খেলাপি ঋণ আদায়ে এখন যা করতে হবে
ড. এম এম আকাশ
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসাবে যোগদানের পর ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, এ খাতে যে পর্বতপ্রমাণ খেলাপি ঋণ রয়েছে, তা আদায়ের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নরের এ অঙ্গীকার প্রশংসাযোগ্য। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাত যেভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। নতুন গভর্নর এ খাতে বিদ্যমান সমস্যার স্বরূপ অনুসন্ধান ও তা প্রতিকারের পন্থা খুঁজে বের করার জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কমিশন গঠনের কথা বলেছেন।
ব্যাংক খাত নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি সমস্যা কী, তা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। এ মুহূর্তে একটি জটিল বা জরুরি সমস্যা হচ্ছে, বেশকিছু ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে। এসব ব্যাংককে যদি তরল অর্থ না দেওয়া যায়, তাহলে তারা আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারবে না। এমনকি দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করতেও ব্যর্থ হবে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমানতকারীরা একযোগে এসব ব্যাংক থেকে আমানত উত্তোলন শুরু করবে। সেই অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দেশে কোনো ব্যাংক দেউলিয়া না হোক-আমরা যদি এটা চাই তাহলে প্রথমেই সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর জন্য তরল অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে তা করলে ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করাও হবে, আবার তাদের ফুটোপাত্রে পানি ঢালার মতো বিষয়ও হবে না?
কাজেই ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হলে কমিশনের প্রথম কাজ হবে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে কয়েকটি টাইপে আলাদা করে চিহ্নিত করা। সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে দুটি ভাগে বিভক্ত করতে হবে। দেখতে হবে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে কোনগুলো উদ্ধারযোগ্য এবং কোনগুলো উদ্ধারযোগ্য নয়। যেগুলো উদ্ধারযোগ্য, তাদের তরল অর্থের জোগান দেওয়াসহ নানা ধরনের পলিসি সাপোর্ট দিতে হবে। যেগুলো উদ্ধারযোগ্য নয়, তাদের আর কোনো টাকা দেওয়া উচিত হবে না। দেউলিয়াত্ব শৃঙ্খলার সঙ্গে সর্বনিম্ন আতঙ্ক বজায় রেখে তা করার জন্য যা প্রয়োজন, তা-ই করতে হবে।
দেউলিয়াত্ব থেকে উত্তরণের জন্য সমস্যাগ্রস্ত কিন্তু উদ্ধারযোগ্য ব্যাংকগুলোকে টাকা দিতে হবে। এখন দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, টাকাটা কীভাবে বা কোত্থেকে দেওয়া হবে? তবে প্রথম সংকট থেকে উত্তরণযোগ্য ব্যাংকগুলোকে আলাদা করে নিতে হবে। তারপর তাদের কী পরিমাণ টাকা প্রয়োজন, সেটা নির্ধারণ করতে হবে। সমস্যাগ্রস্ত কিন্তু উত্তরণযোগ্য ব্যাংকগুলোকে ‘ভায়াবল’ বা টিকে থাকতে সক্ষম করতে কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, সেটা নির্ধারণের পর কিভাবে এ অর্থের জোগান দেওয়া হবে, তা দ্বিতীয় পর্যায়ে ঠিক করতে হবে।
ব্যাংক খাতে বর্তমানে যে তারল্য সংকট দৃশ্যমান হচ্ছে, তার মূল কারণ হচ্ছে অনাদায়ি খেলাপি ঋণ। কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে বিপুল পরিমাণ ব্যাংক ঋণ পড়ে আছে খেলাপি অবস্থায়। কোন ঋণগ্রহীতারা টাকা ফেরত না দেওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে, প্রথমেই তাদের নাম-ঠিকানা নিরূপণ করতে হবে। এরপর চিহ্নিত ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব বৃহৎ ঋণখেলাপির কাছ থেকে বকেয়া টাকা আদায় করে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেওয়া যায়, সেটা হবে সর্বোত্তম পন্থা। কারণ এখানে এক ঢিলে দুই পাখি মরবে। যারা ব্যাংকটির দেউলিয়াত্বের জন্য দায়ী, তাদের শাস্তি দেওয়া হলো। আবার শাস্তিটা এমনভাবে দেওয়া হলো যে ব্যাংকটি আর দেউলিয়া হলো না। অর্থাৎ সাপও মরল আবার লাঠিও ভাঙল না। কারা কোন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেনি, তাদের তালিকা তৈরি করতে হবে, প্রকাশ করতে হবে, বাজারে সিগন্যাল দিতে হবে যে, ‘খেলাপিদের ঘুম এখন থেকে হারাম’। হয়তো মনে হতে পারে, এক ব্যাংকের ঋণখেলাপির কাছ থেকে আদায়কৃত টাকা অন্য ব্যাংককে দেওয়া যাবে না। তবে এটা ব্যক্তিগত মালিকানা ও বাজার অর্থনীতির নিয়মে ঠিক হলেও প্রয়োজন ও জনস্বার্থে সর্বদা ঠিক নাও হতে পারে। সরকারি-বেসরকারি মালিকানাধীন বিভিন্ন ব্যাংকের উদ্ধারকৃত টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাধারণ তহবিলে প্রথমে জমা করতে হতে পারে, যদি ব্যাংকগুলো কোনো সম্মিলিত যৌথ অভিযানের মাধ্যমে অর্থ উদ্ধারে নামে, তাহলে তা সম্ভব। তখন কমন ফান্ড থেকে যার প্রয়োজন যত জরুরি, তাকে তত আগে দেওয়া যেতে পারে। বন্ধুপ্রতিম ব্যাংক রাজি হলে অন্য ব্যাংকের তারল্য সংকট মেটানোর জন্য টাকা দেওয়া যেতে পারে।
তবে প্রথমেই সরকারকে ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় এবং পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে হবে। উদ্ধারকৃত অর্থ দিয়ে একটি তহবিল গঠন করতে হবে। তহবিল গঠনের পর প্রয়োজনমতো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোকে অর্থায়ন করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, তারা নতুন করে কোনো টাকা ছাপাবেন না। নতুন করে টাকা ছাপানো হলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য যত রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা করতে হবে।
যারা বড় ঋণখেলাপি, তাদের গৃহীত ঋণের বিপরীতে কী পরিমাণ সম্পদ আছে, তা খুঁজে বের করতে হবে। সেই সম্পদ বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যেতে পারে, তা দিয়ে তার গৃহীত ঋণের অর্থ পুরোটা আদায় করা যাবে কিনা সেটা যাচাই করে দেখতে হবে। যদি বন্ধককৃত সম্পদ বিক্রি করে ঋণ পুরোপুরি আদায় করা না যায়, তাহলে তার অন্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্য কোর্টের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। দরকার হলে বিদ্যমান আইন সংশোধন করা যেতে পারে। আর যদি ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে নগদ অর্থ উদ্ধার করা যায়, তাহলে কোনো ঝামেলায় যেতে হবে না। তবে নগদ অর্থ উদ্ধার হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই তাদের বাড়ি-ফ্ল্যাট এবং অন্যান্য সম্পদ আটক করে তা বিক্রির ব্যবস্থা করা হলেও টাকা উদ্ধার হতে পারে। সাধারণভাবে ঋণগ্রহীতারা ঋণের বিপরীতে যে সম্পদ বন্ধক দেয়, তা অতিমূল্যায়িত করে দেখানো হয়। কাজেই বন্ধকি সম্পদ বিক্রি করে পুরো ঋণের অর্থ আদায় করা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে অন্যান্য দেশি-বিদেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে তা বিক্রি করার উদ্যোগ নিতে হবে। আইনে সেটা সম্ভব না হলে আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে হবে।
ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। কিন্তু এ হিসাব গ্রহণযোগ্য বা সঠিক নয়। কারণ অবলোপনকৃত ঋণ হিসাব, পুনঃতফসিলিকৃত হিসাবের কাছে পাওনা অর্থ এবং মামলাধীন প্রকল্পের কাছে দাবিকৃত অর্থ এই হিসাবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অনেকেই মনে করেন, আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুসারে খেলাপি ঋণ হিসাব করা হলে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করে যাবে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখানোর জন্য দায়ী হচ্ছে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা। সাম্প্রতিক সময়ে নানাভাবেই আইনি সংস্কারের মাধ্যমে খেলাপি ঋণকে কমিয়ে দেখানোর রাস্তা বের করা হয়েছে। তাই আমাদের খুব দ্রুত খেলাপি ঋণের বিদ্যমান সংজ্ঞা পরিবর্তন করে