Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

পাশবিকতার উন্মত্ততা প্রকাশ

Icon

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পাশবিকতার উন্মত্ততা প্রকাশ

বুধবার দেশের দুটি শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু উন্মত্ত ছাত্রের হাতে পিটুনির শিকার হয়ে অকালে দুটি তাজা প্রাণ ঝরে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে মানসিক ভারসাম্যহীন একজন লোককে ওই হলের কিছু ছাত্র চোর সন্দেহে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলে সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতাকে কিছু ছাত্র পিটিয়ে হত্যা করেছে। যদিও দুটি ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অপরাধ সংঘটনকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। ঘটনার নৃশংসতা এবং সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানে দীর্ঘকাল ধরে জনগণের ঘাড়ে চেপে বসা স্বৈরশাসকের বিদায়ের মাত্র মাসখানেকের মাথায় দেশের দুটি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের ঘটনা দেশবাসীকে হতবিহ্বল করে দিয়েছে। ঘটনায় জড়িতদের কারও কারও নামের সঙ্গে ছাত্র সমন্বয়কের পরিচয় যুক্ত থাকায় মানুষের হতাশা আরও বেড়েছে। তাদের কেউ কেউ ইতঃপূর্বে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে, যা থেকে অনেকেই আবার ভিন্ন কিছুর গন্ধ খোঁজারও চেষ্টা করছেন।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোয় মারামারি-কাটাকাটি একটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয় এবং এর ফলে অনেক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। দেখা গেছে, ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তারকারী ছাত্র সংগঠনগুলোর কর্মীরা নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত হয়ে কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বা শায়েস্তা করতে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। সাম্প্রতিক দশকগুলোয় এক্ষেত্রে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের তৎপরতা এক জঘন্য আকার ধারণ করে। দেখা গেছে, প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠনগুলোর কোনো কোনোটির তৎপরতার ওপর তারা একরকম অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে এবং মাঝেমধ্যেই এসব সংগঠনের কর্মী সন্দেহে একে-ওকে ধরে এনে তাদের ওপর অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালাচ্ছে। অনেক সময় সাধারণ ছাত্রদেরও সময়ে অসময়ে ‘ম্যানার’ শেখানোর নামে তারা এভাবে নির্যাতন করত বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০১৯ সালে বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমবারের মতো ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের এ ধরনের নির্যাতন চালানোর বিষয়টি সর্বসাধারণের নজরে আসে। একজন ছাত্রকে এ রকম নির্দয়ভাবে পিটিয়ে মারার ঘটনায় পুরো দেশ শিউরে ওঠে। কিন্তু যে বিষয়টি অনেকের তখনো জানা বাকি ছিল তা হলো, এভাবে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের সদস্য কিংবা সাধারণ ছাত্রদের ধরে পেটানো ছিল তাদের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ। নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজ থেকে চেপে যাওয়া কিংবা গণমাধ্যমের সেল্ফ সেন্সরশিপ/পক্ষপাতের কারণে এসব ঘটনা খুব কমই আমাদের নজরে আসত। সেদিন যদি আবরার প্রাণে মারা না পড়ত, তাহলেও হয়তো বা এসবের বিন্দু-বিসর্গও আমাদের গোচরে আসত না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে শুধু বুয়েট নয়, সারা দেশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বহু বছর ধরে এই কালচার প্র্যাকটিস হয়ে আসছিল, যার ছিটেফোঁটা হয়তো বড় আকারের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই কেবল আমাদের নজরে আসত।

প্রশ্ন হলো, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ক্ষমতাধর ছাত্র সংগঠনের কিছু কর্মীর মধ্যে এ ধরনের ভয়াবহ উন্মত্ততা কীভাবে তৈরি হয় বা হতো? যে ছেলেটা প্রথম বর্ষে ভর্তির সময় রীতিমতো কম্পমান থাকত, সে হঠাৎ বছর না ঘুরতেই এ রকম দানব হয়ে ওঠে কীভাবে? বিষয়টি কী এমন যে, জেনেটিক্যালি তার মধ্যে এ ধরনের অপরাধপ্রবণতা থাকে? নাকি পরিবেশ তার মধ্যে এমন দানবীয় চরিত্র সৃষ্টি করে? হয়তো বা দুটোই। তবে একটি কারণ সম্ভবত এই যে, এই ছেলেগুলোর মধ্যে ক্ষমতা ও নেতৃত্বের প্রতি বিশেষ মোহ কাজ করে। তারা যখন দেখে, এ ধরনের নিষ্ঠুরতা তাদের ওপর উঠতে সহায়তা করবে, তখন তারা পারফরম্যান্স দেখাতে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং কালক্রমে তাদের স্বাভাবিক হৃদয়বৃত্তি হারিয়ে যায়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের যে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে তার একটি কারণ ছিল সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর এ ধরনের নিষ্ঠুরতা। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সে যুগের তো অবসান হয়েছে। নতুন করে আমাদের ফের একইরকমের নিষ্ঠুরতা প্রত্যক্ষ করতে হবে কেন?

এবার ঘটনার অন্যদিকে একটু নজর দেওয়া যাক। সাধারণভাবে গণপিটুনির এই কালচার আমাদের সমাজে কতটা বিস্তৃত? খেয়াল করলে দেখবেন, চোর, পকেটমার, ছেলেধরা ইত্যাদি সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার অনেক ঘটনা এদেশের সংবাদপত্রগুলোয় বিভিন্ন সময়ে হেডলাইন হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় দেখা যায়, দু-একজন কারও গায়ে হাত তুলছে। এরপর আরও দশজন জড়ো হয়ে তার ওপর নির্বিচারে কিল-ঘুসির বৃষ্টিবর্ষণ করছে। কেউ তা পছন্দ না করলেও হয় বাধা দেওয়ার সাহস করে না অথবা কুলিয়ে উঠতে পারে না। অনেকেই আবার নিজেকে ঝামেলায় না জড়ানোর জন্য পাশ কাটিয়ে চলে যায়। এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় যে, এ ধরনের ঘটনার খুব ছোট্ট অংশই সংবাদপত্রে আসে।

এভাবে একজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যা যে গ্রহণযোগ্য নয়, সেটা নিয়ে খুব কম লোকই দ্বিমত পোষণ করবে। কিন্তু এসব তো ঘটছে, বারবার ঘটে চলেছে। এখান থেকে কি আমরা বেরিয়ে আসতে পারব না? আর এ ধরনের একটি ঘটনা যখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বা হলে ঘটে, তখন প্রশাসনের সময়োচিত হস্তক্ষেপ এটাকে অন্তত মাঝপথে ঠেকিয়ে দিতে পারে। তাদের কেউ কি জানায় না, নাকি তারা খবর পেয়েও রেসপন্ড করেন না? কেন?

‘মব জাস্টিসের’ ভয়ংকর দিক হলো, এতে যে কোনো সময় নিরপরাধ লোক ভিক্টিম হতে পারে। কাজেই এটাকে মেনে নেওয়ার বা প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এর বিরুদ্ধে আমাদের বলে যেতে হবে এবং এখান থেকে যে কোনো মূল্যে বেরিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থার অভাব। আমাদের এই জায়গাটা ঠিক করতে হবে। বিচার যাতে দ্রুত হয় এবং অপরাধীরা পার না পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের একটি ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য এখনই উপযুক্ত সময়। আশা করি, এদিকে সবাই মনোযোগ দেবেন। পাশাপাশি আরেকটি বিষয় বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। সেটা হলো, তরুণ প্রজন্মকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দিয়ে সুশৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তোলা। এটা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে যেমন করা প্রয়োজন, তেমনি আমাদের কারিকুলামেও এদিকে আরও গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনার সময় এসেছে।

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম