বিশ্ব পরিমণ্ডলে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পাক

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বৈষম্যবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের মাসপূর্তি উপলক্ষ্যে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ছাত্র-জনতার জমায়েত থেকে ঘোষিত হয়েছে নতুন পাঁচ দফা কর্মসূচি। দফাগুলো হলো-গণহত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা, শহিদ পরিবারগুলোর আর্থিক ও আইনি সহযোগিতা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রদান, প্রশাসনে দুর্নীতিবাজ ও ফ্যাসিস্টদের দোসরদের চিহ্নিত করে অনতিবিলম্বে বিচারের আওতায় আনা, গণভবনকে জুলাই স্মৃতি জাদুঘর ঘোষণা করা এবং রাষ্ট্র পুনর্গঠনের রোডম্যাপ দ্রুত ঘোষণা করা। যৌক্তিক এসব প্রস্তাবনা আধুনিক চিন্তা-চেতনারই ফসল। তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে ভরা মেধাবী নেতৃত্বের সমন্বয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার ব্রত আশা জাগায়। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসাবে চট্টগ্রামের সমাবেশ থেকেও জনগণেরই মনের কথা উচ্চারিত হয়েছে। সমাবেশে স্পষ্ট করা হয়, কেউ যদি এ বাংলাদেশে আবারও স্বৈরাচার হতে চায়, তাহলে ছাত্রসমাজ যুগে যুগে যেভাবে স্বৈরাচারদের বিরুদ্ধে লড়েছে, একইভাবে তাদেরকেও রুখে দেওয়া হবে। এই চট্টলায় কোনো চাঁদাবাজ-লুঠতরাজের ঠাঁই হবে না বলে কঠোর হুশিয়ারি দেওয়া হয়। তাছাড়া ওই সমাবেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সংস্কারের পর নির্বাচনের দিকে যাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।
প্রকৃত অর্থেই সার্বিক রাষ্ট্র মেরামতের উদ্দেশ্যে উত্থাপিত বিষয়গুলো বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ভবিষ্যৎ নির্মাণের উপযোগী। বিরাজমান অস্থিরতা নিরসনে সামষ্টিক উদ্যোগ গ্রহণও জরুরি হয়ে পড়েছে। কতিপয় দুর্বৃত্তের দখল-লুটপাট-সন্ত্রাসের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি স্থিতিশীল নয়। জনগণের জানমাল নিরাপত্তায় ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা তাই প্রত্যাশিত। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ১২ দিনের মধ্যে দেখা দেয় আকস্মিক বন্যা। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ার ফলে সৃষ্ট বন্যায় পর্যুদস্ত হয় দেশের বেশকিছু অঞ্চল। বানভাসি মানুষের আর্তনাদে এখনো বাতাস ভারী।
জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার বন্যা মোকাবিলায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থাসহ জনগণের সহযোগিতায় বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম গতিশীল হয়েছে। ২৪ আগস্ট গঠন করা প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ব্যাপক সাড়া লক্ষণীয়। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ওই তহবিলে জমা দেন তাদের একদিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসটিতে চলা গণত্রাণ কর্মসূচিতে সংগৃহীত ১১ কোটি টাকার অধিক আর্থিক সহায়তা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সার্থক গণঅভ্যুত্থানের পবিত্র ফসল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিগত সরকার পতনের স্বল্প সময়ের মধ্যেই গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে অভিষিক্ত হন শান্তিতে নোবেলজয়ী বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি বিশ্বে বাংলাদেশকে নবতর পরিচয়ে ঋদ্ধ করেছে। সরকার গঠনের পর থেকেই তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার শুভেচ্ছা ও অভিনন্দনে সিক্ত হয়েছেন। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বাগত জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত, চীন, রাশিয়াসহ বহু দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। তারা সবাই ভবিষ্যতে সরকারের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে কাজ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। চিঠিতে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে কাজ করাসহ বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের অঙ্গীকারের বিষয়টি উল্লেখ করেন।
উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) বাংলাদেশের দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই উন্নয়নে আগের মতো পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহায়তা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে তাদের চলমান প্রকল্পের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে আগামীতে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্থিতিস্থাপক ও বাংলাদেশের জনগণের জন্য টেকসই ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিতে সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে এডিবির কাজের মূল লক্ষ্য সরকারি খাতের ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন নিশ্চিতে কাজ করা, যা সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা আমলে নিলে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বেসরকারি খাতের উন্নয়ন সম্প্রসারিত করা বাংলাদেশে এডিবির দ্বিতীয় লক্ষ্য। বাংলাদেশে ব্যবসা করার খরচ কমাতে সরকার-টু-ব্যবসা পরিষেবাগুলোকে ‘স্ট্রিমলাইন’ করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে কাজ করার বিষয়টিও এডিবির লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত। সংস্থাটি আরও জানায়, জলবায়ু পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ এবং বাংলাদেশের জনগণ ক্রমবর্ধমানভাবে বন্যা, খরা ও তীব্র গরমে ভুগছে। তাই এডিবি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তার উন্নয়ন কর্মসূচিতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি সম্পূর্ণ সরকারি পদ্ধতি তৈরিতে সহায়তা করবে।
সর্বশেষ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ও প্রধান উপদেষ্টার প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন ১৯৮ বিশ্বনেতা। বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী বিশ্বনেতাদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, নরওয়ের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গ্রো ব্রুন্ডল্যান্ড, রোমানিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট এমিল কনস্টান্টিনেস্কু, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, বিশ্বব্যাংকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ম্যাটস কার্লসনসহ প্রায় ৯২ জন নোবেলবিজয়ী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টে ‘বাংলাদেশের জনগণ ও পুরো বিশ্বের শুভবুদ্ধির নাগরিকদের জন্য বার্তা’ শিরোনামে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিনন্দন ও আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাতে পেরে উচ্ছ্বসিত। বাংলাদেশের অন্যদের মতো অধ্যাপক ইউনূসও স্বৈরশাসনের একজন ভুক্তভোগী। একটি গণতান্ত্রিক ও শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের শক্তির প্রতি আমরা ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এই শক্তি স্বৈরাচার হটিয়ে আশার জন্ম দিয়েছে।’ বিশ্বনেতারা আরও বলেন, ‘আমরা অধ্যাপক ইউনূসকে শেষ পর্যন্ত পুরো দেশের, বিশেষ করে দেশের সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নে কাজ করার জন্য মুক্ত হতে দেখে উৎফুল্ল। এ কাজ তিনি ছয় দশক ধরে অত্যন্ত জোরেশোরে ও সাফল্যের সঙ্গে করে আসছেন। দেশের তরুণরা যেমন ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অনুপ্রাণিত করেছে, তেমনি আমরা জানি তিনি তাদের বাংলাদেশের নতুন এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে নেতৃত্বের ভূমিকায় আসতে অনুপ্রাণিত করবেন।’
এছাড়া পশ্চিমা বিশ্বসহ বিভিন্ন দেশ ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার পক্ষ থেকে গণহত্যা তদন্তে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আশ্বাসও নিশ্চিত করা হয়। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নানামুখী আর্থিক ও কারিগরি সহায়তার ইতিবাচক অঙ্গীকারও উল্লেখ করার মতো। অতিসম্প্রতি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের প্রাক্কালে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস গণঅভ্যুত্থানের সফলতা অর্থবহ করার জন্য ছাত্র-জনতাকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। তিনি যে কোনো ধরনের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অধিকতর সতর্ক থাকার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেন। রাষ্ট্র মেরামতে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত দমে না যাওয়ার পরামর্শও দেন। আমরা আশা করি, রাষ্ট্র সংস্কারে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব পক্ষের অকুণ্ঠ সমর্থন অচিরেই বাংলাদেশকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে মর্যাদাসীন করবে।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়