সরকারের এখতিয়ারের মধ্যেই ছিল কোটা সংস্কার
এম এ আজিজ
প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
২০১৮ সালে বাতিল করা সরকারি চাকরির কোটা বহাল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় আপিল বিভাগ বাতিল করেছেন। সর্বোচ্চ আদালত মেধায় ৯৩ শতাংশ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ কোটা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। সরকার প্রয়োজনে ও সার্বিক বিবেচনায় নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে। কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্যপদ মেধা তালিকা থেকে পূরণ করতে হবে।
আপিল বিভাগ নির্বাহী বিভাগকে অবিলম্বে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কোটা সংক্রান্ত বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আপিল বিভাগের নির্দেশনা অপরিবর্তিত রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এ প্রজ্ঞাপন কার্যকর হয়েছে। ৯ম থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ কোটা প্রযোজ্য হবে।
আপিল বিভাগ রায়ের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘কোটা নির্ধারণ রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী বিষয়।’ তবুও সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৪-এর বিধানমতে এবং সার্বিক ও যৌক্তিক বিবেচনায় সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের স্বার্থে সংবিধানের ১৯, ২৭, ২৮(৪), ২৯(১) ও ২৯(৩) অনুচ্ছেদে থাকা সমতার নীতি ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রের কর্মে প্রতিনিধিত্ব লাভের জন্য কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে।’
সংবিধানের ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারই দেশের অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান বা কোটা সংরক্ষণ করার অধিকারী। তাই সরকার তার সাংবিধানিক ক্ষমতা বলেই বিশেষ বিধান তৈরি করে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাছে গ্রহণযোগ্য কোটা সংস্কার করলে এত রক্তপাত ও ধ্বংসযজ্ঞ এড়ানো যেত। কারণ, এ দুই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে কোটা নির্ধারণের বিষয়ে নিবৃত্ত করতে পারবে না।
১ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত কোটা আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু কী কারণে আন্দোলনটি সহিংস হয়ে উঠল, তা খতিয়ে দেখা দরকার। সরকারের পক্ষ থেকে রায়ের আগেই বলা হয়েছিল, আপিল বিভাগের রায়ে শিক্ষার্থীদের হতাশ হতে হবে না, আপিল বিভাগে হাইকোর্টের রায় বাতিল চাওয়া হবে এবং আপিল বিভাগের শুনানির তারিখ এগিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হবে। সংবিধানমতে সরকার কোটা বাতিল করতে বা পুনর্বহাল করতে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। তবে সরকারের কোটা নির্ধারণ সংবিধানমতে না হলে, তাতে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তিনি উচ্চ আদালতে যেতে পারেন। কারণ, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭.২ অনুযায়ী দেশের সংবিধানের রক্ষক হিসাবে উচ্চ আদালত যে কোনো আইন বা বিধানের পুরোটা কিংবা অংশবিশেষ বাতিল করতে পারেন।
আবার সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ, বিধান বা বিষয়ের ভাবার্থ বা মর্মার্থ বোধগম্য না হলে, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা, মতামত বা সিদ্ধান্ত চাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কোটা সংস্কারের বিষয়টি সংবিধানে স্পষ্ট থাকায় এ বিষয়ে সরকারই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারত। তারপরও সরকার কেন সাংবিধানিক দায়িত্ব এড়িয়ে গেল?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘সর্বাত্মক অবরোধ’ ঘিরে দেশব্যাপী বিক্ষোভ-আগুন-গুলি-সংঘর্ষ-সহিংসতায় ১৭-২৩ জুলাই সারা দেশে কমপক্ষে গ্রেফতার হয়েছে তিন হাজার। এর মধ্যে ঢাকায় ১১৯ মামলায় এক হাজার ২০০ গ্রেফতার। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) পর্যন্ত ১৯৭ জন নিহত ও আহত হয়েছেন শত শত। ধ্বংস হয়েছে প্রচুর রাষ্ট্রীয় সম্পদ। বিপর্যয়ে জীবন ও জীবিকা। অচল রেল-সড়কপথ। বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলগুলো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চিরুনি অভিযানে সারা দেশে গ্রেফতার অভিযান চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়া ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু হয়েছে। বিরতি দিয়ে দিয়ে কারফিউ বলবৎ আছে। সরকার বলছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিনজন সমন্বয়কারী আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও তথ্য প্রতিমন্ত্রীর কাছে তাদের আট দফা দাবি উপস্থাপন করেছিলেন। যেমন-নিহতদের ঘটনা তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে গ্রেফতার ও বিচার এবং শহিদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা, মাসিক ভাতা ও তাদের পিতা-মাতার মতামতের ভিত্তিতে একজন সদস্যকে চাকরির নিশ্চয়তা দিতে হবে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয় প্রশাসনিকভাবে সিট বরাদ্দ, সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ এবং ছাত্র সংসদ চালু করতে হবে।
এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সব শিক্ষার্থীকে সব ধরনের রাজনৈতিক, আইনি বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক একাডেমিক হয়রানি না করার নিশ্চয়তা দিতে হবে। সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লেখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য পাঁচ শতাংশ রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাশ করতে হবে। আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, আমরা শুনেছি। যৌক্তিক দাবিগুলো মানা সম্ভব।
৪ জুলাই হাইকোর্ট পূর্ণাঙ্গ রায়ের মূল অংশে বলেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ সব কোটা বজায় রাখতে হবে। তবে সরকার প্রয়োজন মনে করলে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারবে। আর কোটা পূরণ না হলে, মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে পারবে।’ তারপরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের বিষয়ে আদালত নয়, নির্বাহী বিভাগের কাছে সিদ্ধান্ত চান। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের দাবি না মেনে সরকার নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা সব গ্রেডে সংবিধানমতে শুধু অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ কোটা রেখে, সংসদে আইন পাশের দাবি করেছিলেন। যেহেতু তারা সংবিধান মতে কোটা সংস্কার চেয়েছিলেন, তাই ২০১৮ সালে সরকার যে সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে কোটাব্যবস্থা বাতিল করেছিল, সেই ক্ষমতাবলেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে কোটা সংস্কারের রূপরেখা ঘোষণা করলেই সমাধান হতে পারত। কিন্তু সরকার এ সুযোগটি গ্রহণ করেনি।
১৬ জুলাই জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী কোটা আন্দোলনকারীদের আপিল বিভাগের রায় পর্যন্ত ধৈর্য ধরার জন্য আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার বিশ্বাস, আমাদের ছাত্রসমাজ উচ্চ আদালত থেকে ন্যায়বিচারই পাবে, তাদের হতাশ হতে হবে না।’ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে আইনমন্ত্রী ১৮ জুলাই যা বলেছিলেন, সে কথাগুলো তিনি তার ভাষণে বললেই সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যেত। দেশের পরিস্থিতি এত অশান্ত হতো না, এড়ানো যেত এত ধ্বংসযজ্ঞ, এত প্রাণহানি।
৫৩ বছর দেশ স্বাধীন হয়েছে। ১৯৭১ সালে কমপক্ষে ১২ বছর বয়সের কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে থাকলে তিনি নিবন্ধন পেয়েছেন। তাহলে স্বাধীনতার সময়কাল ৫৩ বছরের সঙ্গে ১২ বছর যোগ করলে একজন মুক্তিযোদ্ধার বয়স হয় সর্বনিু ৬৫ বছর। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানেরা বিসিএসসহ যে কোনো সরকারি চাকরির পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত বয়সসীমা অতিক্রম করেছেন। তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের কোটা পূরণ হবে কী করে? এ ছাড়া দেশে প্রায় ৫১ শতাংশের ওপরে নারী এবং প্রত্যেক জেলায়ই অনগ্রসর জাতি-গোষ্ঠী থাকলেও তাদের কোটায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
অনেকের অভিমত, কোটা সংস্কারের বিষয়টি যেহেতু উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল, তাই শিক্ষার্থীরা আদালতের মাধ্যমেই বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে পারত। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সামনে কয়েকটি উদাহরণ আছে, যা তাদের আন্দোলনের জন্য উৎসাহী করেছে। যেমন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই আন্দোলনের মাধ্যমে কয়েকটি আইন ও সিদ্ধান্ত বাতিল বা সংশোধন হয়েছে। যেমন-
২০১৮ সালের ছাত্র-তরুণদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের মুখে সরকার সড়ক আইন করে। আবার পরিবহণ সেক্টরের নেতাদের চাপে সড়ক আইনের অনেক ধারার সংশোধন করে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চাপে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভ্যাট’ প্রত্যাহার করে এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনে ‘সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা’ বাতিল করতে সরকার বাধ্য হয়।
এছাড়া, ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। সে রায়ের বিরুদ্ধে শাহবাগে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মুখে সরকার নতুন আইন করে। নতুন আইনে কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়।
এম এ আজিজ : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক