সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘের সংস্কার জরুরি
ডেভিড ডনোগু
প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
তিনটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে জাতিসংঘ দাঁড়িয়ে, যার প্রতিটি সমান গুরুত্বপূর্ণ ও পরস্পর নির্ভরশীল। সেগুলো হলো-টেকসই উন্নয়ন, শান্তি ও নিরাপত্তা এবং মানবাধিকার। ২০৩০ সালের জন্য টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডা গ্রহণ করার সময় ২০১৫ সালে বিশ্বনেতারা জোর দিয়েছিলেন এই বলে যে, ‘শান্তি ও নিরাপত্তা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়িত হতে পারে না।’ যখন এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছিল, তখন এ চুক্তিটি যে হবে, এর কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। শান্তির অন্বেষণকে একটি লক্ষ্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোর অনেকের মনেই দ্বিধা ছিল। তারা আশঙ্কা করেছিল, এটি অন্যায্য শর্ত প্রবর্তন করবে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
এসব দেশ জোর দিয়েছিল, এ চুক্তি শান্তির শর্ত প্রবর্তনের চেষ্টা করছে না। বরং এটি শুধু এ স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য যে, সহিংসতা-সংঘাত টেকসই উন্নয়নের জন্য সহায়ক নয়। সমঝোতার ফলাফল হিসাবে এসডিজি ১৬ বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়, যার মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান, আইনের শাসন, মানবাধিকার সুরক্ষা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে শান্তি ও উন্নয়ন অর্জনের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
আজও শান্তি ও টেকসই উন্নয়নের পারস্পরিক নির্ভরতা নিয়ে সন্দেহ আছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বেড়ে যাওয়া সশস্ত্র সংঘাত এই এসডিজির অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করার অন্যতম প্রধান কারণ। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে খাদ্য কিংবা জ্বালানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় এসবের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোয় প্রভাব পড়েছে। গাজায় চলমান যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
আরও সাধারণভাবে বললে, এ ধরনের সংকটের মেরুকরণের প্রভাব আন্তর্জাতিক ঐকমত্যকে নষ্ট করছে, যা এসডিজির ওপর প্রভাব ফেলছে এবং বহুপাক্ষিক সহযোগিতা ও সংহতির প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর প্রস্তুতিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। আমরা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ক্রমবর্ধমান নানা হুমকির বিশ্বে বাস করছি। এটি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রশ্নে জাতিসংঘের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, যা সংস্থাটির সনদের অধীনে সংস্থার প্রথম উদ্দেশ্য হিসাবে রয়েছে।
জাতিসংঘ কি একবিংশ শতাব্দীতে এ উদ্দেশ্য সাধনের উপযুক্ত? এর অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলো কি ১৯৪৫ সাল থেকে সংঘাত প্রতিরোধ এবং শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে সক্ষম? নাকি জাতিসংঘ বড় শক্তির প্রতিযোগিতার মধ্যে তার নিজস্ব সেকেলে নিয়মের কারণে অকেজো হয়ে পড়েছে? আশ্চর্যের ব্যাপার, এ ছোট বিষয়গুলো এবারের শীর্ষ সম্মেলনে অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে, যে সম্মেলন ২২-২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হয়।
