নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর এখনই সময়
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিরল ও অভূতপূর্ব ঘটনা অর্থনীতির জগতে। তিনজন প্রধানই অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তারা তিনজনই অর্থনীতির ছাত্র, প্রতিষ্ঠিত গবেষক। এটা আগে কখনো বাংলাদেশে ঘটেনি। সরকারপ্রধানের কথা বাদ দিলাম, ইতঃপূর্বে অর্থমন্ত্রীদেরও সম্ভবত একজন বাদে আর কেউ অর্থনীতিবিদ ছিলেন না। গভর্নর পদে আমলাদেরই প্রাধান্য ছিল, যদিও একবার/দুবার ব্যাংকাররা গভর্নর হয়েছেন, সম্ভবত দুবার অর্থনীতিবিদ গভর্নর হয়েছেন। এ প্রেক্ষাপটে বলা যায়, অর্থনীতি আজ অর্থনীতিবিদদের হাতে। যারা এতদিন বাইরে থেকে কথা বলতেন, পরামর্শ দিতেন, উপদেশ দিতেন, সমালোচনা করতেন-তারাই আজ দেশের অর্থনীতির মূল কর্তা। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, তাদের আর পরামর্শ দিতে হবে না কাউকে। তারা অর্থনীতি, ব্যাংকিং, ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্যার কথা জানেন। সমাধানের পথও তাদের জানা। দ্বিতীয়ত, তিনজনই মিডিয়ার পরিচিত মুখ। তাদের আরও সুবিধা এই যে, তারা আন্তর্জাতিক সংস্থা, দাতা, প্রতিষ্ঠান, বিদেশি সরকারগুলোর কাছেও পরিচিতজন। সবচেয়ে বড় কথা, এ মুহূর্তে তাদের শক্তি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা। অতএব, দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে প্রচলিত রাজনৈতিক বাধার সম্মুখীন তাদের হতে হবে না। এ এক বিশাল সুযোগ, সম্ভাবনা-ভালো কাজ করার। এতগুলো সুবিধায় বলিষ্ঠ অর্থনৈতিক নেতৃত্বের কাছে জাতির আশা অনেক বেশি। বাকিটা ভবিষ্যৎ বলবে। সেটা পরের কথা।
এ মুহূর্তের কাজ হিসাবে নতুন নিযুক্ত অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি কৃষকের সার, জ্বালানি তেল, শিল্পের কাঁচামাল ও মেশিনারি আমদানিতে গুরুত্ব দেবেন। যুগান্তরে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, তিনি অর্থনৈতিক খাত সচল করতে এবং অস্থিরতা কমিয়ে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে চান। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খাদ্য, কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসবেন। বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একার পক্ষে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়-যদিও এটাই তাদের প্রধান দায়িত্ব। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনি বলেছেন; তিনি সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক ভালো করার তুলনায় মানুষের জীবনযাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য ফেরাতে চান। মোটা দাগে এই হচ্ছে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। যেদিন লিখছি, সেদিন পর্যন্ত গভর্নর গতিশীল হননি, আর প্রধান উপদেষ্টার মতামত সম্পর্কে দেশবাসী, বিশ্ববাসী সবাই অবগত। অতএব, ওই দিকে যাচ্ছি না।
নজর দেওয়া যাক অতি জরুরি ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে। অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, প্রবাসী আয়, কৃষি-সবই নির্ভর করে ব্যাংকগুলোর ওপর। ব্যাংকগুলো ঠিক না হলে কিছুই সম্ভব নয়। অন্য আরও বিষয় অবশ্যই আছে। তবে ব্যাংকিং শৃঙ্খলাটি প্রথম। এ খাতটি নানা সমালোচনায় জর্জরিত। এর ভাবমূর্তি তলানিতে। এর কারণ অনেক, যার মূলোৎপাটন করতে হবে। এর জন্য আমি মনে করি তিন ধরনের পদক্ষেপ দরকার : দ্রুত, মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি। এসবে কোনো আবেগের স্থান নেই। বাস্তবোচিত পদক্ষেপ দরকার। অতএব, গোড়া থেকে শুরু করি। প্রথমেই দরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকটিকে মেরামত করা। এটিকে একটি ‘রাবার স্ট্যাম্প প্রতিষ্ঠানে’ পরিণত করেছেন সবজান্তা আমলারা। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন, ব্যাংকগুলোকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়েছেন। ব্যাংকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে অদক্ষতা, অকর্মণ্যতা, অপদার্থতা আর অনিয়ম। অভিযোগ আছে ঘুস-দুর্নীতিরও, যা এক সময় ছিল কল্পনাতীত। বাংলাদেশ ব্যাংক একটা ‘পলিসি নৈরাজ্য’ সৃষ্টি করেছে। তারা মানুষকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভুল বুঝিয়েছে। সর্বোপরি প্রতিষ্ঠানটি পরিণত হয়েছিল লুট, প্লান্ডার, অনিয়ম ও বিগ বিজনেসের বিচরণক্ষেত্রে। গভর্নররা পর্যন্ত মাফিয়াদের দ্বারা আক্রান্ত হতেন তাদের চেম্বারে। ব্যাংকের ক্ষমতায়ন, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শত শত কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। কর্মকর্তারা দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন, স্বার্থ ঘুচিয়েছেন। কর্মচারীদের দ্বারা কর্মকর্তাদের পেটানোরও নজির আছে। নৈরাজ্যের চূড়ান্ত। এসব থেকে মুক্ত করার জন্য এক নম্বর পদক্ষেপ হোক ‘ব্যাংকিং ডিভিশন’ বিলুপ্তি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ বিভাগ বিনা কারণে সৃষ্টি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা, কার্যপরিধি নষ্ট করা হয়েছে। পদে পদে তারা হস্তক্ষেপ করে। অথচ ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব, আইনি দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এ বিভাগের কোনো দায়িত্ব নেই। আছে খবরদারি আর সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার মাতব্বরি। প্রতিটি ব্যাংকের ডজন ডজন গাড়ি থাকে এই বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে। এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শেষ করেছে, ব্যাংকগুলোকেও শেষ করেছে। অবিলম্বে তা তুলে দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হোক। সরকারকে ঢালাওভাবে ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা রহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন হোক।
দ্বিতীয় যে কাজটির কথা কেউ বলবে না, তার কথা বলতে হয়। আজ দেখা যাচ্ছে ব্যাংকে ব্যাংকে কর্মচারী-কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ। এর অনেক কারণ। দীর্ঘমেয়াদি শাসনে একশ্রেণির ঊর্ধ্বতন ব্যাংক কর্মকর্তা মালিক/সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ করে ব্যাংকে ব্যাংকে স্বৈরশাসন কায়েম করেছেন। তারা ব্যাংকের স্বার্থ দেখেননি। মালিকের স্বার্থ দেখে পদোন্নতি নিয়েছেন। মালিকদের অবৈধ সুবিধা দিয়েছেন। এসব দিতে নিচের কর্মকর্তাদের বাধ্য করেছেন। হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্ত করেছেন। পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন। ব্যাংকে ব্যাংকে খেলাপি ঋণগ্রহীতা তৈরির জন্য এরাই দায়ী। সাধারণ ঋণগ্রহীতাদের কোনো মূল্য নেই। তারা বড় বড় গ্রাহকের স্বার্থ দেখেছেন। ওইসব বড় বড় কর্মকর্তার একটা অংশ মালিকদের অর্থ পাচারেও সাহায্য করেছেন। ভুল তথ্য দিয়েছেন সর্বত্র। দানবিক একটা সাম্রাজ্য ব্যাংকে ব্যাংকে। ব্যাংক খাতের ওইসব দানবের নাম সবারই জানা। তাদের অপকর্মের কথা সবারই জানা। ১৪ তারিখে যুগান্তরে তা ছাপা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রথমেই দরকার ব্যাংকারদের-সৎ, কর্মঠ, দক্ষ ব্যাংকারদের-মনোবল ফিরিয়ে আনা। চারদিকের প্রাপ্য, অপ্রাপ্য সমালোচনায় তাদের মনোবল ভেঙে গেছে। ব্যাংকের ‘তালুকদাররা’ ব্যাংকে ব্যাংকে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে। বছরের পর বছর পদোন্নতি নেই। এর বিপরীতে খাতিরের লোকের চাকরি, ‘এলাকার’ লোকের চাকরি, পদোন্নতি, দফায় দফায় পদোন্নতি হয়েছে। প্রশাসনে যা ঘটেছে, ব্যাংকে ব্যাংকেও তা-ই ঘটেছে। প্রশাসনের অবিচার দেখছি সমাধান হচ্ছে। অবিলম্বে ব্যাংকে বছরের পর বছর পদোন্নতিবঞ্চিতদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হোক। বরখাস্ত, চাকরিতে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি ফেরত দেওয়া হোক। বিচারের আওতায় আনা হোক দুর্নীতির গডফাদার ব্যাংক মালিকদের দোসর ব্যাংকারদের। এটা জরুরি কাজ। সবাইকে আশ্বস্ত করুন। সবাইকে উৎসাহ দিন। তাদের কাছ থেকে ব্যাংকের সমস্যা জানার চেষ্টা করুন। কীভাবে ‘দুই নম্বরি’ হয়েছে, কারা কীভাবে তা করেছে, তাদের সাহস দিলে তারা বলবে। এতে কাজ করতে সুবিধা হবে।
আরেকটা কথা। অনিয়মের জন্য চাকরি হারান, শাস্তি পান নিচের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অথচ তারা চাকরি রক্ষার্থে, পরিবার বাঁচানোর জন্য এসব করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে। তাদের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া দরকার। এসব কারণে শত শত ব্যাংকারকে নানা সরকারি প্রতিষ্ঠানে দৌড়াতে হচ্ছে। জবাবদিহি করতে হচ্ছে। আসল ‘ডাকাত’র খবর নেই-কর্মকর্তারা বিপাকে। এ সমস্যার ফয়সালা করুন-ব্যাংকারদের বাঁচান। পুলিশ চিৎকার করে মন্ত্রীর সামনে তাদের কথা বলতে পারে। সবারই সংগঠন, অ্যাসোসিয়েশন আছে। ব্যাংকার হলো একমাত্র পেশা যার কোনো ইউনিয়ন (সমিতি) নেই। তাদের দক্ষ বলার কোনো লোক নেই। অর্থ উপদেষ্টাকে বলব এদিকে নজর দিতে। নিচ থেকে সমস্যাগুলো জানতে।
ব্যাংকে সুশাসনের জন্য অনেক পদক্ষেপ দরকার। এসব ভিন্ন আলোচনা। যেমন মালিকানা সমস্যা, যার কথা অর্থ উপদেষ্টা স্বয়ং জানেন। এসব জটিল বিষয়। ধীরে ধীরে সমাধান করতে হবে আইনগতভাবে। তবে একটি সুপারিশ আমি করব। সুশাসন প্রতিষ্ঠার এক নম্বর ‘খুঁটি’ হচ্ছে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী (সিইও) বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। বোর্ড তাকেই দৈনন্দিন ব্যাংক পরিচালনার ক্ষমতা দেয়। তার সই ছাড়া ব্যাংক চলবে না। অনিয়ম করতে হলেও তার সই দরকার, নিয়মের মধ্যে কাজ করতে হলেও তার সই দরকার। এমডির পদটি এ কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বোর্ডের কোনো ক্ষমতা নেই তার সই ছাড়া কোনো কাজ করার। এ জায়গাতেই গণ্ডগোল। মালিক/সরকার বশংবদ এমডি নিয়োগ দিয়ে ‘পার্টনারশিপ’ তৈরি করে। এমডিও বশংবদ অফিসার চারপাশে রেখে অনিয়মগুলো করে। দেখা যায়, এক এমডি এক ব্যাংক থেকে বিদায় হয়ে অন্য ব্যাংকে গেলে সঙ্গে করে নিয়ে যায় তার বশংবদদের। কায়েম করে নতুন করে ত্রাসের রাজত্ব। ছাঁটাই শুরু করে পুরোনো অফিসারদের। কোনো কোনো এমডি ব্যাংকে এমডিগিরি করেন/করছেন বছরের পর বছর। এদের কার্যকাল দুই টার্মের বেশি কোনোভাবেই হওয়া উচিত নয়। পরে উপদেষ্টা হওয়াও বন্ধ করা দরকার। দেখা যায়, নিয়ম ভেঙে পর্যন্ত উপদেষ্টা করা হয়েছে ‘ব্যাংকিং মাফিয়া’ কর্তৃক। নৈরাজ্য এভাবেই সৃষ্টি হয়। এসব বন্ধ করা দরকার। এক কথায়, এমডি পদটিকে ‘ফিক্স’ করা হোক। তাকে ক্ষমতা দেওয়া হোক, রক্ষা করা হোক। তার ওপর নজরদারি রাখা হোক। ব্যাংকে বাইরের তদারকি প্রতিষ্ঠানের লোকজন নিয়োগ নিরুৎসাহিত করা দরকার।
আরও একটা কথা। অর্থ উপদেষ্টা জানেন, ব্যাংকগুলোকে ধনীলোক বানানোর হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এটা ‘ব্যাংক লেড গ্রোথের’ ফল। দেখে পুঁজি নেই, পুঁজিপতি নেই। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য টাকাওয়ালা লোক দরকার। অতএব, কিছু লোককে ধনী বানাও। যেমন করেছে চীন, করছে ভারত, ভিয়েতনাম ইত্যাদি অনেক দেশ। পুঁজিবাজার নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। লুট করা হয়েছে। টাকা দেবে ব্যাংক। এই নীতি ঋণখেলাপি তৈরি করেছে অনেক বেশি। ‘টাকা ধরিয়ে দেওয়ার’ নীতি থেকে ব্যাংকগুলোকে বের করে আনুন তাড়াতাড়ি। মাঝারি ও ছোটদের ঋণ চাহিদা মেটান জরুরিভিত্তিতে। আবেগ দিয়ে না চলার পরমার্শ দেব তাকে। খেলাপি ঋণ ঠিক করতে না পারলে এগুলো যাবে না। অথচ এই জঞ্জাল ৫০-৫২ বছরে সৃষ্ট, বিশেষ করে সৃষ্ট গত ১৫-২০ বছরে। এটি বিশাল সমস্যা এখন। পুরোনো সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির পরিবর্তনের ফলে নতুন নতুন খেলাপি তৈরি হচ্ছে। লঞ্চ/স্টিমার ব্যবসা, বাস ব্যবসা ইত্যাদি এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। এ সমস্যা সমাধানে খেলাপিদের ‘কোমরে দঁড়ি বাঁধা’র নীতি অনুসরণ করা যায়। শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়। খেলাপি ট্রাইব্যুনাল করা যায়। খেলাপিদের অপমানিত করার নীতি অনুসরণ করা যায়। জনগণ তা-ই চায়-আমরাও চাই। এর ফলই ‘হলমার্ক’র বিচার-সোনালী ব্যাংকের। এর থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার মামলা। ১১টি মামলা হয়েছে এর মালিক এবং সংশ্লিষ্ট লোকদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে মাত্র একটি মামলার রায় হয়েছে ১২ বছর পর। আদায় হয়েছে ৪৫৭ কোটি টাকা। মালিকদের কারাদণ্ড হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদে। ১২ বছর পর! প্রশ্ন, কত লোক কর্মচ্যুত হয়েছে, কারখানার যন্ত্রপাতি, কাঁচামালের খবর কী? আমদানি-রপ্তানির খবর কী? সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের প্রত্যাশা ও দাবি অনুযায়ী স্ক্যাম পার্টির বিচার হয়েছে যদিও দেরিতে-কিন্তু কত টাকা আদায় হয়েছে সেই খবর কিন্তু নেই। কারখানাটি কি চালু আছে? জানি না। বলা হচ্ছে, সব টাকা আদায় করা যাবে, যদি কোম্পানি/গ্রুপের সম্পদ বিক্রি করা যায়। ৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ কেনার লোক পাওয়া যাবে তো? কে এত টাকার ‘হোয়াইট মানির’ মালিক? সিনহা বড় গ্রুপ। খেলাপি। এর কারখানা বিক্রি করতে গিয়ে ক্রেতা পাওয়া যায়নি। ব্যাংক থেকে কেউ সম্পত্তি কিনতে চায় না। দ্বিতীয় পথ হচ্ছে কারখানার জায়গায় ‘ইকোনমিক জোন’ করা, যার কথা ব্যাংক ভাবছে বলে জানতে পারা যায়। এটা ভবিষ্যতের কথা। আসল কথা হলো-বিচার হয়েছে, টাকা আদায় হয়নি, হবে কিনা সন্দেহ। সম্পত্তি আসলে আছে কিনা, থাকলে কার দখলে আছে, তাও আমরা জানি না। এই হচ্ছে আবেগ ও বাস্তবতার মধ্যে ফারাক। আমাদের দরকার আবেগের প্রতি সম্মান দেখানো, আবার টাকাও আদায় করতে হবে। নতুনবা ওইসব খেলাপি ঋণের টাকা ‘কস্ট অব ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন’ হিসাবে তামাদি গণ্য করা। কঠিন সিদ্ধান্ত। ব্যাংক সচল রাখা, অর্থনীতি সচল রাখা, কারখানা চালু রাখা, কর্মচ্যুতি না ঘটানো, আমদানি-রপ্তানি, রাজস্ব আয় ঠিক রাখা। এই কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি পাশ করলে আমরা বেঁচে যাব। আর বিফল হলে হতাশ হব। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত তিন অর্থনীতিবিদ নীতিনির্ধারণী অবস্থায় কতটুকু আমাদের জন্য এনে দেন। শুভেচ্ছা রইল তাদের প্রতি।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়