ঋণখেলাপি ও দুর্নীতিবাজদের সম্পদ জব্দ করা হোক
এম এ খালেক
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান দুটি চেতনার একটি ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। অর্থনৈতিক বৈষম্য সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হলে প্রথমেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত যত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, তারা মুখে বললেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কেউই আন্তরিক ছিলেন না। দিন যতই গড়িয়েছে, দুর্নীতির মাত্রা ততই বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) ২০০১ সালে প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদনে দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশকে বিশ্বের এক নম্বর দেশ হিসাবে আখ্যায়িত করেছিল। ২০০১ সালে টিআই দুর্নীতির যে ধারণা সূচক প্রকাশ করেছিল তার ভিত্তি বছর ছিল ২০০০ সাল, তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর গত সাড়ে ১৫ বছরে দুর্নীতি কতটা বেড়েছে তা ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন হয় না। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সুযোগ পেলেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের গৃহীত ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা বলা হতো। কিন্তু দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তারের কারণে জিরো টলারেন্স নীতি কার্যত উপহাসের বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। গত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের স্বেচ্ছাচারী শাসনামলে দেশের প্রতিটি সেক্টরকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণের মাধ্যমে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা হয়েছিল। সেই অপকর্মের দায়ভার এখন জাতি বহন করছে।
গত সাড়ে ১৫ বছরে অর্থনীতির যে খাতটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা হলো ব্যাংক খাত। একটি দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংক খাতকে ‘লাইফ লাইন’ বলা হয়। দুর্নীতিবাজ আর অর্থ পাচারকারীদের অবাধ বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল ব্যাংক খাত। সাম্প্রতিক সময়ে প্রচলিত ব্যাংকিং আইনগুলো এমনভাবে সংস্কার করা হয়েছে যা কতিপয় ব্যক্তি ও পরিবারের স্বার্থ উদ্ধারে নিবেদিত ছিল। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতে সংঘটিত ২৪টি বড় ধরনের দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির ঘটনার মাধ্যমে ৯৩ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। এ অর্থের বেশির ভাগই লোপাট করেছেন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের ঘনিষ্ঠজনরা। গত সরকারের আমলে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিবেচনায় বহু ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যেগুলো এখন ভালোভাবে চলছে না।
গত সরকার আমলে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ শুধু বেড়েছে। যেসব ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তার বেশির ভাগই খেলাপি হয়েছে। ফলে ব্যাংকিং সেক্টর এখন তারল্য সংকটে পতিত হয়েছে। অধিকাংশ ব্যাংক তারল্য সংকটের কারণে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ঋণ দিতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে দেশের ব্যাংক খাতে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার গঠনকালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় খেলাপি ঋণের পরিমাণ কীভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে পরিসংখ্যান প্রদর্শন করছে তা প্রকৃত চিত্র নয়। আইনি মারপ্যাঁচে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণকে আড়াল করে রাখা হয়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর জন্য আন্তর্জাতিক মানের সংজ্ঞাগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে। ঋণ হিসাব অবলোপন ও ঋণ হিসাব পুনঃতফশিলিকরণ নীতিমালা সহজীকরণ করা হয়েছে। যাতে ঋণের কিস্তি আদায় না করেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানো যায়। মামলাধীন প্রকল্পগুলোর কাছে ব্যাংকের দাবিকৃত ঋণকে খেলাপি হিসাবে প্রদর্শন করা হয়নি। এগুলো খেলাপি ঋণ হিসাবে প্রদর্শন করা হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করে যাবে বলে অনেকেই মনে করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। এর বেশির ভাগই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে পাচার হচ্ছে। অর্থ পাচারের এ হিসাব চূড়ান্ত নয়। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই অর্থ পাচারের সঠিক এবং পূর্ণাঙ্গ হিসাব দিতে পারবেন না। কারণ যারা অর্থ পাচার এবং অবৈধ উপায়ে অর্থ অর্জন করেন তারা কারও কাছে তাদের অর্থের পরিমাণ ও উৎস প্রকাশ করেন না। তবে বাংলাদেশ থেকে গত প্রায় ষোলো বছরে যে পরিমাণ দুর্নীতি এবং অর্থ পাচার হয়েছে তা যে কারও মনেই বিস্ময়ের সৃষ্টি করবে। সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তিসহ তার পরিবার এবং তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক মাত্রায় অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনোই এত ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। যারা দেশের বড় বড় আর্থিক দুষ্কৃতকারী অতীতে তারা প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবেই ব্যাংক ঋণের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য প্রধান এবং সবচেয়ে জটিল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থনীতিকে আবারও সঠিক পথে পরিচালিত করা। বিশেষ করে খেলাপি ঋণ আদায়ের মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ব্যাংকিং সেক্টরের সমস্যা সমাধানের জন্য অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, এ সেক্টরে যে পর্বতপ্রমাণ খেলাপি ঋণ রয়েছে তা আদায়ের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নতুন গভর্নর ব্যাংকিং সেক্টরের বিদ্যমান সমস্যার স্বরূপ অনুসন্ধান ও তা প্রতিকারের জন্য পন্থা খুঁজে বের করার জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠনের কথা বলেছেন। ব্যাংক খাত নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে। এ মুহূর্তে একটি জটিল বা জরুরি সমস্যা হচ্ছে বেশ কিছু ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে। এসব ব্যাংককে যদি তরল অর্থ না দেওয়া যায় তাহলে তারা আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারবে না। এমনকি দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করতেও ব্যর্থ হবে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমানতকারীরা একযোগে এসব ব্যাংক থেকে আমানত উত্তোলন শুরু করবে। সে অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দেশে কোনো ব্যাংক দেউলিয়া না হোক আমরা যদি এটা চাই তাহলে প্রথমেই সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর জন্য তরল অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে হবে। কাজেই ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হলে কমিশনের প্রথম কাজ হবে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে আলাদা করে চিহ্নিত করা। সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে দুটি ভাগে বিভক্ত করতে হবে। দেখতে হবে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে কোনগুলো উদ্ধারযোগ্য এবং কোনগুলো উদ্ধারযোগ্য নয়। যেগুলো উদ্ধারযোগ্য তাদের তরল অর্থের জোগান দেওয়াসহ নানা ধরনের পলিসি সাপোর্ট দিতে হবে। যেগুলো উদ্ধারযোগ্য নয় সেখানে আর কোনো টাকা দেওয়া উচিত হবে না। দেউলিয়াত্ব রোধ করার জন্য যতটা প্রয়োজন তাই করতে হবে। সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে অর্থ সরবরাহ করতে হবে।
যারা বৃহৎ ঋণখেলাপি তাদের গৃহীত ঋণের বিপরীতে কী পরিমাণ সম্পদ আছে তা খুঁজে বের করতে হবে। সে সম্পদ বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যেতে পারে তা দিয়ে তার গৃহীত ঋণের অর্থ পুরোটা আদায় করা যাবে কি না, তা যাচাই করে দেখতে হবে। যদি বন্ধকিকৃত সম্পদ বিক্রি করে ঋণ পুরোপুরি আদায় করা না যায় তাহলে সংশ্লিষ্টদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্য কোর্টের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। দরকার হলে বিদ্যমান আইন সংশোধন করা যেতে পারে। আর যদি ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে নগদ অর্থ উদ্ধার করা যেতে পারে তাহলে কোনো ঝামেলায় যেতে হবে না। তবে নগদ অর্থ উদ্ধার হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই তাদের সম্পদ আটক করে তা বিক্রির ব্যবস্থা করা হলেও টাকা উদ্ধার হতে পারে। সাধারণভাবে ঋণগ্রহীতারা ঋণের বিপরীতে যে সম্পদ বন্ধক দেয় তা অতিমূল্যায়িত করে দেখানো হয়। কাজেই বন্ধকি সম্পদ বিক্রি করে পুরো ঋণের অর্থ আদায় করা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে তা বিক্রি করার উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যাংক খাত এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যারা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
এম এ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক; অর্থনীতিবিষয়ক লেখক