Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

কী বলছে রক্তরঞ্জিত গ্রাফিতিগুলো!

Icon

হাসান মামুন

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কী বলছে রক্তরঞ্জিত গ্রাফিতিগুলো!

ছবি সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের একপর্যায়ে কারফিউ জারির পরপরই আমাদের মহল্লার দেওয়ালে দেখতে পেয়েছিলাম কাঁচা হাতে ইংরেজিতে স্প্রে করে লেখা-‘কিলার হাসিনা’। পুলিশের উদ্দেশেও ভয়ংকর কথা লেখা ছিল পাশেই। সেটা এখানে আর উল্লেখ না করি। পুলিশ-জনতা সম্পর্কের মারাত্মক অবনতির পরিণতিতে তাদের ওপর ব্যাপক হামলাও ঘটে গেছে এর মধ্যে। পুলিশকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করার এই হলো পরিণতি! কর্মক্ষেত্র থেকে লাপাত্তা পুলিশের সিংহভাগই অবশ্য ইতোমধ্যে কাজে ফিরে এসেছে। ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে তাদের কাজটাও এতদিন সামলাচ্ছিল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।

এ এক নজিরবিহীন ব্যাপার। কোটা সংস্কার আন্দোলন অবশেষে যেভাবে একটি সরকারেরই পতন ঘটিয়ে দিল, সেটাও তো নজিরবিহীন। রক্তক্ষয়ী এ আন্দোলনের পর আবার দেওয়ালগুলো ভরে উঠছে শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতিতে। পথে যেতে যেতে বুদ্ধিদীপ্ত আর গভীর তাৎপর্যময় এসব কাজ দেখে মানুষ থমকে দাঁড়াচ্ছে। কেউ কেউ সেলফোনে তুলে নিচ্ছে ছবি। সেগুলো আবার শেয়ার করছে ফেসবুকে।

নটর ডেম কলেজের কাছে আমার বাসা থেকে বেরিয়ে এরই মধ্যে একদিন দেখি কলেজের দেওয়ালজুড়ে লেখা ‘৩৬শে জুলাই’! জুলাই তো ৩১ দিনে শেষ হয়েছে। কিন্তু ছাত্র-জনতা বলছিল, হাসিনা সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত জুলাই চলবে। সরকারের পতন হয় ৫ আগস্ট। তারা সেই দিনটিকে বলেছে ‘৩৬শে জুলাই’। গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর থেকে এসেছে এটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও একই ঢঙে ‘৩৬শে জুলাই’ লেখা দেখা যাচ্ছে। আমাদের এ বিশ্ববিদ্যালয় তো দেওয়াললিখনের জন্য আগে থেকেই খ্যাত।

কিন্তু ছাত্ররাজনীতির ধারেকাছে নেই যে নটর ডেম কলেজ, তার দেওয়ালজুড়েও এখন গ্রাফিতি। ওখানে দেখছি বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী রোমা রোলার উক্তি। এর দেওয়ালে এখনো আছে আন্দোলন সুতীব্রভাবে চলার সময় লেখা সরকারবিরোধী তির্যক স্লোগান। সারা দেশেই তখন এসব লেখা হচ্ছিল দেওয়ালে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল পাবলিক থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে; এমনকি স্কুলগুলোয়ও। এক পেশা থেকে আরেক পেশায়; এক শ্রেণি থেকে আরেক শ্রেণিতে। মাঠের বিরোধী দলগুলোও দ্রুত জড়িয়ে পড়ে আন্দোলনে। এটা হয়ে ওঠে ছাত্র-জনতার আশ্চর্য অভ্যুত্থান। স্বতঃস্ফূর্ততাই ছিল এর প্রাণশক্তি।

আন্দোলন সফল হওয়ার পর রাজধানীসহ দেশের দেওয়ালগুলোয় যেসব গ্রাফিতি দেখা যাচ্ছে, তাতেও স্বতঃস্ফূর্ততাই মূল ব্যাপার। সম্প্রতি তৃতীয় ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ সামিটে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘ঢাকার অনেকটা অংশ পরিণত হয়েছে বিশ্বের গ্রাফিতি রাজধানীতে। তরুণ শিক্ষার্থী এবং ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সি শিশুরা ৪০০ বছরের পুরোনো এ শহরের দেওয়াল নতুন গণতান্ত্রিক পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশের চিত্র দিয়ে রাঙিয়ে তুলছে। এজন্য কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা বা দিকনির্দেশনা নেই। কারও কাছ থেকে বাজেট সাপোর্ট পায়নি তারা। এটি দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্যের প্রতি তাদের আবেগ ও অঙ্গীকারের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।’

এখানে নিজের কথা একটু বলতে পারি। আমি কিন্তু কিছু গ্রাফিতি দেখে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছি। মগবাজারের দিকে গলির দেওয়ালে দেখছি লেখা-‘জেন-জেড : রক্ত গরম, মাথা ঠান্ডা’! যারা এমন একটি গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে শাসকচক্রের চরমতম আঘাত ব্যর্থ করে দিয়ে, তারা তো এ দাবি করতেই পারে। যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনটি পরিচালিত হয়েছে, তাদের মধ্যে ছিল আশ্চর্য সমন্বয়।

এর একাংশকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে পরিচিত নাটক সাজালেও আরেক অংশ ঠিকই দিয়েছে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা। আটক সমন্বয়করা যে অস্ত্রের মুখে সরকারের পছন্দমতো বক্তব্য দিতে বাধ্য হচ্ছে, সেটা বুঝতে অন্যদের মোটেও কষ্ট হয়নি।

‘স্মার্ট’ হাসিনা সরকার বুঝে উঠতে পারেনি, আরও কয়েকগুণ স্মার্ট জেনারেশনের মুখোমুখি হয়েছে তারা! সরকার পতনের পর পুলিশের অনুপস্থিতিতে যখন কিছু ডাকাতির ঘটনা ঘটছিল এবং বেশি ছড়াচ্ছিল গুজব, তখন ছাত্র-জনতাই রাত জেগে পাহারা দিয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। তখন তারা এমনকি ড্রোন উড়িয়ে ডাকাত খুঁজেছিল কোথাও কোথাও। যাদের বয়স হয়ে গেছে, তাদের কল্পনায়ও কি আসে এসব? রাজধানীতে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের সময়ও তারা সৃজনশীল কিছু সাজা দিয়েছে নিয়ম অমান্যকারীদের। এতে সাজা ভোগকারীরাও হয়েছে চমৎকৃত। এমন একজন ফেসবুকে লিখেছেন, রাস্তায় চলাচলের নিয়ম অমান্য করায় তাকে বলা হয়েছে-‘আপনি আমাদের সঙ্গে ৩০ মিনিট ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করবেন’! তিনি সানন্দেই করেছেন সেটা। বিশেষ পরিস্থিতিতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ যারা করছিল, তাদের কিন্তু আবার সতর্ক থাকতে হয়েছে ‘প্রতিবিপ্লব চেষ্টা’র ব্যাপারে। তবে তারা বোধহয় কাজ ভাগাভাগি করেই নিয়েছিল।

যেজন্য ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ চলাকালেও কিছু শিক্ষার্থীকে দেখা গেছে দেওয়াললিখন অব্যাহত রাখতে। আন্দোলনের সুফল ধরে রাখতে বেশি সজাগ অনেকে অবশ্য তখন বলছিলেন, গ্রাফিতি আঁকলেই চলবে না; পালটা অভ্যুত্থান চেষ্টার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে!

আমরা সে সতর্কতা জারি থাকতেই দেখেছি। এতে কিছু নেতিবাচক ঘটনাও ঘটে গেছে বলতে হবে। পরাজিত পক্ষের অধিকার লঙ্ঘনের মতো ব্যাপারও ঘটেছে। তবে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের পক্ষ থেকে জানাতে দেরি হয়নি যে, তারা এসবের নিন্দা করে এবং দায়ীদের শাস্তি চায়। দেওয়ালে গ্রাফিতিসহ যেসব লেখাজোখা হচ্ছে, তাতেও যে সব ক্ষেত্রে সুরুচির প্রকাশ ঘটছে, তা নয়। তবে এর সবকিছুতেই ঘটছে প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ আর আছে ‘নতুন দেশ’ গড়ার সংকল্প। গ্রাফিতি আঁকিয়েরা বলছে, পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রীর বিচার না হওয়া পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে। রাজধানীর বাইরেও চলছে গ্রাফিতি আঁকার কাজ। শুরুতে নিজেদের অর্থে তারা এটা করলেও চারদিক থেকে সহায়তার এখন আর অভাব হচ্ছে না। আশপাশের মানুষ গ্রাফিতি আঁকিয়েদের পানি ও খাবার সরবরাহ করছে। আন্দোলন চলাকালেও এ ধারার সহায়তা জোগাচ্ছিলেন অনেকে। বিনামূল্যে খাবার বিতরণের ঘটনা আমরা দেখেছি। আন্দোলনকারীদের পানি খাওয়াচ্ছিলেন অনেকে। তাদের মধ্যে পানি বিতরণ করতে গিয়েই তো মুগ্ধ নামের ছেলেটি নিহত হলো পুলিশের গুলিতে। এক পুলিশ অফিসার বিনা কারণে কাছ থেকে গুলি করে তাকে হত্যা করে। রক্তের মধ্যে পড়ে থাকে তার বহন করা পানির বোতল। একটা স্বাধীন দেশে ৫০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও আমাদের দেখতে হয় এমন দৃশ্য!

সেই মুগ্ধ এখন দেওয়ালে উঠে এসেছে গ্রাফিতি হয়ে। তার সেই উক্তি উচ্চারিত হচ্ছে বহু মানুষের মুখে-‘কারও পানি লাগবে, পানি?’ পানি খেতে গিয়েও আমাদের কি মনে পড়ে যাচ্ছে না হাস্যোজ্জ্বল এ তরুণের কথা? আমরা কি কোনোদিন ভুলতে পারব তাকে? ভুলতে কি পারব এ আন্দোলন বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে গেল যার আত্মদানে, সেই আবু সাঈদের কথা? পীরগঞ্জের গরিব ঘরের এ ছেলেটি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর্যায়ে উঠে ভর্তি হয়েছিল রংপুরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছিল এ আন্দোলনের একজন সক্রিয় সমন্বয়ক।

পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়ার আগে ফেসবুক পোস্টে সে লিখেছিল, দেশে এখন দরকার ড. জোহার মতো মানুষ। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্রদের বাঁচাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মাহুতি দেন ড. জোহা। আবু সাঈদও তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অমর হয়ে রইল বাংলাদেশের ইতিহাসে। প্রধান উপদেষ্টা নিজে চলে গেছেন পীরগঞ্জে তার সমাধির পাশে। আর দুই হাত প্রসারিত করে ঘাতক পুলিশের সামনে দাঁড়ানো আবু সাঈদের ছবিটি এখন শোভা পাচ্ছে দেওয়ালে দেওয়ালে। ফেসবুকে এক শিশুকে দেখা যাচ্ছে তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার মুহূর্তটি অভিনয় করে দেখাতে!

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এসব ঘটনা ছড়াবে কাহিনি হয়ে। মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেবে, এমন কতশত আবু সাঈদ এমনকি প্রাণঘাতী বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে রুখে দিয়েছিল এক স্বেচ্ছাচারী শাসককে। একের পর এক আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ায় অনেকে তো এমনটাও ধরে নিয়েছিলেন যে, মাফিয়ার মতো জেঁকে বসা এ সরকারকে কখনোই হটানো যাবে না। কোটা সংস্কারের মতো একটি দাবিকে ঘিরে সরকারের অহেতুক বাড়াবাড়ির প্রতিবাদে আন্দোলন কোত্থেকে কোথায় চলে গেল, সেটা ভাবতেই এখন অবাক লাগে। এটা কিন্তু সম্ভব হয়েছে শাসকদের অনাচার ও মিথ্যাচার দেখে দেখে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে ওঠা ছাত্ররা কোনোমতেই পিছু না হটার কারণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাহুবলে আন্দোলনকারীদের হটিয়ে দেওয়ার পর আমরা তাই দেখলাম, জেগে উঠেছে রামপুরা ও উত্তরা। এ দুই এলাকায় রাজপথ দখলে নিয়েছিল মূলত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্ররা। জনতাও নেমেছিল তাদের সঙ্গে। ছাত্রীদের অংশগ্রহণও ছিল উল্লেখযোগ্য। বলা হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের প্রাণ হলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এর মেরুদণ্ড। তারা সবাই অকাতরে বুকের রক্ত ঢেলে মর্যাদা রেখেছে রংপুরের সেই ছেলেটার, যার নাম আবু সাঈদ।

তার শত-সহস্র ভাইবোন এখন সারা দেশের দেওয়ালে এঁকে চলেছে গ্রাফিতি। এতে হয়তো ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আগের গ্রাফিতিগুলো-যেগুলো রাতের অন্ধকারে দ্রুততার সঙ্গে দেওয়ালের গায়ে বসিয়েছিল তাদেরই সতীর্থরা। এদের কেউ কেউ হয়তো নিহত হয়েছে পরে। সেজন্য আবার বলা হচ্ছে আগের গ্রাফিতিগুলো যথাসম্ভব রক্ষার কথা। অন্তত সেগুলোর ছবি তুলে যেন রাখা হয়। রাজধানীর একটি দেওয়ালে সেদিন দেখলাম নানা রঙে রাঙানো অগণিত হাতের ছাপ একসঙ্গে। দেখে গা কাঁটা দিয়ে উঠল। এসব তরুণ কী ইতিহাসই না সৃষ্টি করল দেশে! এটাকে কেউ বলছেন ‘বিপ্লব’। ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ও বলা হচ্ছে।

বলা হচ্ছে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’! নামকরণের এ বিতর্কে না গিয়ে শুধু বলব, জাতির সামনে অসাধারণ একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বহু মানুষের নজিরবিহীন আত্মদানে। গ্রাফিতিতে ছাত্রছাত্রীরা সে বিষয়টিই তুলে ধরছে আসলে। ফেসবুকে একটি ছবি ‘ভাইরাল’ হয়েছে; যাতে দেখা যাচ্ছে, হিজাব পরা এক তরুণী দেওয়ালে লিখছে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথা। বিশ্ব পরিসরে গৌরবের সঙ্গে থাকতে হলে বাংলাদেশকে তো এ ধারাতেই এগোতে হবে। গ্রাফিতিগুলো এক করলে আমরা সে বার্তাই পাব।

হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম