নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
দুর্নীতি দমনের দাওয়াই কী?
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঘুস-দুর্নীতির সঙ্গে কাজের, বিশেষ করে সরকারি কাজের কি কোনো সম্পর্ক আছে? প্রশ্নটির উত্তর এত সহজ নয়। ঘুসের সঙ্গে সরকারি কাজের কী সম্পর্ক, তা নিয়ে জনগণের একটা ধারণা আছে। এমনকি ধারণা আছে সরকারের কর্তাব্যক্তিদেরও। এ সম্পর্কে সাবেক অনেক মন্ত্রী, বিশেষ করে অর্থমন্ত্রীরা বেশকিছু মন্তব্য রেখে গেছেন। বলে গেছেন, ঘুস ছাড়া কাজ হয় না। অনেকে অবশ্য সরকারি অফিসের এ ঘুসকে ‘টেবিল মানি’ বলেন। অনেকে ভদ্রভাবে বলেন ‘স্পিড মানি’। কত সুন্দর নাম! যত না সুন্দর, তার চেয়ে বেশি ভীতিকর। কারণ এ ঘুস-দুর্নীতি আমাদের তিলে তিলে খাচ্ছে।
সমস্যাটি এবং এর সমাধানের ক্ষেত্রে কী কী করণীয় এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য একটি ঘটনা বলি। ঘটনাটি মতিঝিলের বিখ্যাত একটি বাণিজ্যিক অফিসের। কয়েক বছর আগের কথা। চৌকশ একজন নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এলেন বিদেশে চাকরি করার অভিজ্ঞতা নিয়ে। অন্যরা যা করেন, তিনিও তাই করলেন। সবাইকে তিনি ডাকলেন। এ ধরনের অবস্থায় সবাই একটু সতর্ক থাকে বোঝার জন্য-নতুন কর্তা কী চান। তিনি বলতে শুরু করলেন, প্রতিষ্ঠানটি ঠিকমতো চলছে না। দক্ষ লোকের অভাব। নিয়মিত অফিসার-কর্মীরা অফিসে আসেন না। যখন খুশি আসেন, যখন খুশি যান। কোনো জবাবদিহিতা নেই। অফিসাররা ‘টাই’ পরেন না, কর্মচারীদের ‘ইউনিফরম’ নেই। অফিসারদের খাওয়ার জন্য ডাইনিং হল নেই। গাড়িতে তেল খরচ বেশি। সেখানে বিশাল অপচয়। মেডিকেল বিলের ক্ষেত্রে বিশাল অপচয় হয়। এ ধরনের নানা অসুবিধা ও সমস্যার কথা তিনি সেদিন বলে সবাইকে ‘বিহেইভ’ করতে বলেন। বলেন, ‘বোনাস’ ঢালাওভাবে দেওয়া হবে না, এমনকি বার্ষিক বেতন বৃদ্ধিও স্বয়ংক্রিয়ভাবে হবে না। তিনি প্রথমেই ধরলেন ‘উপস্থিতি’ সমস্যাকে। প্রধান কার্যালয়ে মেশিন বসালেন। সবাই কার্ড ঢুকিয়ে তারপর অফিসে ঢুকবে। অফিসে ঢোকার সময় রেকর্ড হবে। শাখায়-শাখায় উপস্থিতি মেশিন বসল। ভীষণ কড়াকড়ি। কর্মচারী-কর্মকর্তারা তটস্থ। কার চাকরি কখন যায়। ওদিকে তিনি হুকুম দিলেন সব গাড়ির ‘মাইলেজ’ টেস্ট করাতে। করবে নামকরা প্রতিষ্ঠান। এক লিটার তেলে কত মাইল/কিলোমিটার একটি গাড়ি যায় তার হিসাব হবে। ড্রাইভাররা ওইভাবে তেল তুলবে। দুর্নীতি বন্ধ হবে। দক্ষতা বাড়বে। নতুন জমানা, নতুন এমডি, নতুন উদ্দীপনা। ভয়ে ভয়ে সবাই কাজ শুরু করল। একদিন খবর পাওয়া গেল ‘উপস্থিতি মেশিন’ নষ্ট হয়েছে। তারপর খবর এলো অনেক অফিসেও তা খারাপ হচ্ছে। ‘সাপ্লায়ার’ মেরামত করছে। বিল তুলছে। দেখা গেল ‘সাপ্লায়ার’ মহামান্য ‘এমডি’ সাহেবের খালাতো ভাই। যাক সমস্যা শেষ। কারণ একদিন মেশিনই গায়েব হয়ে গেল। শুরু হলো ‘ইনভেস্টিগেশন’। এর ওপর দোষ, ওর ওপর দোষ। অফিসাররা একজন আরেকজনকে ঘায়েল করার জন্য উঠেপড়ে লাগল। এদিকে গাড়ির অবস্থা কী? দেখা গেল গাড়ি সব নষ্ট হতে শুরু করেছে। ড্রাইভারদের অনেক অভিযোগ। তারা সংঘবদ্ধ। তাদের সমিতি আছে। মতিঝিলে ড্রাইভাররা একতাবদ্ধ। শেষ পর্যন্ত আগের রীতিই বহাল হলো-উপস্থিতিতে এবং গাড়ির ক্ষেত্রে। ইতোমধ্যে ‘এমডি’ সাহেবও তার গদি ঠিক করে নিয়েছেন। দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করতে গিয়ে ফলাফল হলো শূন্য। এটাই বাস্তবতা।
