সব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন
মোহাম্মদ আবদুল মাননান
প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অন্তর্বর্তী সরকারের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি নতুন সরকারের জন্য এটি কোনো সময়ই নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা রাষ্ট্রীয় কাজে মনোনিবেশ করেছেন। ১৬ বছর টানা ক্ষমতায় থাকা একটি সরকারকে হটিয়ে দেওয়ার পর নতুন সরকারের নানা চ্যালেঞ্জ থাকে এবং অগ্রাধিকার নির্দিষ্ট করে এগোতে হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সে পথেই এগোচ্ছে। অগ্রাধিকার তালিকায় না থাকলেও সরকার প্রথমেই কথিত ‘জুডিশিয়াল ক্যু’ সফলভাবে সামাল দিয়েছে। উচ্চ আদালত স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরেছেন।
মধ্য জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলন, ৫ আগস্ট সরকারের পতন এবং পতন পূর্ববর্তী-পরবর্তী সময়ে দেশে অর্ধ-সহস্রাধিক মৃত্যু, বিটিভি-মেট্রোরেল, গণভবন-সংসদ ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিগত স্থাপনায় ভাঙচুর, পুলিশের দায়িত্ব পালন থেকে স্বেচ্ছা অব্যাহতি ইত্যাদি কারণে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে। যদিও বলা হয়, একটি বিপ্লবে এমন হতেই পারে; কিন্তু মানবমৃত্যু আর সম্পদের ক্ষতি তো ক্ষতিই। এক সংসদ ভবন মেরামত করতেই দীর্ঘদিন লেগে যাবে। ঢাকার রাস্তায় পুলিশ ছিল না, ভাবা যায়! শিক্ষার্থীরা কটা দিন সামাল দিয়েছেন। পুলিশ ইতোমধ্যে দায়িত্বে ফিরেছে। পুলিশের দায়িত্বে ফেরাই যথেষ্ট নয়। একদিকে পুলিশে ব্যাপক দলীয়করণ হয়েছে, অন্যদিকে পুলিশ মনোবল হারিয়েছে। দ্রুত এদিকে মনোনিবেশ করা সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হলে নানা বিপত্তি দেখা দিতে পারে।
অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। রিজার্ভ তলানিতে। খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি। ব্যাংক পাড়ায় বিশৃঙ্খলা। মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। ব্যবসায় গতি নেই। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ। ফলে দেশের অর্থনীতি সামাল দেওয়া সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দ্রুতই প্রশাসনে শৃঙ্খলা-স্থিতিশীলতা ও সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রশাসনকে দলীয়করণের শেষ ধাপও পেরিয়ে গেছে। কিন্তু সরকারকে কাজ করতে হলে সরকারি কর্মীদের লাগবেই। ফলে ঢালাওভাবে সবাইকে যেমন বাদ দেওয়া যাবে না, তেমনি সবাইকে আস্থায় নিয়েও কাজ করা যাবে না। সরকারের জন্য এ কাজটি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানেরই স্বাভাবিক চরিত্র বিগত সরকার ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান থেকে ইউনিয়নের ছোট অফিস-একটিও দলীয়করণের বাইরে নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের মূল চরিত্র ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করতে হবে। তবে এর জন্য সময়ের দরকার হবে। নির্বাচন কমিশনসহ কয়েকটি সাংবিধানিক সংস্থার পুনর্গঠনে দ্রুত নজর দেওয়া প্রয়োজন।
দেশের হিন্দু সমাজের ওপর কোথাও কোথাও হামলার তথ্য থাকলেও বাস্তবে এর এক-দশমাংশও ঘটেনি। আর এটি কোনো সাম্প্রদায়িক ব্যাপার নয়। তবে সরকারকে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্তদের আস্থায় ফেরাতে হবে। সরকারের আছে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কিছু চাওয়া আছে। বিএনপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচনের জন্য সরকারের সময়সীমার নির্দিষ্টকরণ চাইবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সংগঠিত হওয়া নিয়েও বিপদ-বিসম্বাদ দেখা দিতে পারে। আন্দোলনে নিহতদের বস্তুনিষ্ঠ তালিকা প্রণয়ন এবং ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা, সেই সঙ্গে আহতদের সুচিকিৎসায় গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। এছাড়া হত্যার দায়দায়িত্ব নিরূপণপূর্বক বিচার শুরু করা চাই। অকারণে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির প্রক্রিয়া অবশ্য শুরু হয়ে গেছে। সর্বোপরি বৈদেশিক সম্পর্ক, বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা সরকারের জন্য একটি অগ্রাধিকারের বিষয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। প্রাথমিকের লেখাপড়া নিয়ে বিস্তর বলার আছে; তবে সেটা এই পরিসরে নয়। এইটুকু জারি রাখা দরকার-তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণিতে যেটুকু ইংরেজি-গণিত শেখা দরকার, সেটা হচ্ছে না। ফলে শিক্ষার ভিতের এ জায়গায় নানা সংস্কার ও পদক্ষেপ দরকার। একইসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরেও নানাবিধ সংস্কার দরকার। বিশেষ করে, প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাঠ্যক্রম নিয়েই বিস্তর বিতর্ক জারি আছে। ঘন ঘন বই বদলের কারণে ভীষণ সংকট চলছে শিক্ষাঙ্গনে।
ক্ষমতাচ্যুত সরকার উচ্চ শিক্ষাঙ্গনকে দলীয়করণের উপান্তে নিয়েছে। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা নিয়মিত সংসদ ফি দিয়েছে; সেটা খরচও হয়েছে। কীভাবে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটিমাত্র ছাত্র সংগঠনেরই একচেটিয়া আধিপত্য ছিল, অন্য দলকে ঢুকতেই দেয়নি তারা-চালিয়েছে নানা নির্যাতন; ক্ষেত্রবিশেষে পুলিশ এ অপকর্মে সহায়তা দিয়েছে। ফলে একটি ছাত্র সংগঠনই হলে হলে খেয়াল-খুশিমতো সিট বিতরণ করেছে, ঠিকাদারি কাজের ভাগবাঁটোয়ারা করেছে, চাঁদা তুলেছে। গেস্টরুম সংস্কৃতি কায়েম করে নানা অত্যাচার চালিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেনি, কোথাও কোথাও ইন্ধনও জুগিয়েছে। এর একটা বড় কারণ, সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ পদগুলোতে দলদাস নিয়োগ দিয়ে তাদের মাধ্যমে সরকার-সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের নানা সেবা নিশ্চিতসহ যাবতীয় অপকর্মের ঢালের ভূমিকা পালন করিয়েছে। আবার বিভিন্ন জেলায় প্রতিষ্ঠিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগে মহাপ্রলয় ঘটিয়েছে। স্থানীয় সরকারি দলের নেতাদের পছন্দের বাইরে এবং বিশেষভাবে লাভবান হওয়া ছাড়া কার্যত কোনো নিয়োগই হয়নি। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিশেষ নজর দেওয়ার দরকার হবেই। গত সেশনের গুচ্ছের ভর্তি এখনো শেষ হয়নি, শুরু হয়নি ক্লাস।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগকৃতদের অনেকেই স্বেচ্ছায় পদ ছেড়েছেন, কেউ কেউ এখনো বহাল আছেন। ফলে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক সমস্যা দেখা দিতে বাধ্য। তবে দলদাসদের স্বেচ্ছায় পদত্যাগই বরং সম্মানের। একই ঘটনা ঘটেছে ইউজিসির ক্ষেত্রেও। যাদের কথায় কথায় বলতে হয়েছে, অমুক ছাত্র সংগঠনের এই এই ছিলাম কিংবা সরকার সমর্থিত ছাত্রদের সকাল-সন্ধ্যা তেল মারাই যাদের দিনের মূল কাজ ছিল, তাদের পদত্যাগই প্রত্যাশিত। বুঝি না, আওয়ামী লীগের মতো পুরোনো-বৃহৎ-সুসংগঠিত দলের সরকারও ভিসি-প্রোভিসি-ট্রেজারার নিয়োগে এতটা দায়িত্বহীনতার পরিচয় কী করে দিয়েছিল! আওয়ামী লীগ মনোভাবাপন্ন বহু ভালো শিক্ষক আছেন, যারা পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদে যাওয়ার সব যোগ্যতা রাখেন। কিন্তু বেছে বেছে এমনদের দেওয়া হয়েছে, যাদের দলদাস-তেলবাজ ছাড়া কিছুই বলা যায় না (সামান্য ব্যতিক্রম আছে)। কারও কারও উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা নেই, তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়েছেন-ভাবা যায়! অনেকের আবার সরকারের অর্থবিধি সম্পর্কে সামান্য ধারণাও ছিল না। ফলে আর্থিক অনিয়ম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিত্যসঙ্গী। অনেক ক্ষেত্রে গুরুতর অনিয়ম। আর শিক্ষক নিয়োগে কী ‘মহাপ্রলয়’ ঘটেছে, ভাবাই যায় না। মেধাবীদের বাদ দিয়ে হয় দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, নয়তো স্থানীয় নেতার পছন্দই হয়েছে শেষকথা। এই শিক্ষকরা আগামী ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ছেলেদের কী শিক্ষা দেবেন?
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব শূন্যপদে দ্রুত নিয়োগ দেওয়া না হলে অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক-একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করাই দুরূহ হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরুর পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। আজ সব বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কথা। তবে বিশ্ববিদ্যালয় খোলাই শেষ কথা নয়, শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ ফিরিয়ে দিতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ বটে। বিগত ১৫-১৬ বছরে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে; যাদের অনেকের মধ্যেই আওয়ামী প্রেতাত্মা ভর করে আছে আর এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি স্বৈরাচারী সরকারের দোসর বলে অভিহিত। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক পরিবেশ ফেরাতে হলে একদিকে সরকারকে এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদে নিয়োগে অধিক যোগ্যদের নিয়ে আসতে হবে।
মোহাম্মদ আবদুল মাননান : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার