সুপেয় পানির নিশ্চয়তা কোথায়?
ড. মো. রফিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নিরাপদ পানির অপর নাম নিরাপদ জীবন। কিন্তু জনগণকে নিরাপদ বা সুপেয় পানি সরবরাহ না করে দাম বাড়িয়ে তাদের দ্বিগুণ শাস্তি দেওয়ার অধিকার সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের নেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মূল্যস্ফীতির চাপে এমনিতে মানুষ দিশেহারা। এরই মধ্যে জনগণের ব্যয়ের বোঝা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ তার সরবরাহকৃত পানির মান নিয়ে সাফাই গাইলেও নগরবাসী তা সমর্থন করছে না। এর কারণ, ওয়াসার ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি পান করে প্রায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এমনকি পানিবাহিত রোগের কারণে মৃত্যুর ঝুঁকিও অনেক বেশি। এ কারণে ওয়াসার ময়লা পানি নিয়ে নগরীর বিভিন্ন স্থানে ভুক্তভোগীরা আন্দোলন করছে। তবুও ওয়াসা কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না। নগরবাসীকে পর্যাপ্ত ও মানসম্মত পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে না।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে জনগণের যাপিত জীবনে তেমন আশার আলো নেই বললেই চলে। দেশে বিদ্যমান ডলার সংকটের অব্যাহত মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান যখন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে, তখন সিস্টেম লসের নামে অপচয়-দুর্নীতি ও লুটপাট অব্যাহত রাখতে গ্যাস ও বিদ্যুতের পাশাপাশি পানির দামও বাড়ানো হয়েছে। পানির দাম বাড়ানোর কারণ হিসাবে বিদেশি ঋণ ও লোকসানের দোহাই দেওয়া হচ্ছে। পানির দাম বাড়িয়ে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ নিজেদের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের দায় জনগণের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে নগরবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্সের সভাপতি বলেছেন, বিদেশি ঋণের টাকায় নেওয়া এসব প্রকল্পের সুফল জনগণ কতটা পাচ্ছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিস্তর। এ ছাড়া ওয়াসার অদক্ষতার দায় জনগণকে কেন টানতে হবে? জবাবদিহি না থাকায় ওয়াসা কর্তৃপক্ষ অন্যায়ভাবে পানির দাম বাড়াচ্ছে। আর পানির দাম বাড়াতে গিয়ে ঢাকা ওয়াসা যেভাবে আয় ও ব্যয়ের হিসাব দিচ্ছে, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে আবার পানির মতো জরুরি পণ্যের দাম বাড়ানো কেন? এর জবাবে বলা হচ্ছে, বিদেশি ঋণে বিভিন্ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলাকালে সেটা পরিশোধের সময় এসে যাচ্ছে; তাই পানির দাম বাড়ানো ছাড়া বিকল্প কিছুই নেই। এ অবস্থায় যেসব উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হচ্ছে, তাতে বিপুল ব্যয় হলেও প্রত্যাশিত সুফল মিলছে না। এর মাশুল আবার গুনতে হচ্ছে সেবাগ্রহীতাদের। এ কারণেই প্রায় প্রতিবছর পানির দাম বাড়িয়ে, এমনকি প্রকল্প ব্যয় নির্বাহের একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
এদিকে সরকার নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এ নিয়ে জনঅসন্তোষ বিরাজ করলেও প্রতিবছরের মতো গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়িয়ে সে অসন্তোষ ও মূল্যস্ফীতির বোঝার ওপর শাকের আঁটি চাপিয়ে দিচ্ছে সরকার। আরও দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা প্রমাণ করে পানি সরবরাহ লাইনের উন্নয়ন এবং পানির মানোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে শুধু পানির দাম বাড়িয়ে সংকট এড়ানোর সহজ পথ অনুসরণ করছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। বলা বাহুল্য, ওয়াসার সরবরাহ লাইনের ময়লাযুক্ত, দূষিত ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি সরাসরি পানযোগ্য না হওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ছে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ। আবার সমাজের একশ্রেণি অসাধু ব্যবসায়ীরা ওয়াসার দূষিত পানি বোতলজাত করে জনগণের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এর সঙ্গে ওয়াসার কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ ১ জুলাই থেকে পানির দাম ১০ শতাংশ বাড়িয়েছে, যার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম ১৬ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করেছে, যা বর্তমানে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। অন্যদিকে, বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য একই পরিমাণ পানির দাম ৪৬ টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা বর্তমানে ৪২ টাকা। ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে ওয়াসার আইন ১৯৯৬-এর ২২ ধারার দোহাই দিয়েছে। তবে আইন অনুযায়ী, ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বছরেও ৫ শতাংশ পানির দাম বাড়াতে পারবে। এ ৫ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি করতে হলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। জানা গেছে, পানির দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে পরিচালনা বোর্ড থেকেও কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
উল্লেখ্য, মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রায় শতভাগ মানুষ ওয়াসার পানি ফুটিয়ে কিংবা ফিল্টারিং করে পান করতে সক্ষম হলেও দরিদ্র মানুষ দূষিত পানি পান করে বেশি অসুস্থ হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত কয়েক বছর আগে নগরবাসীর আন্দোলনের পটভূমিতে আদালত ওয়াসার পানির মান পরীক্ষার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। সে কমিটির তদন্তে ওয়াসার পানিতে ই-কোলাই, ব্যাকটেরিয়া ও ভারি ধাতুর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে পরিবেশ ও পানি দূষণের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও বিভাগগুলোর ব্যর্থতার কারণে পরিবেশগত বিপর্যয় ক্রমেই ঘনীভূত হতে চলছে। আর ঢাকার চারপাশের নদ-নদীর পানি দূষণের পেছনে শিল্পবর্জ্যের কেমিক্যালের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের এক ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে এসেছে। বিশেষত চামড়া, গার্মেন্ট ও টেক্সটাইল শিল্পের ব্যবহৃত রাসায়নিক যথেচ্ছভাবে নদীতে ফেলে নদীর পানিকে ব্যবহারের অযোগ্য করে তোলা হয়েছে। এর ফলে জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ছে। তাই ওয়াসার পানিকে নিরাপদ ও সবার জন্য পানযোগ্য করার কোনো বিকল্প নেই।
এ প্রসঙ্গে টিআইবির ‘ঢাকা ওয়াসা: সুশাসনের ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে ওয়াসার অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ঢাকা ওয়াসার পানির নিম্নমানের কারণে ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে পান করেন। এ বিষয়ে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ চ্যালেঞ্জ করে ২০১৯ সালে ঢাকার ১০টি জোনের ২৪৩টি এলাকা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পানি পরীক্ষা করে। এ পরীক্ষায় কোনো ধরনের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। টিআইবি বলছে, ওয়াসা থেকে পরীক্ষার তথ্য সস্পূর্ণ ভিত্তিহীন ছিল। এ বিষয়ে টিআইবি আরও বলেছে, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মান নিয়ে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ সেসব তথ্য দিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে এটি কোনো গবেষণা নয় বরং অনুমাননির্ভর তথ্য; যার কোনো ভিত্তি নেই। ওয়াসার সক্ষমতা নিয়ে টিআইবি প্রশ্ন করছে। অথচ ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের অনুকরণীয়। এ প্রসঙ্গে টিআইবির ‘ঢাকা ওয়াসা : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা ওয়াসার নিম্নমানের পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সেবায় রাজধানীর এক তৃতীয়াংশের বেশি সেবাগ্রহীতা অসন্তুষ্ট। একইসঙ্গে ওয়াসার অপরিষ্কার ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি সেবন করে পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে নগরবাসী। এছাড়া সেবাগ্রহীতার ৫১.৫ শতাংশ সরবরাহকৃত পানি অপরিষ্কার ও ৪১.৪ শতাংশ সরবরাহকৃত পানি দুর্গন্ধযুক্ত বলে অভিযোগ করেছে। সেবাগ্রহীতার মতে, পরিবারের ২৪.৬ শতাংশ সদস্য পানিবাহিত কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে এ বিষয়ে একটি রিটও হয়েছিল। ফলে ওয়াসার পানি যে বিশুদ্ধ নয়, তা নগরবাসীর কাছে স্পষ্ট। তাই রাজধানীর সব এলাকায় পাইপলাইনে বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করতে হলে সরবরাহকৃত লাইনগুলো নতুনভাবে স্থাপন করতে হবে। এ কাজটি ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হলেও সম্পন্ন করা গেলে সুপেয় পানি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মানসম্মত নিরাপদ পানির জোগানের ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয় বা ভর্তুকি ব্যয় কমিয়ে আনা। সেক্ষেত্রে সুপেয় পানি কম দামে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। বিশেষত ২০০৯ সালে ওয়াসার রাজস্ব আয় ছিল ৬৪ শতাংশ। পরবর্তীকালে ওয়াসার রাজস্ব আয় ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে সিস্টেম লস ৪০ থেকে ২০ শতাংশ কমিয়ে আনার কারণে ওয়াসার রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে মিটারবিহীন হোল্ডিং, গভীর নলকূপ, নির্মাণাধীন ভবন ও ন্যূনতম বিলসহ সর্বপ্রকার (পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন) অভিকরের ক্ষেত্রেও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। এছাড়াও সুপেয় পানির মতো অপরিহার্য মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক মুনাফাবাজির অপচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। অপচয়সহ সব অনিয়ম বন্ধ করা জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন হলে নতুন একটি কমিশন গঠন করা যেতে পারে। যদি ঢাকার ওয়াসার অবচয়-দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হয়, তাহলে পানির দাম এমনিতে কমে আসবে। সর্বশেষ নদীদূষণ, পানিদূষণ রোধ ও সরবরাহ লাইনে ওয়াসার নিরাপদ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও হস্তক্ষেপ কামনা করছে নগরবাসী।
ড. মো. রফিকুল ইসলাম : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম