নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
ব্যাংক সংস্কারে কমিশন নয়, টাস্কফোর্স
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছিলাম ‘ব্যাংকিং কমিশনের’ কথা। বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের অনেকেরও কথা ছিল ব্যাংকিং কমিশনের। এখন আমরা সপ্তাহখানেক আগে পেয়েছি ‘টাস্কফোর্স’। তাদের কাজ হবে ব্যাংক খাতের সংস্কারের ওপর সুপারিশ করা। কাগজে দেখলাম, ছয় সদস্যবিশিষ্ট এই টাস্কফোর্সের প্রধান কাজ তিনটি : ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরা, ব্যাংকের খারাপ ঋণের (ডিসট্রেসড অ্যাসেট) চিত্র তুলে ধরা এবং ব্যাংক খাতের ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করা। অবশ্যই তারা এসব বিষয়ে তাদের সুপারিশ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা দেবেন। কাগজ পড়ে মনে হয়েছে, টাস্কফোর্সটি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাইরে থেকে আমরা যা বুঝি, তাতে মনে হয় ‘কমিশন’ করলে তা করত সরকার-যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন এবং নির্বাচন কমিশন। টাস্কফোর্স ও কমিশনের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে দৃশ্যত। সে যাই হোক, আমরা চেয়েছিলাম ‘কমিশন’, পেয়েছি ‘টাস্কফোর্স’। তবু মন্দের ভালো। দেখা যাক তারা কিছুদিন পর কী কী সুপারিশ করেন।
সুপারিশের পর হচ্ছে বাস্তবায়নের কাজ। এই যেমন, ব্যাংকিং কমিশন একটা গঠিত হয়েছিল ১৯৮৪ সালের দিকে। এর নাম ছিল ‘ন্যাশনাল কমিশন অন মানি, ব্যাংকিং অ্যান্ড ক্রেডিট।’ সম্ভবত এরপর ১৯৯৬ সালের দিকে একটা কমিশন গঠিত হয়েছিল। তাছাড়া দু-একবার ‘ব্যাংকিং কমিটি’ও গঠিত হয়েছিল। সব ক্ষেত্রেই কিছু না কিছু কাজ হয়েছিল, সুপারিশ প্রণীত হয়েছিল। ১৯৮৪ সালের কমিশনটি ছিল খুবই শক্তিশালী। তাদের কাজও ছিল ব্যাপক। ১৯৯০-এর দিকে কাজ করে ‘ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর রিফর্ম প্রোগ্রাম।’ অনেক ব্যয় ছিল এতে। মুশকিল হচ্ছে, এসবের ফলাফল পরে আর দৃশ্যমান হয়নি। যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। একটা উদাহরণ দিই। সংস্কারের একটি ফল ছিল সরকারি ব্যাংকগুলোকে ‘ন্যাশনালাইজেশন অর্ডার-১৯৭২’ থেকে বের করে এনে লিমিটেড কোম্পানি করা। করা হয় সব সরকারি ব্যাংককে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি, যেমন সোনালী ব্যাংক লিমিটেড। এখন এর নাম সোনালী ব্যাংক পিএলসি। এই যে সংস্কার, তার উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংকগুলোকে সরকারি দৈনন্দিন নিয়ন্ত্রণের আওতা থেকে বের করে স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়া। কীভাবে চলবে? অন্যান্য ‘পাবলিক লিমেটেড কোম্পানি’ যেমন ‘কোম্পানিজ অ্যাক্ট-১৯৯৪’ মোতাবেক চলে, তেমনি সরকারি ব্যাংকগুলোও ওইভাবে চলবে। দায়-দায়িত্ব সব ওইসব ব্যাংকের ‘বোর্ডের’। ‘বোর্ড’ গঠিত হবে সরকার দ্বারা, যেহেতু সরকার মালিক। কথা ছিল এ ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে যাবে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। একটি সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকও শেয়ারবাজারে যেতে পারেনি এখন পর্যন্ত। এবং মজার বিষয় হলো, সরকারি ব্যাংকগুলোর স্বায়ত্তশাসন তো দূরের কথা, এগুলো শেষ পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ‘আমলা-কামলারা’ ব্যাংকিং বিভাগ তৈরি করে এক্ষেত্রে দ্বৈতশাসন চালু করে। একদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অন্যদিকে ‘ব্যাংকিং বিভাগ’। ব্যস, চলছে এভাবেই।
কত দাবি মানুষের। ব্যাংকারদের ব্যাংকিং বিভাগ তুলে দেওয়া হোক। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মকানুনের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক সরকারি ব্যাংকগুলোকে। এসব কথা বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের অন্তত তিনজন বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা ভালো করেই জানেন। হা হতোস্মি! এসব হয়নি। এ অবস্থায় আমরা আশা করেছিলাম, এবার অন্তত এর অবসান ঘটবে। কারণ যারা দাবি করেছিলেন তারাই সরকারে। কিন্তু সোয়া মাস গত হলেও এক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে শুনিনি। আমি কি ভুল? মনে হয় না। এ কারণেই প্রশ্ন বাস্তবায়নের। দেশে আইন-বিধি-নিয়ম অনেক আছে। বাস্তবায়ন নেই। ‘আমলা-কামলারা’ সব খেয়ে বসে আছে। এ প্রেক্ষাপটে কি আমরা এবার আশা করতে পারি যে ব্যাংকিং বিভাগের নিয়ন্ত্রণে দ্বৈতশাসনের বাইরে সরকারি ব্যাংকগুলো আসবে? কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার মর্যাদা ফিরে পাবে? জানি না। আমার তো মনে হয় এ দিয়েই শুরু হওয়া উচিত ব্যাংক খাতের সংস্কার।
দ্বিতীয় কথাটা আরও গুরুত্বপূর্ণ। একটি ব্যাংক চলে কীভাবে? দৈনন্দিন ব্যাংকিং কার্যক্রমের জন্য একমাত্র দায়ী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী (সিইও)। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নিয়ম মেনে ব্যাংকের বোর্ডের নীতিমালার অধীনে ব্যাংক চালাবেন। চালাতে গিয়ে ‘ডেলিগেশন অব পাওয়ারে’র অধীনে অধস্তন কর্মকর্তাদের কাছে ক্ষমতা প্রত্যর্পণ করবেন। এখানে একমাত্র বিবেচ্য বিষয়, ‘ডেলিগেশন অব পাওয়ার’ অনুযায়ী যে যার কাজের জন্য দায়ী থাকবেন। যেসব কাজের জন্য প্রধান নির্বাহী সিদ্ধান্ত নেবেন, তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তার। আর ব্যাংকের বোর্ডে যা যাবে, তার জন্যও সম্পূর্ণ দায়ী প্রধান নির্বাহী। কারণ বোর্ডের নির্বাহী কোনো ক্ষমতা নেই। বোর্ডের চেয়ারম্যান, পরিচালক, অডিট কমিটি, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিটি ইত্যাদির দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাদের দেনা-পাওনাও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত। প্রধান নির্বাহীর সই ছাড়া বোর্ডে ভালো-মন্দ কোনো ‘মেমো’ যায় না। ভালোটাও যেমন যায়, তেমনি খারাপটিও যায় প্রধান নির্বাহীর সইয়ে। অতএব ব্যাংকে কোনো ‘মন্দ’ বড় কাজ, অনৈতিক কাজ, নিয়মবহির্ভূত কাজ প্রধান নির্বাহীর সইয়ের বাইরে হয় না। কারণ বোর্ডের দৈনন্দিন ব্যবসাক্ষেত্রে কোনো এখতিয়ার নেই। অনৈতিক ও নিয়মবহির্ভূত কাজ করাতে হলে ‘বোর্ড’ অথবা কোনো পরিচালক অথবা কোনো চেয়ারম্যান সেটা করবেন প্রধান নির্বাহীর মাধ্যমে। প্রধান নির্বাহী রাজি না হলে কোনো কিছুই বোর্ডে যাবে না। এক্ষেত্রে প্রধান নির্বাহী যদি ‘মেরুদণ্ডের’ ওপর দাঁড়িয়ে না থাকেন, তাহলে অনৈতিক কাজ করা খুব সহজ। এটা আরও সহজ হয় কারণ, বোর্ড এমন একজন প্রধান নির্বাহীকে নির্বাচিত করে, যে হবে চেয়ারম্যান বা প্রভাবশালী পরিচালকদের বশংবদ। ওই প্রধান নির্বাহী লোভ-লালসা, বাড়ি-গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ ইত্যাদির লোভে মালিকদের আজ্ঞাবহ হন। প্রকৃত দক্ষতা ও মেধার দ্বারা এখন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী হয় এমন ঘটনা বিরল। সরকারি ব্যাংকে হয় মন্ত্রণালয়ের প্রভাবে। ওই প্রভাব নিয়ন্ত্রিত হয় অনেক সময় অর্থের বিনিময়ে। ব্যাংকের বড় সমস্যা এখন একটিই-খেলাপি ঋণ। এর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মনীতি যেমন দায়ী, যেমন দায়ী বোর্ড, তেমনি সমান দায়ী প্রধান নির্বাহীরাও। একেকজন প্রধান নির্বাহী একেকটি ব্যাংকে ৫-১০ বছর চাকরিতে থেকে এক ‘সাম্রাজ্য’ গড়ে তোলেন। নিজস্ব আজ্ঞাবহ অফিসারদের ওপরে তোলেন, বাকিদের করেন অবহেলা। এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে কোনো প্রধান নির্বাহী যখন যান, তখন তিনি আজ্ঞাবহ অফিসারদের নিয়ে গিয়ে একটা ‘গ্যাং’ গড়ে তোলেন। এমনকি ১০ বছর প্রধান নির্বাহী হিসাবে থাকার পরও নিয়মের বাইরে তাকে উপদেষ্টা করার নজিরও আছে। কী মধু ব্যাংকে যে প্রধান নির্বাহীকে মালিকরা ছাড়তে চান না। এ অবস্থায় আমার ধারণা, এক নম্বর কাজ হবে নিয়মনীতির অধীনে প্রত্যেক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে ‘ফিক্স’ করা। সব বড় ভালো-মন্দ কাজের জন্য তাকে দায়ী বা পুরস্কৃত করা। এখানে কোনো ওজর-আপত্তি চলবে না। আর প্রধান নির্বাহী ব্যাংক চালাবেন ‘ব্যাংক কোম্পানি অ্যাক্ট-১৯৯১ অনুযায়ী; বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী। চালাবেন পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি যেভাবে চলে, সেভাবে। এক কথায়, মালিক/চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহীর ‘নেক্সাস’ ভাঙতে না পারলে কোনো সংস্কারই কাজে আসবে না। গোড়ায় অবশ্য একটা গলদ আছে। আমরা দুষ্ট রাজনীতিকদের হাতে পড়ে ব্যাংক, রাজনীতি, অর্থনীতি, মালিকানাকে এক করে ফেলেছি। ব্যাংকের মালিকরা ব্যবসায়ী, তারাই সংসদ-সদস্য, তারাই আমদানিকারক, শিল্পপতি, বড় ব্যবসায়ী। এতেই হয়েছে সর্বনাশ। এমনকি এই চক্করের সুবিধা নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রভাবশালী একটা অংশ কয়েকটা ব্যাংক বানিয়ে দেশ থেকে প্রচুর অর্থ লোপাট করেছে। রাজনীতি-অর্থনীতি-ব্যাংকিংকে আলাদা করার কাজও জরুরি।
আরেকটি কথা। আমরা বাণিজ্যিক ব্যাংকিংকে দীর্ঘমেয়াদি ফিন্যান্সিংয়ে জড়িত করে ফেলেছি। আগে শিল্পের ফিন্যান্স, পুঁজি ইত্যাদির জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান, যেমন-বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক, বাংলাদেশ শিল্পঋণ সংস্থা ছিল। দেনার দায়ে এসব প্রতিষ্ঠান এখন বিলুপ্ত। এ দুটি এখন বাণিজ্যিক ব্যাংক। আর বাণিজ্যিক ব্যাংক এখন করছে শিল্প পুঁজি ফিন্যান্স। এমনকি কৃষি ব্যাংক পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকিং করছে। আমার মতে, অভিজ্ঞতার আলোকে এ প্রবণতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত। ‘ব্যাংক ফিন্যান্স লেড গ্রোথ’-এই দর্শন আমাদের জন্য বিপদ ডেকে এনেছে। পুঁজিবাজার ধ্বংস হয়েছে। এদিকে নজর দেওয়া হয়নি। মিউচুয়াল ফান্ড, বন্ড মার্কেট গড়ে তোলা হয়নি। সব ব্যবসায়ী ছোট-মাঝারি-বড় ব্যবসার পুঁজির জন্য, অর্থায়নের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকে এসে জড়ো হয়েছেন। আর এতেই হয়েছে সর্বনাশ। এর থেকে বেরোনোর পথ কী, তা খোঁজা দরকার। সম্ভবত এখানেই নিহিত খেলাপি ঋণের সমাধান!
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়