সংলাপ, সমঝোতা ও সমঝোতার জন্য স্থান চিহ্নিত করতে এবং সদস্য দেশগুলোকে সংঘাত নিরসনে সহায়তা করার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকাকে পুনরুজ্জীবিত করা এর চেয়ে বেশি জরুরি ছিল না। মূল প্রশ্ন হলো, ক্রমবর্ধমান জটিল ও বহুমুখী সংকট মোকাবিলার জন্য জাতিসংঘের সক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিকভাবে কী করা দরকার। নিরাপত্তা পরিষদ স্পষ্টতই নৈরাজ্যবাদী, এর স্থায়ী সদস্যপদ এবং পরবর্তীকালে ভেটো অধিকারের মধ্যে প্রতিফলিত করে এমন একটি বিশ্বব্যবস্থা, যা দীর্ঘকাল আগেই পুরোনো হয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, কাউন্সিলের দুই-তৃতীয়াংশ আফ্রিকান বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত; কিন্তু আফ্রিকার কোনো স্থায়ী সদস্য নেই।
অনেক নেতৃস্থানীয় আঞ্চলিক ক্রীড়নক দেশ যেমন-ব্রাজিল, ভারত, জাপান ও জার্মানি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ পেতে আগ্রহী, যা বিদ্যমান পাঁচটি দেশের চেয়েও প্রভাবশালী বলে বিবেচিত হতে পারে। আমরা স্পষ্টভাবে একটি বহুমুখী বিশ্বে বাস করি, যেখানে কোনো রাষ্ট্রই, তা যত বড় বা শক্তিশালীই হোক না কেন, বিশ্বের চ্যালেঞ্জগুলো নিজে থেকে সমাধান করতে পারে না। সব রাষ্ট্রেরই মিত্রের প্রয়োজন হয়।
সাধারণ পরিষদে এসব বিষয়ের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক স্পষ্টভাবেই স্বীকৃত হয়। স্থায়ী সদস্যদের মধ্যে চুক্তির প্রয়োজনীয়তা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য কী হুমকি সৃষ্টি করে এবং কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কাউন্সিলের ক্ষমতাকে সীমিত করে। যদিও দীর্ঘদিন ধরে কাজের ক্ষেত্রে পাঁচটি দেশের মধ্যে অনৈক্য নিরাপত্তা পরিষদের একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে, যা গত কয়েক বছর ধরে ঐতিহ্যগত বিষয়েও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিরিয়া, ইউক্রেন ও গাজা নিয়ে তিক্ত সংঘাতের কারণে বাণিজ্য বিরোধ ও কৌশলগত উত্তেজনা আরও তীব্র হয়েছে। বিশ্বের আধিপত্য বিস্তারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা কাউন্সিলে মতবিরোধ আরও উসকে দিচ্ছে।
রাশিয়া নিয়মিতভাবেই খসড়া রেজুলেশনে ভেটো দেয়, যা সিরিয়া বা ইউক্রেনে তার স্বার্থকে হুমকি হিসাবে দেখে। ইসরাইলের স্বার্থ হুমকির মুখে পড়লে যুক্তরাষ্ট্রও তা-ই করে। এর প্রভাবে জাতিসংঘের এ মূল অঙ্গটির কাজ করার ক্ষমতাকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়। অচলাবস্থা ভাঙার প্রয়াসে ফ্রান্স বেশ কয়েক বছর আগে একটি উদ্যোগ নিয়েছিল, যাতে পাঁচটি দেশ স্বেচ্ছায় গণহত্যা বা মানবিক সংকট সম্পর্কিত খসড়া রেজুলেশনের ক্ষেত্রে তাদের ভেটো ব্যবহার সীমিত করে। তবে প্রস্তাবটি বলতে গেলে ধামাচাপাই পড়ে গেছে।
আমরা যে বিশ্বে বাস করি, নিরাপত্তা পরিষদকে সেক্ষেত্রে আরও বিস্তৃত প্রতিনিধিত্বমূলক হতে হবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, উদীয়মান আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ভূমিকা ও প্রভাব স্বীকার করে আমাদের এমন একটি কাউন্সিলের প্রয়োজন, যেটি পাঁচ স্থায়ী সদস্যের ভেটো ক্ষমতা সীমিত করবে ও আদর্শিকভাবে পরিহার করবে। জাতিসংঘের শান্তি বিনির্মাণে ভূমিকা ও মধ্যস্থতা ক্ষমতার পুঙ্খানুপুঙ্খ সংস্কার, সশস্ত্র সংঘাতে আটকে পড়া বেসামরিক নাগরিকদের জন্য শক্তিশালী সুরক্ষা এবং অন্যান্য সংস্কারের একটি পরিসীমারও প্রয়োজন। সর্বোপরি, বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জাতিসংঘের সনদে নির্ধারিত নীতি ও প্রক্রিয়ার প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্নির্ধারণের জন্য আমাদের সব সদস্য রাষ্ট্রের সদিচ্ছা প্রয়োজন।
আলজাজিরা থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর : খালিদ বিন আনিস
ডেভিড ডনোগু : জাতিসংঘে আয়ারল্যান্ডের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি