Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু : একটি অবহেলিত জাতীয় সংকট

Icon

ড. মো. ইদ্রিস আলম

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু : একটি অবহেলিত জাতীয় সংকট

প্রতীকী ছবি

শিশু ও কিশোরদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ পানিতে ডুবে মারা যাওয়া, যা বর্তমানে একটি অবহেলিত জাতীয় সংকট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার (WHO) ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বছরে ২,৩৬,০০০ জন পানিতে ডুবে মারা যায়; যার ৯০ শতাংশ ঘটে নিু ও মধ্যআয়ের দেশগুলোয়। বৈশ্বিক তথ্যানুযায়ী, পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি মারা যায় ১ থেকে ৪ বছর বয়সের শিশুরা এবং এক্ষেত্রে দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ বয়স হলো ৫ থেকে ৯ বছর। ছেলে শিশুরা মেয়ে শিশুদের তুলনায় দ্বিগুণ পানিতে ডুবে মারা যায়। এ ধরনের মৃত্যু এড়াতে প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অপেক্ষাকৃত কম। বাংলাদেশের প্রথম স্বাস্থ্য ও তথ্য জরিপ (২০১৩) অনুযায়ী, ১ থেকে ১৭ বছরের শিশুদের অপমৃত্যুর প্রধান কারণ পানিতে ডুবে যাওয়া, যা সম্মিলিতভাবে নিউমোনিয়া, অপুষ্টি ও কলেরার কারণে মৃত্যুর চেয়েও বেশি। বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাস্থ্য ও তথ্য জরিপ (২০১৬) অনুযায়ী, বছরে ১৪ হাজার ৪৩৮ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এ ধরনের শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ -১. বয়স্কদের তত্ত্বাবধানের অভাব, ২. গ্রামে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রের অভাব, ৩. অতি দারিদ্র্য, ৪. পুকুর-জলাধারে নিরাপত্তা বেষ্টনীর অভাব এবং ৫. সাঁতার না জানা।

একটি সুস্থ শিশুকে ৪-৫ বছর বয়স থেকেই সাঁতার শেখানো উচিত। পুকুর, ডোবা, খাল, বালতি ও বাকেট ইত্যাদি জায়গায় বিভিন্ন বয়সি শিশুরা মারা যায়। এক গবেষণায় (২০২২) দেখা গেছে, ৫ বছর বয়সিদের ৮০ শতাংশের পানিতে ডুবে মৃত্যু ঘটে বসতঘর থেকে ২০ মিটার দূরত্বের মধ্যে পুকুর-জলাশয়ে। দেশে একাধিক শিশু, বিশেষ করে দুটি শিশুকে একই স্থানে একইসঙ্গে পানিতে ডুবে মারা যেতে দেখা যায়। সাধারণত একটি শিশু অন্য শিশুকে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার সময় বাঁচাতে গিয়ে একসঙ্গে মারা যায়।

গ্রামাঞ্চলের অনেক লোকের বসতবাড়িতেও শিশুকে পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যেতে দেখা যায়। অনেক অভিভাবক ভাবেন, ‘আমার শিশু নিরাপদ, কারণ সে সাঁতার জানে।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো, শিশুরা পানিতে একা বিপদে পড়ে। সাঁতার শেখানোর সময় কোনো শিশু যেভাবে নির্দেশনা অনুযায়ী সাঁতার কাটে, একা পানিতে পড়ে সে সেই নির্দেশনা অনুসরণ করে না, বরং পানি খেতে খেতে ডুবে যায়। শিশুরা অত্যন্ত দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যায়। কাজেই এসব বিষয়ে অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণে ছয়টি প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে। ১. প্রাক স্কুল বয়সি শিশুদের পানি থেকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ, ২. পানির কাছে যাওয়ার পথে বেষ্টনী প্রদান, ৩. সাঁতার শেখানো এবং নিরাপত্তা কৌশলের প্রশিক্ষণ প্রদান, ৪. বন্যা ও অন্যান্য পানিসৃষ্ট দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা, ৫. পানি থেকে শিশুদের নিরাপদে উদ্ধার এবং সিপিআর প্রশিক্ষণ প্রদান, ৬. নৌকা, জাহাজ ও ফেরিতে নিরাপদে যাতায়াতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।

উল্লেখিত ছয়টি নিবারণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চারটি কৌশল প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। ১. বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকাণ্ডে সমন্বিতভাবে পানিতে ডুবে মৃত্যুর কথা বিবেচনা করা, ২. কৌশলগত যোগাযোগের মাধ্যমে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা, ৩. তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং গবেষণার মাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃত্যু নিবারণে সৃজনশীল কৌশল প্রণয়ন করা, ৪. জাতীয় নিরাপত্তা নীতি প্রণয়ন করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণসহ সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের কর্মীদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের কথা বলেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করছে। ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে মৃত্যুসংশ্লিষ্ট মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির দিক উল্লেখ করে নিবারণ কৌশল বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার আমন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী পানিতে ডুবে মৃত্যু বিষয়ে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনে সম্মত হয়েছে। একইসঙ্গে ২০২৩ সাল থেকে প্রতিবছর ২৫ জুলাই বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিহার দিবস পালনের ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জনস্বাস্থ্য কর্মসূচির আওতায় পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিহার বিষয়ে জনসচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।

২০২৩ সালের পানিতে ডুবে মৃত্যু নিবারণ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো-‘যে কেউই পানিতে ডুবে মারা যেতে পারে, কারও ডুবে যাওয়াই কাম্য নয়।’ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিসংশ্লিষ্ট মৃত্যু মোকাবিলায় দেশব্যাপী বিভিন্ন প্রস্তুতি ও নিবারণমূলক কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে থাকলেও পানিতে ডুবে মৃত্যু বিষয়ে কার্যক্রম অত্যন্ত অপ্রতুল। সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) ২০০৬ ও ২০১৩ সালে রায়গঞ্জ, শেরপুর ও মনোহরদী উপজেলায় পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কমিউনিটি ডে কেয়ার সেন্টার (আঁচল) এবং সাঁতার প্রশিক্ষণকে কম খরচে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণের কার্যকর কৌশল হিসাবে চিহ্নিত করেছে। উপর্যুক্ত দুটি নিবারণ কৌশলের সঙ্গে জনসচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হলে এক্ষেত্রে আরও বেশি সুফল পাওয়া সম্ভব। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যু নিবারণে বাস্তবায়িত আরও একটি প্রকল্পে কোনো এলাকায় একইসঙ্গে বেষ্টনীযুক্ত খেলাঘর এবং শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র বাস্তবায়ন করলে তা শিশুমৃত্যু নিবারণে ভূমিকা রাখে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালের স্বাস্থ্যনীতিতে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুকে একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে অন্তর্র্ভুক্ত করেছে। তবে শিশু নিরাপত্তায় পাইলট প্রকল্পে পানিতে ডুবে মৃত্যুর বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হলেও সরকার কর্তৃক বাস্তবায়িত প্রকল্প এখনো সীমিত।

ডিজাস্টার অ্যাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, জনসচেতনতা এবং মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সাঁতার প্রশিক্ষণ এবং জলাধার থেকে সুরক্ষা কৌশল শেখানো, অনিরাপদ জলাধারে বেষ্টনী প্রদান এবং কমিউনিটি ডে কেয়ার স্থাপনে কাজ করছে। অর্থ সংকট, বাস্তবায়নের সক্ষমতার অভাব এবং অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রদানকৃত নিবারণ কৌশল দেশব্যাপী বাস্তবায়নে সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। এ অবস্থায় ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের মাধ্যমে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণের চেষ্টা করা যেতে পারে।

বস্তুত সমাজের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসাবে আমরা সবাই শিশুমৃত্যু নিবারণে ভূমিকা রাখতে পারি। যেমন-১. শিক্ষা ঘর থেকে শুরু হয়; কাজেই পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর বিষয়টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেয়ার করা, ২. বাড়িতে শিশু পানি থেকে নিরাপদ কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা, ৩. এ বিষয়ে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর সঙ্গে আলোচনা করা, ৪. বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করা ৫. প্রতিবেশীদের বাচ্চারা নিরাপদ কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা, ৬. উঠান বৈঠকের ব্যবস্থা করা, ৭. জলাধারের পাশে বেষ্টনী প্রদানের ব্যবস্থা করা, ৮. নিজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা এবং অন্যকেও উৎসাহিত করা, ৯. আর্থিক সক্ষমতা থাকলে দরিদ্র পরিবারকে বেষ্টনীযুক্ত খেলাঘর প্রদান, ১০. শিশুদের সাঁতার শেখানোর ব্যবস্থা করা ১১. ইউটিউব এবং স্বীকৃত প্রশিক্ষণকারীর কাছ থেকে সিপিআর প্রশিক্ষণ গ্রহণ, ১২. এলাকায় যুবকদের সমন্বয়ে ক্যাম্পেইন দল গঠন, ১৩. জাতীয় জনসচেতনতা ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ, ১৪. এলাকায় কমিউনিটি ডে কেয়ারের সম্ভাব্যতা যাচাই করা এবং সম্ভব হলে তা বাস্তবায়ন করা।

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণে সরকারি ছাড়াও এনজিও, কমিউনিটি অরগানাইজেশন এবং বেসরকারি খাতের কার্যক্রম এখনো সীমিত। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণ কৌশল বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার পাশাপাশি সমাজের সব স্তরের জনগণের অংশগ্রহণ ও অবদান রাখা জরুরি।

ড. মো. ইদ্রিস আলম : প্রফেসর, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; প্রধান নির্বাহী, ডিজাস্টার এন্ড ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন (দাদু), বাংলাদেশ

edrisalam@yahoo.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম