয়েছে। গভর্নর সাহেব বলেছেন, তার অগ্রাধিকার মূল্যস্ফীতি রোধ। আবার বলছেন, রাজনীতি ঠিক না হলে ব্যাংক সংস্কার টেকসই হবে না। বলেছেন, মূল্যস্ফীতি আগস্ট মাসে জুলাই মাসের তুলনায় কিছুটা কমেছে। সরকারি তথ্যে তা-ই দেখলাম।
কিন্তু প্রশ্ন আছে। এসব প্রশ্ন আমার নয়। স্বয়ং গভর্নর মহোদয় এবং অর্থ উপদেষ্টা ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে বলতেন, মূল্যস্ফীতির হিসাব ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্ফীতির হার আরও বেশি। মানুষের ধারণাও তা-ই। বিশেষ করে এখনো যেখানে দেখা যাচ্ছে কোনো পণ্যের দাম কমেনি। বরং ডিমসহ অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে। এসব খবর প্রতিদিন ছাপা হচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা যেমন প্রকৃত হিসাব চাই, তেমনি চাই মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ। বস্তুত এ কাজটিই আইনি দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের, যা করতে ব্যাংকটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে অতীতে। সর্বশেষ ব্যর্থ হয়ে বলতে শুরু করেছিল, কেবল কেন্দ্রীয় ব্যাংক একা মূল্যস্ফীতি রোধ করতে পারবে না। কারণ শুধু মুদ্রাস্ফীতির কারণেই মূল্যস্ফীতি ঘটে না। এর সঙ্গে জড়িত রাজস্ব, বাণিজ্যিক নীতিমালা এবং নানাবিধ রাজনৈতিক কারণ, যেমন-চাঁদাবাজি। বস্তুত এসব সমস্যা সমাধানের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি ‘কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিল’ আছে, যার প্রধান স্বয়ং অর্থমন্ত্রী। খুবই শক্তিশালী কাউন্সিল। এটা মুদ্রানীতি, রাজনীতি ও বাণিজ্যনীতির সমন্বয়ের জন্য গঠিত হয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এতদসত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি কমেনি। অজুহাত দেওয়া হলো করোনা মহামারিকে, দোষ দেওয়া হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে। এ দুটি ঘটনা বেশ কিছুটা দায়ী মূল্যস্ফীতির জন্য-একথা কেউ অস্বীকার করে না। কিন্তু এমনও দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের মূল্য কমেছে বা কমছে-অথচ স্থানীয় বাজারে তার কোনো প্রভাব নেই। সরকার রাজস্ব হ্রাসের মাধ্যমে অর্থাৎ শুল্কনীতিতে পরিবর্তন এনে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। তাও সফল হয়নি। শুল্ক হ্রাস করা হলেও এর সুবিধা গ্রাহক/ভোক্তারা অতীতেও পায়নি, আজও পাচ্ছে না। এরই মধ্যে অজুহাত দেওয়া হলো ‘সিন্ডিকেটের’। সিন্ডিকেটই দায়ী মূল্যস্ফীতির জন্য। এই সিন্ডিকেট ইস্যুতে বিগত সরকারের মন্ত্রীরা ছিলেন দ্বিধাবিভক্ত। একদিকে বলা হলো, বাজার অর্থনীতিতে সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই। অন্যদিকে বলা হলো, প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন, আমদানি ও বণ্টনের ক্ষেত্রে মাত্র কয়েকটি বিগ বিজনেস ফার্ম পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আবার রয়েছে প্রশাসনিক ব্যবস্থা। জেলা প্রশাসকরা নামেন বাজার নিয়ন্ত্রণে। রয়েছে ভোক্তা অধিকার সংস্থা। তারা নিয়মিত বাজার মনিটর করে। এদিকে রয়েছে খোলাবাজার নীতি। টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিতরণ হচ্ছে। এক কোটি কার্ডের মাধ্যমে গরিবদের মধ্যে কিছু পণ্য বিতরণ করা হচ্ছে। এতসব পদক্ষেপের পরও কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসছে না। অথচ এটি এখন ফরজ কাজ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ রয়েছে। বস্তুত মূল্যস্ফীতি এবং মজুরির অবস্থা এমন যে, মানুষের পক্ষে সংসার চালানো সম্ভব নয়। শ্রমজীবী মানুষ ইতোমধ্যে বলছেন, তাদের দৈনিক রোজগার কমেছে। সব রিকশাওয়ালা প্রায় একই কথা বলেন। বহু লোকের চাকরি যাচ্ছে। ব্যবসার অবস্থা খারাপ থাকায় বেসরকারি খাতে চাকরির সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসছে। একদিকে মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে মজুরি হ্রাস মানুষকে ভীষণ বিপাকে ফেলেছে। জানি না, একেই কি গভর্নর সাহেব বলেছেন, অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্যই সরকারের পতন হয়েছে। যদি তাই হয়, তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক নম্বর দায়িত্ব হচ্ছে অতিসত্বর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। কোনো ওজর-আপত্তি আর নয়। যথেষ্ট সময় পার হয়েছে। শ্রীলংকা এত বড় সংকটের পরও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। পাকিস্তানও তাই করছে। প্রতিবেশী ভারত তো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে নজির স্থাপন করছে। আমরা তাহলে ব্যর্থ হচ্ছি কেন?
দেখা যাচ্ছে, সরকার বড় একটা অস্ত্র ব্যবহার করছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। আর তা হচ্ছে সুদের হার। ব্যাংক ঋণের সুদের হার ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা কী হচ্ছে, তা যেমন বিবেচ্য বিষয়, তেমনি বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে আমানতকারীদের স্বার্থ। ব্যাংকগুলো ঋণের ওপর সুদের হার চড়া করে তাদের মুনাফা বাড়িয়ে নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার সুবিধা এক ছটাকও দিচ্ছে না আমানতকারীকে। মূলত সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সুদের হারে নয়-ছয় নীতি করে যেমন আমানতকারীদের ঠকিয়েছিলেন, তেমনি আজও একই অবস্থা বিরাজ করছে। ব্যাংকগুলোর ‘স্প্রেড’ ক্রমেই বাড়ছে। অনেকের ধারণা, খারাপ ঋণের বিপরীতে ‘প্রভিশন’ রাখার জন্যই তারা তা করছে। একদিকে যেমন এই অবস্থা, অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা কিন্তু উচ্চ সুদহারে তাদের অসুবিধার কথা প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছেন। কাগজে দেখলাম, ব্যবসায়ীদের একজন বড় নেতা এ কে আজাদ সুদহার বৃদ্ধির বিরোধিতা করেছেন। তার মতে, সুদহার বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের কথা বিবেচনা করা হয়নি। গত অর্থবছরে রপ্তানি আয় কমেছিল ২ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা কমছে ৪ বিলিয়ন ডলার। তিনি আরও বলেছেন, গ্যাসের দাম বেড়েছে ২৮৮ শতাংশ, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৩৩ শতাংশ, পরিবহণ খরচ বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। এর বিপরীতে রপ্তানি পণ্যের দাম কমেছে ২ শতাংশের বেশি। এ কে আজাদ এই অবস্থায় প্রতিনিয়ত ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার বৃদ্ধির বিরোধিতা করেন। কাগজের খবরে দেখা যাচ্ছে, প্রায় একই মত ব্যক্ত করেছেন অন্যান্য ব্যবসায়ীও। এতে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদনীতির সঙ্গে ব্যবসায়ীরা একমত নন। এখানে দেখা যাচ্ছে, সুদনীতিতে আমানতকারীদের কোনো লাভ হচ্ছে না, ব্যবসায়ীদের কোনো লাভ হচ্ছে না, আবার মূল্যস্ফীতিও রোধ হচ্ছে না। এ পর্যন্ত বহুবার সুদের হার বৃদ্ধি করা হয়েছে। ঋণকে করা হয়েছে ‘দুর্লভ’ ও ‘ব্যয়বহুল’। কিন্তু দেশবাসী কোনো ফল পাচ্ছে না। অথচ ইতোমধ্যে অনেক কারণের মধ্যে মূল্যস্ফীতির কারণে সরকার পর্যন্ত পরিবর্তন হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াল?
আমরা বিপরীতধর্মী দুটি অবস্থার মুখোমুখি। এক নম্বর, মূল্যস্ফীতি রোধ করতেই হবে। কারণ মানুষকে বাঁচাতে হবে। মানুষ মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট। এর পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিক রাখতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরিণামে দেশেরই ক্ষতি। শত হোক উৎপাদন বন্ধ, রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তো কোনো লাভ হলো না। এ রকম আরেকটি সমস্যার মুখোমুখি আমরা। সেটাও ব্যাংকিং ক্ষেত্রে। ভীষণ বড় সমস্যা। খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে। ব্যাংক লুটেরাদের বিচার করতে হবে। আবার বিপরীতে কল-কারখানার উৎপাদন ঠিক রাখতে হবে। রপ্তানি ঠিক রাখতে হবে। কর্মসংস্থান ঠিক রাখতে হবে। কোনোভাবেই মানুষকে কর্মচ্যুত করা যাবে না। অথচ এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বহু বড় ব্যবসায়ী এখন দেশত্যাগী, ফেরার, জেলে। অনেকে আছেন দৌড়ের ওপর। তাদের রয়েছে বড় বড় কারখানা, যেখানে হাজার হাজার লোক কাজ করে। তাদের কারখানাগুলো চালু রাখতে হলে তাদের উপস্থিতি দরকার, অথবা দরকার বিকল্প ব্যবস্থা, যাতে আমদানি/রপ্তানি ঋণপত্র খোলা যায়, সহায়-সম্পত্তি মর্টগেজ দেওয়া যায়, চেকবইয়ে সই করা যায়। অনেক কারখানা আগুনে পোড়া গেছে। সেসব পুনর্নির্মাণ করতে হবে। আবার উৎপাদনে আসতে হবে। কর্মচ্যুত শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে হবে। ওইসব কারখানার বিপরীতে ব্যাংক ঋণ আছে। তারা তাদের ঋণের কিস্তি দিতে পারবে, এমন আশা করা বাতুলতা। হয়তো করতে হবে পুনঃতফশিল। অথচ পুনঃতফশিল নীতি এখন অনেক শক্ত। ঋণ পাওয়াও কঠিন। অথচ নতুন ঋণ না পেলে ওইসব বন্ধ কারখানা চালু করা এক কঠিন কাজ।
স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, স্ববিরোধী অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক এক বাস্তবতার সম্মুখীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এদিকে রয়েছে রিজার্ভের ওপর চাপ। নতুন ঋণ, বৈদেশিক ঋণ দরকার। বেশি বেশি রাজস্ব দরকার। আইএমএফ নতুন নতুন শর্ত নিয়ে হাজির। বিনাশর্তে ঋণ মিলবে না। বকেয়া বিদেশি ঋণ পরিশোধও করতে হবে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি রোধের কাজটি কি প্রাধান্যে থাকবে?
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়