তা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের নিয়ম সহজ করা হয়েছে। ঋণ হিসাব অবলোপনের সময়সীমা কমানো এবং পদ্ধতি সহজ করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী আইনি সংজ্ঞা, যা আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে প্রণীত হয়েছিল, তা অন্তত এখন থেকে কঠোরভাবে পুনর্বহাল করা যেতে পারে। প্রয়োজনে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আইনগুলো আরও কঠিন করা যেতে পারে। কিস্তি আদায়ের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমানোর পরিবর্তে আইনি মারপ্যাঁচে তা কমিয়ে দেখানোর মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই।
আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী খেলাপি ঋণের পূর্ণাঙ্গ হিসাব বের করতে হবে। তারপর ১ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ পাওনা আছে এমন ঋণগ্রহীতাদের আলাদা তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। ১ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ পাওনা আছে এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে প্রথমেই টার্গেট করতে হবে। তাদের কাছ থেকে খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে। যাদের কাছে ১ কোটি টাকার কম খেলাপি ঋণ পাওনা আছে, তাদের ব্যাপারে পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আমরা যদি হাতিকে ছেড়ে চামচিকার পেছনে দৌড়াই, তাহলে কোনো কাজ হবে না। যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, তাদের আগে ধরতে হবে। আমি আগে একটি হিসাব করেছিলাম। তাতে দেখা গেছে, যদি আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিরূপণ করা হয়, তাহলে এ মুহূর্তে খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ হবে পৌনে ৪ লাখ কোটি টাকা।
গত ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে অনুসৃত অধিকাংশ আইন এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে, যেগুলো মূলত ঋণখেলাপিদের স্বার্থ রক্ষা করেছে এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলেছে বা কার্পেটের তলে প্রেরণ করেছে। যেমন, ঋণ হিসাব অবলোপন নীতিমালা সহজ করা হয়েছে। আগে কোনো ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হওয়ার পর ৫ বছর অতিক্রান্ত হলে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়েরপূর্বক শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করে সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসাবকে অবলোপন করা যেত। এখন কোনো ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হওয়ার পর ২ বছর অতিক্রান্ত হলেই তা অবলোপন করা যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ টাকার কম হলে মামলা দায়ের করতে হবে না। প্রভিশন সংরক্ষণের শর্তটি পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ঋণ হিসাব এক বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলিকরণ করার বিধান চালু করা হয়েছে। আগে কোনো ঋণ হিসাব সর্বোচ্চ তিনবার পুনঃতফসিলিকরণ করা যেত। এজন্য প্রথমবার ১০ শতাংশ, দ্বিতীয়বার ২০ শতাংশ এবং তৃতীয়বার ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিতে হতো। প্রতিবার সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ করা যেত। কৃত আইনি পরিবর্তনগুলো বাতিল করে ধাপে ধাপে তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। ব্যাংক খাতে অনুসৃত আন্তর্জাতিক মানের আইনগুলো পরিবর্তনের মাধ্যমে এ খাতকে কার্যত স্বজন তোষণের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে। ব্যাংক খাতের জন্য প্রণীত আন্তর্জাতিক মানের আইনগুলো কেন এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তন করা হয়েছিল, তাও চিহ্নিত করা প্রয়োজন। (অনুলিখন : এম এ খালেক)
ড. এম এম আকাশ : অর্থনীতিবিদ; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়