Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং বিবিধ প্রসঙ্গ

Icon

এম এ খালেক

প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং বিবিধ প্রসঙ্গ

পদত্যাগী ও দেশ ছেড়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন আদালতে শতাধিক মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অর্ধশতাধিক মামলায় বিবাদী করা হয়েছে। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা এ মামলা করেছেন। আগামী কিছুদিনের মধ্যে মামলার সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হতে পারে বলে আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সরকার পরিবর্তিত হলে সেই সরকারের নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা করা হয়, এটি কোনো নজিরবিহীন ঘটনা নয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা করা হয়েছে। এমনকি একজন মধ্যম সারির নেতার বিরুদ্ধে চারশতাধিক মামলা করা হয়েছে। মামলাগুলো এখনো বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

২০০৭-০৮ সালে যখন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল, তখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অনেক মামলা করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করা হলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার করা হয়। এসব মামলায় দাবিকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার কোটি টাকা। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার করা হলেও বেগম খালেদা জিয়ার মামলাগুলো চলমান থাকে এবং বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়াকে জেল দেওয়া হয়। প্রথমে তাকে ৫ বছরের জন্য সাজা দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে আপিল বিভাগের রায়ে সেই সাজার মেয়াদ দ্বিগুণ করা হয়। অনেকেই অভিযোগ করেন, মূলত জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখার জন্য বেগম খালেদা জিয়ার সাজা দ্বিগুণ করা হয়। এখানে বিচারব্যবস্থার একটি মারাত্মক দুর্বলতা প্রকাশ পায়। এতে প্রতীয়মান হয়, মামলা থেকে দায়মুক্তির জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রয়োজন হয়। শেখ হাসিনা যদি সেদিন সরকার গঠন না করতেন, তাহলে কি তিনি ১৪ হাজার কোটি টাকার মামলা থেকে রেহাই পেতেন? যদি ২০০৮ সালে নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হতো, তাহলে বেগম খালেদা জিয়াও সব মামলা থেকে দায়মুক্তি পেতেন এবং শেখ হাসিনাকে হয়তো জেলে থাকতে হতো। বাস্তবতা হচ্ছে যে কোনো বড় ধরনের অপরাধ থেকে দায়মুক্তি পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হতে হবে। কিন্তু সবার পক্ষে তো আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়া সম্ভব হয় না। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর শেখ হাসিনার প্রতিটি মামলা যদি কোর্টের রায়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হতো, সেটাই হতো যৌক্তিক। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারকদের মাধ্যমে মামলার দায়মুক্তি করিয়ে আনা কোনো কঠিন কাজ ছিল না।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করার পর প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের পাঁচজন বিচারপতি একযোগে পদত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। আগে আর কোনো সময় সরকার পরিবর্তনের (তা নির্বাচনের মাধ্যমেই হোক আর গণআন্দোলনের মাধ্যমেই হোক) সঙ্গে সঙ্গে এত বিপুলসংখ্যক বিচারপতির পদত্যাগের ঘটনা ঘটেনি। পদত্যাগী বিচারপতিদের বিরুদ্ধে দলীয় আনুগত্য প্রকাশের সুস্পষ্ট অভিযোগ ছিল। কাজেই তারা লাঞ্ছিত হওয়ার পরিবর্তে পদত্যাগ করাকেই উত্তম মনে করেছেন।

যাদের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা করা হবে, তাদের নির্বাহী আদেশে বা অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় বিচারের মুখোমুখি হওয়া থেকে দায়মুক্তি দেওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়। এতে বিচারব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যায়। কারণ কোনো সাধারণ মানুষ, যারা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, তাদের কিন্তু নির্বাহী আদেশে বিচারিক কার্যক্রমের মুখোমুখি হওয়া থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হয় না। প্রধানমন্ত্রী বা শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জন্য এক ধরনের নিয়ম আর সাধারণ মানুষের জন্য অন্যরকম নিয়ম, এটি তো হতে পারে না। আইন সবার জন্যই সমান হওয়া উচিত। যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, তাদের জন্য প্রয়োজনে ‘সামারি ট্রায়াল’র ব্যবস্থা করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করে উপযুক্ত শাস্তি অথবা দায়মুক্তি দেওয়া যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর মামলা থেকে নির্বাহী আদেশে দায়মুক্তি দেওয়ার যে বিধান চালু হয়েছে, তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এ ধরনের কার্যক্রম সমাজে বিচারব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি করে। দল-মত নির্বিশেষে সবার জন্য সঠিক বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই কারও বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপিত হলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের অবাধ সুযোগ থাকা প্রয়োজন।

কিন্তু আমরা কী দেখছি? সাগর-রুনী হত্যা মামলা, নারায়ণগঞ্জের ত্বকি হত্যাকাণ্ড, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে মামলার পুলিশি তদন্ত রিপোর্ট দাখিলের জন্য বারবার সময় নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ড এবং ত্বকি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য শতাধিকবার সময় নেওয়া হয়েছে। পুলিশি তদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়া গেলে মাননীয় আদালতের পক্ষে মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয় না। কোনো একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য শতাধিকবার সময় নেন, তাহলে সেই তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বিচারের আওতায় এনে কঠিন শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। এটি তার দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক। যদি এখনই বিচার বিভাগের এসব অসংগতি দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করা না হয়, তাহলে আগামীতেও পরাজিত রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রতিযোগিতা চলতেই থাকবে।

দেশে সাধারণত দায়েরকৃত কোনো মামলা সঠিক প্রমাণিত না হলেও বাদীকে তেমন কোনো শাস্তি প্রদানের বিধান নেই। এদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। কিছু কিছু আইনজীবী এবং ব্যক্তি আছেন, যারা আলোচিত হওয়ার জন্য যখন-তখন সম্মানিত এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দায়েরকৃত মামলার কোনো ‘মেরিট’ ছিল না, শুধু চমক সৃষ্টির জন্যই মামলা করা হয়েছিল। আইন সংশোধন করে মিথ্যা বা ভুয়া মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মামলা যিনি করেন, মামলার সত্যতা প্রমাণের দায়িত্বও তারই। কেউ মামলা করে যদি তার সত্যতা প্রমাণ করতে না পারে, তাহলে মামলার গুরুত্ব বিবেচনায় বাদীর জেল-জরিমানার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এটি করা হলে কারণে-অকারণে মামলাপ্রবণতা অনেকটাই কমে আসবে। বর্তমানে বিভিন্ন কোর্টে ৩৭ লাখ মামলা নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষমাণ আছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। কোনো কোনো মামলা নিষ্পত্তির জন্য অস্বাভাবিক সময়ক্ষেপণ করা হয়। এটি দূর করতে কোন্ ক্যাটাগরির মামলা কতদিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে, তার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। কথায় বলে, ‘জাস্টিজ ডিলেইড, জাস্টিজ ডিনাইড’-বিলম্বিত বিচার বিচারকে অস্বীকার করার নামান্তর। কাজেই কোনো কারণেই যেন বিচার বিলম্বিত না হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে।

বিচারপতি নিয়োগদানের যে পদ্ধতি আছে, তা-ও পরিবর্তিত হওয়া উচিত। বর্তমানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে। তারা বিচারক নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বাইরে কোনো বিচারপতি নিয়োগ হয় না। প্রধানমন্ত্রী তার অনুগত আইনজীবীদের মধ্য থেকেই বিচারপতি নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। ফলে একজন বিচারপতির পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর চাওয়া-পাওয়ার বাইরে যাওয়া সম্ভব হয় না। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে শক্তিশালী এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। প্রয়োজনে আইনি সংশোধনের মাধ্যমে পৃথক স্বাধীন ও শক্তিশালী ‘বিচারপতি নিয়োগ কমিশন’ গঠন করে তার সুপারিশের ভিত্তিতে বিচারপতি নিয়োগের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পেশাজীবনে কোনো ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ নেই এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে যুক্ত নন, এমন আইনজীবীদের মধ্য থেকে কমিশন সিনিয়রিটির ভিত্তিতে বিচারপতি নিয়োগের জন্য সুপারিশ করবেন। কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির চূড়ান্ত অনুমোদনসাপেক্ষে বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে। এটি করা হলে বিচারপতিরা স্বাধীনভাবে তাদের বিচারিক দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।

শুধু বিচার বিভাগ নয়, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কমিশন গঠনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের শীর্ষ পদে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন হচ্ছে নখদন্তহীন ব্যাঘ্র।’ কেউই নিশ্চয়ই চাইবে না, জনগণের ট্যাক্সের অর্থে পরিচালিত দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নখদন্তহীন বাঘে পরিণত হোক। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছি দুর্নীতি দমন কমিশন ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কোনোভাবেই সফলতা অর্জন করতে পারছে না। বিশেষ করে অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি সরকারের ঘনিষ্ঠ হন, তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশনের আচরণ যৌক্তিক বলে বিবেচনা করা যায় না। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন যতটা সোচ্চার, সরকারি দলের দুর্নীতিবাজদের প্রতি ততটাই উদার। দলীয়করণ কোনো পর্যায়ে উপনীত হয়েছে এবং তা জাতির জন্য কতটা ক্ষতিকর তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে।

আগামীতে আমরা এমন একটি দেশ গঠন করতে চাই, যেখানে জনগণের অর্থে পরিচালিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখবে। কোনোভাবেই সরকার বা অন্য কোনো মহলের স্বার্থরক্ষায় নিবেদিত হবে না।

এম এ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ও অর্থনীতি বিষয়ক লেখক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম