বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের
এরশাদুল আলম প্রিন্স
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সদ্যবিদায়ি স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিয়েছে। শুধু জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানকালেই নয়, গত ১৫ বছরে দেশে গুম, খুন ও নির্যাতনের এক বিশ্বরেকর্ড করেছেন শেখ হাসিনা। কাজেই তার মতো ফ্যাসিস্টদের বিচার করার জন্যই আন্তর্জাতিক অপরাধ (আইসিসি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মতো আরও রয়েছে আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে), যেখানে রাষ্ট্রকে মামলা করতে হয়। তবে এখানে বিচারের জন্য জাতিসংঘও আবেদন করতে পারে। তবে ব্যক্তিবিশেষের অপরাধ বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসিই যথাযথ কর্তৃপক্ষ।
আন্তর্জাতিক আদালতে সম্প্রতি বেশকিছু মামলা হয়েছে। তার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম ইসরাইল একটি। এ মামলায় দক্ষিণ আফ্রিকা গাজায় ইসরাইলের গণহত্যার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন মিলে আন্তর্জাতিক সামরিক আদালত গঠন করেছিল। ১৯৪৫-৪৬ সালে নাজি নেতাদের বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছিল এর মাধ্যমে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার মামলা তো আমাদের রয়েছেই। তবে, এগুলো রাষ্ট্রীয় মামলা, যেখানে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হয়।
গণহত্যা, গুম, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের মতো অপরাধের বিচারের জন্য বাংলাদেশের রয়েছে নিজস্ব একটি আদালত (আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিটি)। এর এখতিয়ারে রয়েছে বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধের বিচার করা। কাজেই এখানে শেখ হাসিনার বিচার হতেই পারে এবং সে প্রক্রিয়া চলছেও। কিন্তু একই অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতও রয়েছে। রোম চুক্তির আলোকে প্রতিষ্ঠিত এ আদালত এ জাতীয় ফ্যাসিস্টদেরই বিচার করে থাকে। বাংলাদেশ এ চুক্তিতে সই করেছে, যদিও সরকার দেশের আদালতেই শেখ হাসিনার বিচারের কথা বলছে। শেখ হাসিনাই জামায়াত নেতা, তথা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচারের জন্য এ আদালত গঠন করেছিল। এখন বর্তমান সরকার সে আদালতেই শেখ হাসিনার বিচার করতে পারে। এ আদালতের এখতিয়ার রয়েছে শেখ হাসিনা কর্তৃক সংঘটিত অপরাধের বিচার করার।
গণঅভ্যুত্থানে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, দৃশ্যত তার প্রধান নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা। ইন্ধনদাতা হিসাবে ওবায়দুল কাদের ও দলের অন্য সিনিয়র নেতাদের নাম এসেছে। এ আইনের অধীনে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, নির্দেশদাতা ও সহযোগিতাকারীদের বিচার সম্ভব। শেখ হাসিনার মতো ফ্যাসিস্টদের বিচার দেশীয় আদালতে হতেই পারে। আদালতের সে এখতিয়ার আছে। তবে, তাদের মতো ফ্যাসিস্টদের বিচার আন্তর্জাতিক কোনো আদালতে হলে সেটাই আরও বেশি যুক্তিযুক্ত। অতীতের অনেক ফ্যাসিস্ট ও গণহত্যাকারীদের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে হয়েছে। সরকার দেশের আইসিটিতে বিচার করতেই পারে। সে লক্ষ্যে হয়তো আদালত ও বিভিন্ন কমিটি পুনর্গঠনে হাত দিয়েছে। ইতোমধ্যে চিফ প্রসিকিউটর হিসাবে তাজুল ইসলামকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমাদের আইসিটি যে কোনো ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তিবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও জেনেভা কনভেনশনবিরোধী কাজসহ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যে কোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা দল, সেনাবাহিনী কিংবা তাদের সহযোগী সশস্ত্র বাহিনীর বিচার করতে পারে। বোঝাই যাচ্ছে, এ আদালতের এখতিয়ার কত ব্যাপক। খুব সহজেই শেখ হাসিনার বিচার হতে পারে তারই প্রতিষ্ঠিত আদালতে। এ আইনে হত্যা, দাসত্ব, নির্মূল, নির্বাসন, কারাবরণ, অপহরণ, বন্দিকরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ বা কোনো বেসামরিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত নানা অমানবিক কাজ বা রাজনৈতিক, জাতিগত বা ধর্মীয় ভিত্তিতে নিপীড়নের মতো কাজকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং আইসিটিতে এগুলোর বিচার করা যাবে। আইনে এগুলো সবই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত। কাজেই আইনানুযায়ী, শুধু জুলাই-আগস্ট মাসেই শেখ হাসিনা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেননি, বিগত ১৫ বছরের খতিয়ান টানলে তার অপরাধের মাত্রা আরও বহুগুণ বেড়ে যাবে; যা আইসিটিতে সহজেই বিচার্য। তবে দেশের আদালতে বিচার করা গেলেও আন্তর্জাতিক কোনো আদালতে শেখ হাসিনার বিচার করাই শ্রেয়। নানা কারণেই সেটি বেশি যুক্তিসংগত।
নানা কারণেই দেশের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিগত সব সরকারই বিচারকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। আমাদের বিচার বিভাগ আজও স্বাধীন হতে পারেনি। ফলে স্বাভাবিক বিচার নিয়েই জনমনে প্রশ্ন আছে। এখানে রাজনৈতিক কারণে মামলা হয়, বিচার হয় ও রাজনৈতিক কারণেই মামলা প্রত্যাহার করা হয়-জনগণ তা জানে। বিগত কোনো সরকারই এ দায় থেকে মুক্ত নয়।
দেশি আদালতে শেখ হাসিনার বিচার করলে এ প্রশ্নগুলো উঠবে। যতই নিরপেক্ষভাবে বিচার হোক না কেন, তার নিজের লোকই এ বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এ প্রশ্নগুলো তুলবে। যদিও জাতি জানে, এসব হত্যাকাণ্ডের প্রধান দায়ভার তার। তিনিই হুকুমদাতা।
এছাড়া ইতোমধ্যে আইসিটির বিচার কার্যক্রম নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধের বিচার-পরবর্তী সময়ে প্রণীত আইন ও গঠিত আদালতের মাধ্যমে বিচার করা নিয়েও একটি প্রশ্ন রয়েছে। এছাড়া, বেশ কয়েকটি বিচার নিয়ে ইতঃপূর্বে প্রশ্ন উঠেছে। বিচারকের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আদালতের তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন করেছেন অনেকে। ফলে, ভবিষ্যতে নিরপেক্ষ বিচার করলেও অতীতের রেশ টেনে অনেকেই শেখ হাসিনার বিচার নিয়েও প্রশ্ন করতে চাইবে। ফ্যাসিস্টের দোসররা শেখ হাসিনার সুষ্ঠু বিচার নিয়েও প্রশ্ন করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আইসিসিতে বিচার হলে এ নিয়ে দেশে পানি ঘোলা করার সুযোগ থাকবে না। এ কারণে দেশীয় আদালতের চেয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে শেখ হাসিনার বিচার করাই বেশি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে (ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম ফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স) স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশের এ ভূমিকা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায় এটিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছে। কাজেই গুমের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা এখনই সময়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে শেখ হাসিনা যে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, বর্তমান সরকারকে আইসিসির প্রসিকিউটর দপ্তরে সে বিষয়গুলো নিয়ে যেতে হবে। বর্তমান সরকার নিজেই এ কাজটি করলে তার গুরুত্ব অনেক বেশি হবে। সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় রেফারেল দিয়ে শেখ হাসিনার অপরাধের তদন্ত ও বিচার চাইতে পারে। সরকার এ আবেদন করলে প্রসিকিউটর নিজেই তদন্ত শুরু করতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রসিকিউটরের আর আদালতের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। অর্থাৎ বিচার প্রক্রিয়ার একটি ধাপ এগিয়ে যাওয়া যাবে।
আমাদের আইসিটিতে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি আছে। এটি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল প্রশ্ন করতে পারে। অনেক রাষ্ট্রই মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষ দেশ। এতে শেখ হাসিনার প্রতি জনসমর্থনই বাড়বে। কাজেই যেখানে উত্তম বিকল্প আছে, সেখানে আইসিটিতে যাওয়ার প্রয়োজন কী?
৫ আগস্টের পর অনেক অপরাধী পালিয়ে গেছে। তাদের অনুপস্থিতি আইসিটিতে বিচার করলে অনেকে এ নিয়ে প্রশ্ন করবে অথচ তারা দেশে ফিরবে না। আইসিসিতে সে সমস্যা নেই। আন্তর্জাতিক তদন্ত সংস্থা তদন্ত করবে, বিচার করবে। তারাই আসামি ফেরত চাইবে। রোম চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ আসামিদের ফেরত দিত বাধ্য। না দিলে সেটা তাদের ব্যাপার। বাংলাদেশ শুধু তদন্তে সহায়তা করবে।
আমাদের দেশের বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা আছে। সরকার যদি আইসিটিতে বিচার শুরু করে, তারা যে সে বিচার শেষ করে যেতে পারবে, সেটি না-ও হতে পারে। পরবর্তী সরকার বিচার বন্ধও করে দিতে পারে, আবার না-ও পারে। আইসিসিতে এ প্রশ্ন নেই। বিচারের সঙ্গে সরকারের আসা-যাওয়ার সম্পর্ক নেই।
আইসিসির আইনে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও আগ্রাসনের মতো অপরাধের বিচার হয়। তবে কোনো রাষ্ট্র যদি এসব বিচার না করে, করতে অনিচ্ছুক বা অপারগ হয়, তাহলে আইসিসি মামলা নিয়ে থাকে। তবে আইসিটিতে বিচার করলেও সরকারের উচিত হবে আন্তর্জাতিক তদন্ত সংস্থার সাহায্য চাওয়া, যা সরকার ইতোমধ্যেই চেয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউমান রাইটস ওয়াচ’র সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। আইসিসির কাছে ব্যক্তিপর্যায়ে কেউ কেউ শেখ হাসিনার বিচারের জন্য আবেদন করেছেন; কিন্তু সেগুলো এখনো নথিভুক্ত হয়েছে বলে মনে হয় না। আইসিসিতে শেখ হাসিনার বিচার চেয়ে আইসিসির প্রধান প্রসিকিউটর করিম খানের কাছে আবেদন করেছেন জগলুল হোসেন ও সাবরিয়া চৌধুরী বালান্দ। কিন্তু সরকারকে এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে।
বর্তমান সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ নিয়ে এ সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। মানুষের প্রত্যাশা সীমাহীন, অথচ সম্পদ ও সুযোগ সীমিত। সেই সঙ্গে গত ১৫ বছরের লোকজন নিয়েই এ সরকারকে কাজ করতে হচ্ছে। চাইলেই সবকিছু রাতারাতি পরিবর্তন করা যায় না। পতিতরা ঘাপটি মেরে আছে এ সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে। এতসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে শেখ হাসিনার বিচার সরকারের জন্য আরও বড় এক চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ ও অস্থিতিশীলতা এড়ানোর উত্তম বিকল্প আইসিসি।
শেখ হাসিনা একটি নাম আর ফ্যাসিবাদ একটি চরিত্র। আমরা ফ্যাসিস্টের বিচার চাই। শুধু নিজ দেশের জন্য, বিশ্বের জন্য। বিশ্বে আর যেন কোনো ফ্যাসিস্টের জন্ম না হয়। বিশ্ববাসী মুক্ত হোক নতুন কোনো ফ্যাসিস্টের কবল থেকে। আমরা সুষ্ঠু বিচার চাই। কোনো প্রতিহিংসা নয়, প্রতিশোধও নয়। যে আদালতেই বিচার হোক না কেন, বিচার হোক আন্তর্জাতিক মানের, নজির সৃষ্টিকারী। ফ্যাসিজম নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক।
এরশাদুল আলম প্রিন্স : আইনজীবী, প্রাবন্ধিক