এসব কাহিনি/ঘটনার অবতারণা কেন? অবতারণা নতুন সরকারের নানা উদ্যোগ দেখে। বিশেষ করে এখন সরকারকে দেখা যাচ্ছে দুর্নীতির ওপর খক্ষহস্ত। মানুষ ভীষণ খুশি। মানুষ ঘুসখোর/দুর্নীতিবাজদের ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ। এরা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এদের দাপট সর্বত্র। আইন প্রণয়ন, আইন প্রয়োগ, রাজস্ব আদায়, সরকারি খরচ নির্বাহে, ভাতা বিতরণে, টিসিবির পণ্য বণ্টনে-সর্বত্র অনিয়ম, ঘুসের রাজত্ব। এ অবস্থায় নতুন ছাত্র-সরকার যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, তখন দেশবাসী ভীষণ খুশি। সরকারে রয়েছে সব নামি-দামি লোক। রয়েছে মানবাধিকার নেতা, আইএমএফের বন্ধু, ওয়াশিংটনের বন্ধু এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা। টিম বাইরে থেকে দেখে মনে হয় ভীষণ উজ্জ্বল। অতএব, আশবাদও ব্যাপক। কিন্তু কিছু ঘটনা মানুষের এ আশাবাদে পানি ঢেলে দিচ্ছে। খবরের শিরোনাম-‘খাগড়াছড়িতে হাসনাত আব্দুল্লাহ : ঘুস বন্ধ হওয়ায় অনেকের কাজের গতি কমে গেছে’। খবরে বলা হয়েছে, ঘুস বন্ধ হওয়ায় অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। ভূমি অফিস, পাসপোর্ট অফিস, স্বাস্থ্য ও বিআরটিএসহ বিভিন্ন সেবামূলক দপ্তরে ঘুস বন্ধ হওয়ায় অনেকে কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছেন। তিনি সবাইকে জনবান্ধব হতে বলেছেন। যদি তা না হয়, তাহলে তারা কৃষিকাজে ফিরে যাক-একথাও তিনি বলেছেন। বলেছেন, দরকার বোধে পুরোনো কর্মচারী-কর্মকর্তার বদলে নতুন লোক নিয়োগ পাবে (১০.০৯.২৪)। এখানেই শেষ নয়। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি, পূরণ হয়েছে শূন্যস্থান।’ এখানে দুজনের বক্তব্য। একজন ছাত্রনেতা, আরেকজন বিজ্ঞজন, যিনি দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি-ঘুসের বিরুদ্ধে, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে লিখছেন। এখন তিনি ক্ষমতায়। অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি। অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে তিনি। এর থেকে বোঝা যায়, রক্ত শুকাতে না শুকাতেই ঘুস-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির অবস্থা।
তাই প্রশ্ন, ঘুস-দুর্নীতিই কি চলবে, চাঁদাবাজিই কি চলবে? সরকার পরিবর্তনের মাত্র এক মাস গত হয়েছে, এরই মধ্যে পূর্বাবস্থায় ফিরে গিয়েছি/যাচ্ছি আমরা। আমরা ‘টেবিল মানির’ দেশই থেকে যাচ্ছি। গতকাল মঙ্গলবারই ময়মনসিংহের গৌরীপুরের এক রিকশাওয়ালা আমাকে তার একটা ঘটনার কথা বললেন কথা প্রসঙ্গে। রিকশাভাড়া ৪০ টাকা ঠিক হয়েছে। থেমে তিনি বললেন আরও ১০ টাকা দিতে। আমি বললাম, কেন? তার জবাব শুনে আমি স্তম্ভিত। তার তিন সন্তান। তিনজনেই প্রতিবন্ধী। একটা সন্তান প্রতিবন্ধী দেখে দম্পতি আরেকটি সুস্থ সন্তানের আশায় বুক বাঁধে। এভাবে তিন সন্তান। এই গরিব রিকশাওয়ালা গত কয়েক বছরে চেষ্টা করেও প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করতে পারেননি। কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিদের জনপ্রতি এক বছরের ভাতার টাকা দিতে হবে। তাহলেই কার্ড। তিনি ওই টাকা জোগাড় করতে পারেননি। এখন সংসার চালাতে দেশে আয় কমে যাওয়ায় ঢাকায় এসেছেন ‘ক্যাশে’র সন্ধানে। তিনি আশায় বুক বেঁধেছেন। এবার হয়তো একটা কিছু হবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, রিকশাওয়ালাও আবার সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বলেন, যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। আমি বললাম, রাবণ কে? তিনি বললেন, জানি না। মা-বাবার কাছে শুনেছি। তাই বলছি। দেখা যাচ্ছে, অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ যা বলেছেন, তার সঙ্গে রিকশাওয়ালার কথার মিল পাওয়া যাচ্ছে।
গত ৫০-৫২ বছরে কত সরকার এলো-গেল। কোনো সমস্যারই সমাধান হচ্ছে না। বিশেষ করে ঘুস-দুর্নীতি সমস্যার কোনো সমাধান মিলছে না। অবস্থা এমন যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পিয়নও নাকি ছিল ৪০০ কোটি টাকার মালিক। ভাবা যায়? অথচ ভাবতে হয়, এটাই বাস্তবতা। পরিস্থিতি এমনই যে, মসজিদ-মন্দির নির্মাণের জন্য সরকারি বরাদ্দের টাকাও গিলে খায় একশ্রেণির কন্ট্রাক্টর, সরকারি কর্মকর্তা। মোটামুটি রেটই নাকি ৫০ ও ৫০। অর্থাৎ ১০ লাখ টাকা ব্যয় হলে ৫ লাখ টাকার কাজ হবে, বাকি ৫ লাখ ‘টেবিল মানি’ এবং একশ্রেণির জনপ্রতিনিধিদের।
এই যে সমস্যা, তাকে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান আখ্যায়িত করেছিলেন ‘গুচ্ছ দুর্নীতি’ বলে। অর্থাৎ একটা প্রকল্প প্রণয়ন থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত স্তরে স্তরে দুর্নীতি/ঘুস। কোনো রেহাই নেই কারও। এই যে দুর্নীতি, তার পরিমাণ কত? আমরা সারাদিন ন্যায্যতই ব্যস্ত ব্যাংক লুটের কাহিনি নিয়ে। বলা হচ্ছে, বর্তমানে ব্যাংকে লুটপাটের কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হবে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ। ২৫ শতাংশ কত টাকা? মোট ঋণ যদি ১৬ লাখ কোটি টাকা ধরে নেই, তাহলে ২৫ শতাংশে হবে ৪ লাখ কোটি টাকা। ৫০-৫২ বছরে সব ব্যাংক মিলে ৪ লাখ কোটি টাকা অনাদায়ী হয়েছে। এসবের বিপরীতে মামলা আছে, ব্যাংকের দাবি আছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে যে কন্ট্রাক্টরি ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা হাজার হাজার, লাখ লাখ কোটি টাকা লুট করছে, তার কী হিসাব আমরা নিয়েছি?
সাধারণভাবেই বলা যায়, সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচির মোট টাকার মধ্যে ৫০ শতাংশই লুট হয়। বাকি ৫০ টাকা খরচ হয়। অর্থাৎ ১ টাকার জায়গায় ২ টাকা খরচ হয়। রাজস্ব বাজেটেরও একই অবস্থা। স্কুল-মাদ্রাসা নেই, অথচ শিক্ষকরা টাকা নিচ্ছে। হাসপাতালের রোগীদের টাকা, জেলখানার কয়েদিদের খাওয়ার টাকা পর্যন্ত লুট হচ্ছে। এসবের কিন্তু কোনো হিসাব নেই। সরকারি নির্মাণের কাজে যারা জড়িত, উন্নয়ন কর্মসূচির সঙ্গে যারা জড়িত, কন্ট্রাক্টরজাতীয় লোকেরা গত ৫০-৫২ বছরে কত টাকা লুট করেছে বলে মনে হয়? কেউ তা জানি না। এসবের বিরুদ্ধে কিন্তু কোনো মামলা নেই। অথচ ব্যাংকের প্রতিটি ঘাপলা, জালিয়াতির বিপরীতে মামলা আছে। মামলা ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে, মামলা ব্যাংকারদের বিরুদ্ধে। কোনো প্রতিকার নেই। দেখা যাচ্ছে, প্রতিকার করতে গেলে কাজের গতি কমে যাচ্ছে, যার কথা সমন্বয়ক মহোদয় বলেছেন। বেশি আঁটাআঁটি করতে গেলে হয়তো কাজই বন্ধ হয়ে যাবে।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়