Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

গণমাধ্যম সংস্কারের কয়েকটি দিক

Icon

চিন্ময় মুৎসুদ্দী

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গণমাধ্যম সংস্কারের কয়েকটি দিক

ছবি সংগৃহীত

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংস্কার সাধন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী ও গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের জন্য দায়িত্ব পালন করব। এরপর আমরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করব। জাতীয় ঐকমত্য বৃদ্ধির জন্যও আমরা আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাব।’ এরই সূত্র ধরে ইতোমধ্যে ব্যাংক ও গণমাধ্যম কমিশন গঠন করা হবে-এমন সংবাদ গণমাধ্যমে দেখা গেছে। বর্তমান নিবন্ধে আমি গণমাধ্যম প্রসঙ্গটি পাঠকের দৃষ্টিতে আনতে চাই। বর্তমানে গণমাধ্যমের প্রধান সংকট বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব।

গত ৫৩ বছরে বিভিন্ন সরকারের নানা ধরনের আইন জারি ও হস্তক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি, দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়নি। গত ১৫ বছরে এ নির্যাতন সব সীমা ছাড়িয়ে যায়। কার্টুন প্রকাশ ও কঠোর সমালোচনামূলক রিপোর্ট ও নিবন্ধ প্রকাশ বন্ধ করতে বাধ্য হয় গণমাধ্যম। সমালোচনামূলক রিপোর্ট ও নিবন্ধ প্রকাশের জন্য রিপোর্টার ও নিবন্ধ লেখকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করা হয়েছে কটূক্তি বা অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অনুসারে ফাইল চুরির অপরাধে। সচিবালয়ে সাংবাদিককে কয়েক ঘণ্টা আটকে রেখে পুলিশে সোপর্দ করেন সরকারি কর্মকর্তারা-এমন ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে।

ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে সামাজিক সাইটে সরকারের বিপক্ষে পোস্ট আপলোড করার জন্য গ্রেফতার, মামলা ও রিমান্ডের শিকার হয়েছেন অনেকেই। একপর্যায়ে সরকারের সঙ্গে হাত মেলান সুবিধাপ্রত্যাশী কিছু সাংবাদিক এবং মুনাফালোভী মালিক। কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করে তাদের অন্য খাতের ব্যবসায় বিশেষ সরকারি সুবিধা লাভের প্রত্যাশায়। গণমাধ্যমকে তারা সরকার-তোষণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। গণমাধ্যমে বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শৃঙ্খলা নেই। চাকরিবিধি বা স্পষ্ট কোনো সার্ভিস রুল নেই। মালিকের ইচ্ছায় যে কোনো সময়, যে কেউ, যে কোনো পদে যোগ দিতে পারেন। সাংবাদিকতায় কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়া সম্পাদক হওয়া যায়। অনেক মালিক নিজেই সম্পাদক হয়ে যান সাংবাদিকতায় কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়া।

সাংবাদিক ইউনিয়নের দাবি ছিল সম্পাদক হতে হলে সাংবাদিকতায় কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকার বিধান জারি। কিন্তু সরকার সে দাবি মানেনি। মালিক নিজে সম্পাদক হলে সংবাদপত্রের মুনাফার দিকেই নজর থাকে বেশি। এ পর্যায়ের সম্পাদকরা সাংবাদিকতার যথাযথ পরিবেশ তৈরির বদলে সরকারি বিজ্ঞাপনের মূল্য বাড়ানো এবং নিউজপ্রিন্টের দাম কমানোর প্রক্রিয়াতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন। এছাড়া নিজের অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে নিজের পত্রিকার মাধ্যমে সরকারকে খুশি রাখার চেষ্টা করেন। গণমাধ্যমগুলোর মালিকদের সংগঠন (নোয়াব-নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) থাকলেও নিজেদের মধ্যে প্রফেশনাল সম্পর্কের অভাব দেখা যায়।

একটি প্রতিষ্ঠানের কোনো অনুষ্ঠানের সংবাদ অন্য প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করে না। টেলিভিশনেরও একই অবস্থা। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর (ডিএফপি) নিয়ন্ত্রিত সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রকাশ নিয়ে গণমাধ্যমে এক ধরনের অরাজক পরিস্থিতি বিদ্যমান। বিজ্ঞাপনপ্রাপ্তির জন্য প্রয়োজনীয় প্রচারসংখ্যা নিয়ে চলে একধরনের ‘হাডুডু’ খেলা।

এ দুর্নীতির মাধ্যমে ডিএফপির কেউ কেউ হয়েছেন বিস্তর অর্থের মালিক। সরকারিভাবে বলা আছে, সর্বশেষ ওয়েজবোর্ড কার্যকর না করলে সরকারি বিজ্ঞাপন পাবে না কোনো পত্রিকা। কিছু পত্রিকা ভুয়া একটি স্যালারি শিট তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। সাংবাদিক-কর্মচারীদের তাতে সই করতে বাধ্য করে। অনেক সময় স্বাক্ষরগুলো হয় জাল। ডিএফপি ও মন্ত্রণালয়ের কতিপয় অসাধু ব্যক্তির যোগসাজশেই এমনটা করা হয়ে থাকে।

গণমাধ্যমের জন্য সরকারের অনুমতি (ডিক্লারেশন) প্রাপ্তি নিয়েও নানা ধরনের দুর্নীতি হয়। সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে ডিক্লারেশনপ্রাপ্ত কিছু ব্যক্তি ডিক্লারেশন বেচাকেনা করে আর্থিকভাবে লাভবান হন। সাংবাদিক-কর্মচারীদের বড় অংশ সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বরাবরই তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। চাকরিচ্যুতি বা পদত্যাগের কারণে অনেক সাংবাদিক-কর্মচারী তাদের আইনগত প্রাপ্য পাওনা পাননি। অর্থকষ্টে থাকা সাংবাদিকদের জন্য সরকারিভাবে ভিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে। এটাও ক্ষমতাসীন সরকার নিয়ন্ত্রণ করে সরকারের আস্থাভাজন কিছু সাংবাদিকের পরামর্শে।

সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরনের অভিযোগ শোনা যায়। এরশাদ সরকারের পতনের পর অভিযোগ সংবলিত লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। এখন ফেসবুক হয়েছে অভিযোগকারীদের মাধ্যম, এরই মধ্যে সেটা বোঝা গেছে। এখানে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে, সেসব অভিযোগ আমলে নিয়ে সরকারিভাবে বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

সাধারণভাবে দেশবাসী ও প্রবাসীরা দেখেছেন কিছু কিছু সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল বাড়াবাড়ি করেছে। সবকিছুতেই একটানা দায়ী করে গেছে সরকারবিরোধী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে। সরকারের আস্থাভাজন গণমাধ্যম ও সাংবাদিকরা সরকারের কর্মপ্রবাহের সমালোচনাকারী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। টেলিভিশনের টকশোতে ভারসাম্য রক্ষাকারী আলোচকরা সরকারের বিপক্ষে বক্তব্য দেওয়া শুরু করলে সরকারের আস্থাভাজন সাংবাদিক-উপস্থাপকরা মিনিটের মধ্যে সাউন্ড কমিয়ে ওই আলোচকের কণ্ঠ চেপে দিয়ে বিজ্ঞাপন বিরতিতে চলে যান বা আপনি থাকুন, পরে আসছি আপনার কাছে বলে অন্য আলোচকের মন্তব্য শুনতে চান।

বিরোধী দলের বক্তাদের সঙ্গেও এমন আচরণ করা হয়েছে। অনেক টিভি চ্যানেলে এমনটা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। সরকারের বিপক্ষে যুক্তিনির্ভর বক্তব্য উপস্থাপনকারী কড়া সমালোচক হিসাবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের সরকারের মৌখিক নির্দেশে অথবা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানো বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিএনপি বা অন্য কয়েকটি ছোট রাজনৈতিক দলের নেতা এবং বিএনপি-সমর্থক কয়েকজন সাংবাদিক নেতাকে মাঝেমাঝে দেখা গেছে কয়েকটি চ্যানেলে। তাদের ডাকা হয় সাধারণত আওয়ামী লীগ নেতা ও আওয়ামী লীগ সমর্থক বক্তাদের সঙ্গে কিছুটা ‘ঝগড়া’-র মতো বিতর্ক করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করানোর মাধ্যমে দর্শক ধরে রাখা। বাঙালি জাতির একটা অংশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো অন্যের ঝগড়া দেখে আনন্দিত হওয়া। অনেক টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ সেটা বেশ ভালোভাবেই এক্সপ্লয়েট করেছে।

এ নিবন্ধে আমি নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে গণমাধ্যম-পরিস্থিতির কিছু চিত্র উল্লেখ করলাম। এটি কোনো তদন্ত প্রতিবেদন বা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণমাধ্যম কমিশন গঠন করলে সেই কমিশন তাদের ওপর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রমাণসহ আরও তথ্য সংগ্রহ করতে পারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে।

আমি ভবিষ্যৎ গণমাধ্যম সম্পর্কে আমার প্রত্যাশানির্ভর কিছু ভাবনার কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করলাম। ডিক্লারেশন প্রথা বাতিল করে কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পালনের নিয়ম করতে হবে। এক্ষেত্রে যে কোনো নাগরিকের গণমাধ্যম (প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, অনলাইন) পরিচালনার অধিকার থাকবে। তবে শর্তভঙ্গ করলে, বিশেষ করে অসত্য ও অনৈতিক সংবাদ বা ছবি প্রকাশের জন্য জরিমানাসহ অন্য কোনো শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে পারে।

সম্পাদক হবেন কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ পেশাজীবী সাংবাদিক। প্রকাশক ও সম্পাদক একই ব্যক্তি হবেন না। প্রকাশক কোনো পেশাজীবী সাংবাদিক হলেও সম্পাদক নিয়োগ করতে হবে প্রতিষ্ঠানে কোনো ধরনের মালিকানা নেই এমন পেশাজীবী সাংবাদিককে। বর্তমানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেশাজীবী সাংবাদিক-সম্পাদককে প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দিয়ে একই সঙ্গে প্রকাশকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় স্বাধীন সাংবাদিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সামগ্রিক সত্য প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শেয়ার পাওয়া কোম্পানির স্বার্থের বিপক্ষে যায়, এমন কোনো সংবাদ তারা প্রকাশ করেন না। পেশাজীবী সাংবাদিকদের জন্য পেনশনব্যবস্থা চালু করা উচিত।

একটি প্রতিষ্ঠানে তিন বছর সাংবাদিকতা করলে তিনি পেনশন পাওয়ার যোগ্য হবেন। পেনশন ফান্ড তৈরি হবে প্রতিষ্ঠান, কর্মরত সাংবাদিক ও সরকারের আর্থিক কন্ট্রিবিউশনে। বর্তমান সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ফান্ড প্রভিডেন্ট ফান্ডে স্থানান্তর করা যেতে পারে। বর্তমানে ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থ দিয়ে আসল ‘অসহায় ও দুস্থ’ চিহ্নিত করে অর্থ সাহায্যের নামে সমাজে হেয় করা হয় আর্থিকভাবে অসচ্ছল সাংবাদিকদের। পেনশন প্রথা এ অপমানজনক অবস্থা থেকে তাদের মুক্তি দেবে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের প্রায় পাঁচ মাস পর সরকারি মালিকানাধীন দৈনিক বাংলার সাপ্তাহিক প্রকাশনা বিচিত্রা প্রকাশের পর এর সঙ্গে যুক্ত মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিকরা সুধীজনদের প্রশ্নের উত্তরে বলতেন, ‘জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন তুলে ধরার জন্যই আমরা সংবাদিকতায় এসেছি।’ ৫২ বছর পর সাংবাদিকদের আবার নতুন করে বলতে হচ্ছে, জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন তুলে ধরার জন্যই গণমাধ্যম সংস্কার করতে হবে।

দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করার অঙ্গীকার করেছে এ সরকার। সরকারের এ পদক্ষেপে বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য প্রকাশে সাহসী গণমাধ্যম বড় ধরনের সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

চিন্ময় মুৎসুদ্দী : সিনিয়র সাংবাদিক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম