নিজেকে কখনো ‘মহাবীর’ ভাবা উচিত নয়
মহিউদ্দিন খান মোহন
প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একটি অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে দেশবাসী মুক্তি পেয়েছে। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন শেষ হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে। পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর ছিল যে, শেখ হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। পরিবারের সদস্যরা বোধকরি আগেই চলে গিয়েছিল। ৫ আগস্ট শুধু দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বলা যায়, এক কাপড়ে গণভবন থেকে বেরিয়ে দেশ ছেড়েছেন। ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন বলাই যুক্তিযুক্ত। কেননা, কতটা চাপের মুখে পড়ে তিনি তার অতিপ্রিয় গণভবন ছেড়েছেন, তা অনুমান করা শক্ত নয়।
আওয়ামী লীগ সরকার ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ করুণ পরিণতি নিয়ে সর্বত্র এখন আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। চলবে আরও অনেকদিন। ভবিষ্যতে হয়তো গবেষণাও হবে। কেননা, আমাদের দেশে আন্দোলনের মুখে অনেক সরকারের পতন ঘটলেও, সেসব সরকারপ্রধান দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি জেলে গেছেন; কিন্তু দেশত্যাগ করেননি। ইচ্ছা করলে পারতেন। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও বামজোটের সম্মিলিত আন্দোলনের মুখে ৩০ মার্চ পদত্যাগে বাধ্য হয় বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সদ্য গঠিত বিএনপি সরকার। বেগম খালেদা জিয়া দেশত্যাগ করেননি। সবারই মনে থাকার কথা, ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের চাপের মুখে শেখ হাসিনা ‘কানের চিকিৎসার’ অজুহাতে দেশ ছেড়ে চলে গেলেও, বেগম জিয়া যাননি। অবশ্য ওয়ান-ইলেভেন সরকার বেগম জিয়াকে দেশত্যাগ করাতে ব্যর্থ হওয়ার পর শেখ হাসিনাও দেশে ফিরে এসেছিলেন। পরে তারা উভয়ে পাশাপাশি সাব-জেলে বন্দি ছিলেন। সে ইতিহাস সবারই জানা।
প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য হলেন কেন? তার কি জীবন সংশয় দেখা দিয়েছিল? সে সময় রাজধানী ঢাকার পরিস্থিতির কথা বিবেচনায় নিলে এটা মানতেই হবে যে, এ ছাড়া শেখ হাসিনাকে জনরোষ থেকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় ছিল না। তবে পরিস্থিতি ওরকম গুরুতর আকার ধারণ করল কেন, তা নিয়ে নানাজনের নানা মত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, দেশি-বিদেশি চক্রান্তের ফলে পরিস্থিতি শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। আবার অনেকের মতে, শেখ হাসিনার আত্মঅহমিকা ও জেদ এবং তার দলের কতিপয় নেতার আস্ফালন পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তুলেছিল; যার পরিণতি এ গণবিস্ফোরণ।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটির পেছনে কোনো রাজনৈতিক ইস্যু প্রথমদিকে ছিল না। সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের ফলে তা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ও সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবির আন্দোলনে পরিণত হয়। সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নিরীহ ও অহিংস আন্দোলনটি যে শেষ পর্যন্ত সরকারকে গদিচ্যুত করবে, এ ধারণা কারও ছিল না। সাবেক শাসক দলের তো নয়-ই। রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহলের মতে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে অবজ্ঞা করে ও উসকানি দিয়ে সেই সরকারই নিজেদের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। আওয়ামী লীগ ভাবতেই পারেনি, অভিজ্ঞ কোনো রাজনৈতিক নেতার নেতৃত্ব ছাড়াই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তাদেরকে গদিছাড়া করবে। শুধু তাই নয়, দলের সভাপতি ও প্রথম সারির অনেক নেতাকে গোপনে দেশত্যাগ করতে হবে, এটাও তাদের ধারণায় ছিল না।
আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন সরকারপক্ষের কথাবার্তায় লক্ষ্য করা গেছে ‘ড্যামকেয়ার’ ভাব। আওয়ামী লীগ পুলিশি শক্তি ও তাদের সাংগঠনিক শক্তির ওপর এটাই আস্থাশীল ছিল যে, তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করছিল বললে অত্যুক্তি হবে না। তারা ভেবেছিল, গত পনেরো বছর তারা বিএনপির নানা দফার আন্দোলনকে যে কায়দায় দমন বা মোকাবিলা করেছেন, এবারও তাই করবেন। আর সেজন্যই ওবায়দুল কাদেরকে বলতে শোনা যায়, এ আন্দোলন মোকাবিলা করতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। তার এ দম্ভোক্তি জ্বলন্ত আগুনে পেট্রোল ঢেলে দেওয়ার কাজ করেছে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ছাত্রলীগের যেসব বীর সৈনিকরা বীরদর্পে মাঠে নেমেছিল, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে উচিত শিক্ষা পেয়ে মাত্র এক দিনেই রণেভঙ্গ দিয়েছিল। পাশাপাশি পুলিশের নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও তাতে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি সাধারণ মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। তারা এতটাই বিক্ষুব্ধ হয়েছিল যে, টিয়ারগ্যাস-বুলেটকে থোড়াই কেয়ার করে রাজপথে দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল; যেখান থেকে তাদের হটিয়ে দেওয়া সেই সরকারের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি।
এটা তো ঐতিহাসিক সত্য, যে আন্দোলনে রাজনৈতিক দল বা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত হয়, সে আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, রক্তভেজা পথ অত্যন্ত পিচ্ছিল হয়। যত শক্তিশালী শাসকই হোক, জনগণের রক্তে ভেজা পথে তারা বেশিদূর হাঁটতে পারে না। কিছুদূর গিয়েই মুখ থুবড়ে পড়তে হয়। কয়েকশ মানুষের বুকের রক্তে পিচ্ছিল হয়ে ওঠা পথে তাই আওয়ামী লীগ আছাড় খেয়ে পড়েছে।
শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নেতারা চিন্তাও করতে পারেননি, তাদের পায়ের তলার মাটি একেবারেই সরে যাবে। দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার ফলে তাদের মনে এই প্রতীতী জন্মেছিল যে, এদেশে কোনো রাজনৈতিক শক্তি তাদের ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে না। আর সেজন্যই ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ পালায় না, শেখ হাসিনা পালায় না।’ কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! এ দম্ভোক্তির এক সপ্তাহ পার না হতেই তাদেরকে গদি ছেড়ে, দেশ ছেড়ে পালাতে হলো! তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে, জনতার সম্মিলিত শক্তির কাছে তাদের পরাভব মানতে হলো। শেখ হাসিনার এ পরিণতি থেকে রাজনীতিকদের দুটি বিষয় শিক্ষণীয় আছে বলে আমার মনে হয়। এক. ক্ষমতা মদমত্ত হয়ে নিজেদের মহাবীর ভাবা উচিত নয়। কারণ কখন, কোন দিক থেকে ঝড়ো হাওয়া এসে সব ওলটপালট করে দেবে, তা কেউ জানে না। দুই. জনগণের মনের ভাষা পড়তে জানতে হবে। তারা কী চায়, সেটা না বুঝতে পারলে তাদের রোষানলে পড়তেই হবে।
মহাভারতের পঞ্চ পান্ডবের দ্বিতীয় পান্ডব ছিলেন ভীম। সে একদিন গর্ব করে বলছিল, ‘এই জগতে আমার চেয়ে বলশালী আর কেউ নাই, কেউ আমাকে পরাজিত করতে পারবে না।’ তখন তার মা বলেছিলেন, ‘আছে।’ ভীম গর্জন করে বলল, ‘কোথায় সে? এক্ষুণি আমি তাকে কাঁধে তুলে এক আছাড়েই ভবলীলা সাঙ্গ করে দেব।’ ভীমের মা বললেন, ‘সে মাঘ মাসের শীতের রাতে নদীর পাড়ে আসে।’ ভীম মাঘ মাসের এক শীতের রাতে নদীর পাড়ে গিয়ে বসল; কিন্তু সেই বলশালী আর আসে না। এদিকে সে শীতে কাঁপছে ঠক ঠক করে। টিকতে না পেরে মাঝরাতে বাড়িতে এসে সে মাকে বলল, ‘কই মা, ওই বলশালী তো এলো না।’ মা বললেন, ‘আর একটু অপেক্ষা করতে, তাহলেই তার দেখা পেতে।’ ভীম বলল, ‘কী করে থাকব, শীতে যে মরে যাচ্ছিলাম!’ মা তখন বললেন, ‘ওই শীতই সেই বলশালী, যে তোমাকে পরাজিত করেছে।’
আসলে এ জগতে কেউ অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলশালী নয়। কোথাও না কোথাও লুকিয়ে থাকে তাকে পরাজিত করার কেউ না কেউ।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক