Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সহিষ্ণুতা ও অঙ্গীকার প্রতিপালনেই সম্ভব মানবিকতার বিকাশ

Icon

এম এ হালিম

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সহিষ্ণুতা ও অঙ্গীকার প্রতিপালনেই সম্ভব মানবিকতার বিকাশ

আজ বিশ্ব মানবিক দিবস। ২০০৩ সালের ১৯ আগস্ট ইরাকের বাগদাদে জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেলের বিশেষ দূত Sergio Vieira de Mello-সহ ২২ জন মানবিক কর্মী আততায়ীর হাতে নিহত হন। এ দিনটিকে স্মরণ করা, নিহতদের প্রতি সম্মান জানানো ও মানবিক কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতে ২০০৯ সালে জাতিসংঘ এ দিনটিকে বিশ্ব মানবিক দিবস (World Humanitarian Day) হিসাবে ঘোষণা করে। দিনটি পালনের লক্ষ্য হচ্ছে, মানবিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত কর্মী ও স্বেচ্ছাসেকদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও সম্মান সুসংহত করা।

এ বছর যখন দিনটি উপলক্ষ্যে লিখছি, এর আগে মাসাধিককাল বাংলাদেশে ঘটে গেছে অমানবিকতার শত উদাহরণ, যা হলো একটি স্বাধীন দেশের জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত বাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে মারণাস্ত্র ব্যবহার। এসব ঘটনায় হতাহত নিয়ে নানা তথ্য থাকলেও ১৬ আগস্ট জেনেভায় প্রকাশিত জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার প্রাথমিক রিপোর্টে ৩২ শিশুসহ ৬৫০ জনের প্রাণহানির কথা উল্লেখ করা হয়। তবে বেরকারিভাবে নিহতের সংখ্যা আরও বেশি বলে দাবি করা হচ্ছে। শনিবার সদ্য সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সাম্প্রতিক আন্দোলনে এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। জুলাই-আগস্টজুড়ে ঘটনায় নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষের প্রতি অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। নিরস্ত্র আবু সাঈদকে যেভাবে ঠান্ডামাথায় গুলি করে নিহত করা হয়েছে, তা সব অমানবিতাকে হার মানিয়েছে; কারণ আবু সাঈদ কাউকে হামলা করেনি অথবা তিনি কারও জীবনের জন্য হুমকিও ছিলেন না। ২৮ জুলাই যুগান্তরে প্রকাশিত ইসরাইল-হামাস যুদ্ধে উপেক্ষিত মানবতা বিষয়ে নিবন্ধে যুদ্ধের সময়ও শত্রুকে আক্রমণে উদ্দেশ্যে অস্ত্র ব্যবহারের নিয়ম সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের হেগ কনভেনশন ১৯০৭ এবং যুদ্ধাহত সৈন্য ও বেসামরিক মানুষের প্রতি আচরণবিষয়ক জেনেভা কনভেনশন ১৯৪৯ বিষয়ে আলোচন করেছিলাম। এসব কনভেনশন অনুসারে যুদ্ধকালেও নিরস্ত্র ও সাধারণ মানুষকে আক্রমণের নিয়ম রয়েছে। অথচ সাম্প্রতিক আন্দোলনে বাংলাদেশে নিরস্ত্র মানুষকে যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, তা মানবতাকে পদদলিত করা হয়েছে। সদ্য সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্দোলন থামাতে যে ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তা তাদের ব্যবহার করার কথা নয়।

বিশ্বজুড়ে কোথাও না কোথাও প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হচ্ছে। তার ওপর চলমান আছে যুদ্ধ-সংঘাত আর হানাহানি; যেমন: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ (ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে), সুদান গৃহযুদ্ধ (এপ্রিল ২০২২ থেকে), নাইজেরিয়া অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব (জুলাই ২০২২ থেকে), হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ (অক্টোবর ২০২৩ থেকে)। এছাড়াও রয়েছে দীর্ঘদিন প্রলম্বিত আফ্রিকাজুড়ে দুর্ভিক্ষ। এসব ঘটনার কারণে বিশ্বময় অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত (আইডিপি) ও শরণার্থী সংকট প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে ফেব্রুয়ারি ২০২১-এ সামরিক অভ্যুত্থানের পর নিপীড়ন ও নৃশংসতায় জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে ৩০ লাখ মানুষ এখন আইডিপি। এর বাইরে ২০১৬-১৭ সময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ১০ লক্ষাধিক জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত। এসব যুদ্ধে হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সিংহভাগই বেসামরিক মানুষ, যারা যুদ্ধ বা হানাহানির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক আন্দোলনে হতাহতে ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ ও তুচ্ছ কারণে অন্যকে আক্রমণ, এমনকি হত্যাকাণ্ড ঘটছে। মানুষই মানুষের প্রতি ক্রমশই যেন অসহিষ্ণু ও অমানবিক হয়ে উঠছে।

বিশ্ব মানবিক দিবসের প্রেক্ষাপট বর্ণনায় বলা হচ্ছে-বিশ্বে প্রতি ১০ জনে ১ জন রাতে ক্ষুধার্থ অবস্থায় ঘুমাতে যায়, বিশ্বব্যাপী ১২ কোটি মানুষ নিজ আবাসস্থল ছেড়ে আইডিপি অথবা উদ্বাস্তু, বিশ্বের ৩০ কোটি মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত, যাদের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন, বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের কাছে নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি একটি বিলাসিতা ইত্যাদি।

যুদ্ধ বা হানাহানি অথবা বিভিন্ন মানবিক সংকটের শিকার মানুষকে সাহায্য করার জন্য রেডক্রসসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা নিবেদিতভাবে কাজ করছে। এসব সংস্থা ও সংস্থার কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকরা বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিয়ে মানবিক সেবার দায়িত্ব পালন করে থাকে, অনেক ক্ষেত্রে তাদের জীবনহানিও ঘটে। মানবিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ২০২৩ সালে সারা বিশ্বে ২৬১ মানবিক কর্মী নিহত, ৭৮ অপহরণ এবং ১৯৬ আহত হয়েছ (সূত্র জাতিসংঘ)। আর ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে ১৯২ মানবিক কর্মী। এছাড়া দায়িত্ব পালনকালে চলমান গাজা যুদ্ধে ২৭৮, ইউক্রেন যুদ্ধে ১৬ জন মানবিক কর্মী নিহত হয়েছে।

দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ, সশস্ত্র সংঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন মানবিক সংকটে ভুক্তভোগীদের ও মানবিক কর্মীদের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চুক্তি, আইন অথবা অঙ্গীকার রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ১৯৬৫ সালে রেড ক্রস/রেড ক্রিসেন্ট গৃহীত ৪টি প্রধান মূলনীতি (মানবতা, পক্ষপাতহীনতা, নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা), রেড ক্রস, অক্সফাম, সেভ দ্য চিলড্রেনসহ ৮টি আন্তর্জাতিক সংস্থা মানবিক সহায়তা বিতরণকালে অনুসরণের জন্য ১০টি আচরণবিধি, মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় গুণগত মান, সহযোগিতার আদর্শ পরিমাণ ইত্যাদি নির্দেশনাসংবলিত ১৯৯৭ সালে সূচনা হওয়া The Sphere Humanitarian Charter (২০১৮ পরিবর্ধিত), মানবিক কর্মকাণ্ডে জবাবদিহিতা এবং বৈষম্য ও পক্ষপাতহীনতা বর্জনবিষয়ক ৯টি অঙ্গীকারসংবলিত মানবিক কর্মকাণ্ডে জবাবদিহিতা এবং গুণগত মূল আদর্শমান (Core Humanitarian Standard on Quality and Accountability-CHS), মানবিক কর্মকাণ্ড অধিক স্থানীয় সক্ষমতার ভিত্তিতে পরিচালনার উদ্দেশ্যে বাস্তবায়ন পদ্ধতিতে সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন আনার উদ্যোগসংবলিত পরিবর্তনের সনদ (Charter for Change বা C4C), ‘সক্ষমতা উন্নয়ন’ নয়, ‘সক্ষমতা বিনিময়’ ও স্থানীয়করণ (Localization) উদ্বুদ্ধকরণ উদ্যোগসংবলিত প্রত্যাশার সনদ (Charter of Expectations) ইত্যাদি। এসবের সাধারণ লক্ষ্য হলো-ভুক্তভোগীর সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও সম্মান প্রদর্শন, সাহায্য প্রাপ্তিতে তাদের অধিকারকে স্বীকৃতি ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, তাদের সক্ষমতাকে মূল্যায়ন করা এবং তাদের ঝুঁকি হ্রাসের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বিপদাপন্নতা হ্রাসকরণ। এছাড়া যুদ্ধ বিষয়েও রয়েছে অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আইন; যেমন-আন্তর্জাতিক মানবিক আইন (হেগ কনভেনশন ও জেনেভা কনভেনশন), আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, রিফিউজি আইন ইত্যাদি।

এক সময়ে মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিপদাপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে সাহায্য সংস্থার দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে অবজ্ঞা করা হতো, বরং ভাবা হতো-সাহায্য হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তকে অনুগ্রহ প্রদর্শন। তাদের ব্যক্তিগত সম্মানকেও অবজ্ঞা করা হতো। সমকালীন আন্তর্জাতিকভাবে ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। বলা হচ্ছে, সহযোগিতা পাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অধিকার। বাংলাদেশেও বিপদাপন্ন বা দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সম্মান, তাদের অধিকারকে মূল্যায়ন ও মানবিক আচরণের অঙ্গীকার প্রতিপালিত হচ্ছে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, বিভিন্ন সনদ ও অঙ্গীকার প্রতিপালন ও বিভিন্ন পক্ষের নজরদারি এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।

এ বছরের বিশ্ব মানবিক দিবসের স্লোগান হলো ‘Act For Humanity’। এ বছর বিশ্বজুড়ে চলমান সংঘাত ও যুদ্ধের শিকার মানবিক কর্মীসহ বেসামরিক মানষের সুরক্ষা ও তাদের প্রতি মানবিক আচরণ নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও অ্যাডভোকেসিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনসহ অন্যান্য আইন, অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি প্রতিপালনে সব রাষ্ট্র ও পক্ষের উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।

বিশ্বে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবসৃষ্ট ঘটনায় শতকোটি মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন হয়। এসব কাজে যেমন মানবিক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা সেবা দিয়ে থাকেন, পাশাপাশি অনেক অপ্রাতিষ্ঠানিক মানবিক কর্মী তথা স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকও তাদের সময় ও নিঃস্বার্থ সেবা দেন। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিভিন্ন দুর্যোগ ও সংকটে অনেক সাধারণ মানুষ মানবিক সেবায় এগিয়ে আসেন, যদিও তাদের সেবাকে খুব কম ক্ষেত্রেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিশ্ব মানবিক দিবসের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সব ধরনের কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকের সেবার স্বীকৃতি প্রদান। এ দিবসের আরও কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে। যেমন: বিপদাপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে জনসচতেনতা বৃদ্ধি, মানবিক সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের জন্য সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অ্যাডভোকেসি, মানবিক সেবা উদ্যোগ বাস্তবায়নে সহযোগিতার লক্ষ্যে অনুদান, স্বেচ্ছাসেবা ও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মানবিক সেবা কোনো একক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নয়, বরং প্রয়োজন ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক, করপোরেট ও সরকারি সমষ্টিগত অঙ্গীকার।

এত উদ্যোগের পরও থেমে নেই মানবতার প্রতি অবজ্ঞা। আইন ও অঙ্গীকারকে তাচ্ছিল করে দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ আর হানাহানিতে বেসামরিক মানুষ বিবদমান সৈন্য বা পক্ষের প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে ক্রমাগত। দ্বিপাক্ষিক ও বৈশ্বিক বৈরিতার কারণে দেশে দেশে যুদ্ধের দামামা বাজছে, যা থামানোর পরিবর্তে প্রলম্বিত করার জন্যই যেন অস্ত্র ও অর্থ সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে স্বার্থান্বেষী পক্ষ। তাই তো ২০২২ সালে জাতিসংঘ মহাসচিব এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বিশ্বমানবতা একটি ‘গুলিভরা বন্দুক’ নিয়ে খেলছে। তবে মানুষ ও বিবদমান পক্ষের মধ্যে সহিষ্ণুতা, জাতীয়-আন্তর্জাতিক আইন-চুক্তি ও অঙ্গীকার প্রতিপালন এবং মানবিক কর্মীদের নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সম্ভব সমাজ, রাষ্ট্র ও বৈশ্বিক অঙ্গনে মানবতার বিকাশ।

এমএ হালিম : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং দুর্যোগ, জলবায়ু ও মানবিক বিষয়ে কলাম লেখক

halim_64@hotmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম