স্মরণ
হুমায়ূন কবীর বালুকে নিয়ে একটি দুর্লভ পুলিশ প্রতিবেদন
আসিফ কবীর
প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
২০০৪ সালের ২৭ জুন সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হুমায়ূন কবীর বালু বোমা হামলায় খুলনায় নিজ পত্রিকা অফিসের সামনে নিহত হন। সে সময় তিনি খুলনা প্রেস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। এর আগেও ১৯৮৪ ও ১৯৯৮ সালে তিনি এ বিভাগীয় বৃহত্তম সাংবাদিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের খুলনা জেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক হিসাবে খুলনায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলকদের অন্যতম ছিলেন। ২০০৯ সালে তাকে সরকার একুশে পদকে ভূষিত করে।
২০০৮ সালে বালু হত্যা মামলার সব আসামিকে আদালতের রায়ে খালাস দেওয়া হয়। আদালত একই রায়ে তদন্তের দুর্বলতা, তথ্য-প্রমাণের ঘাটতি, সাক্ষ্য প্রদানের অপ্রতুলতা ইত্যাদির উল্লেখ করে রায়ের পরিপ্রেক্ষিত ব্যাখ্যা করেন। ২০০৯ সালে একই ঘটনার বিস্ফোরক মামলাটি রায় ঘোষণার পূর্ব মুহূর্তে পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করে অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিতে ন্যস্ত করার আদেশ লাভ হয়। দীর্ঘ পূর্ণ তদন্ত শেষে চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হয়, আবার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ১৮ জানুয়ারি ২০২১ বিস্ফোরক আইনে কৃত মামলায় সব আসামিকে যাবজ্জীবন প্রদানের রায় দেওয়া হয়।
হত্যা মামলায় সব আসামির খালাস লাভ অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক ছিল। মোটা দাগে এর প্রতিক্রিয়ায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিকেই এক রকম অস্বীকার করার নামান্তর বলে আপাতদৃষ্টিতে আমাদের অনুভূত হয়। যদিও আদালত রায়ে তথ্য-প্রমাণের ঘাটতি, সাক্ষ্য প্রদানের অপ্রতুলতা ইত্যাদির উল্লেখ করে। দ্বিতীয়বারের রায়ে কিছুটা স্বস্তির জায়গা তৈরি হয়েছে। সাংবাদিকদের বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যারা এ পেশায় যুক্ত, তাদের মধ্যেও সামাজিক নিরাপত্তার অদৃশ্য প্ররক্ষা বৃদ্ধির বোধ তৈরি হয়েছে। মামলা নিয়ে এতটুকু পর্যন্ত অর্জনও সহজ ছিল না। এ পথপরিক্রমায় পাশে থাকা সাংবাদিক সমাজ, আইনজ্ঞ, অধিকার কর্মী ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
১৯৭২ সালেও একবার তার জীবন বিপন্ন হতে বসেছিল। এ বিষয়ে স্বাধীনতা পদক ও পদ্মশ্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, বীর প্রতীকের মাধ্যমে একটি গোয়েন্দা নথি হুমায়ূন কবীর বালুর পরিবারের হাতে আসে। ইনডেক্স টু দ্য বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাবসট্রাক্ট সাপলিমেন্ট অব ইন্টেলিজেন্স শিরোনামে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭২-এর ভলিউম ১ ভুক্ত ৪২ পাতার ৩২২ নম্বরে খুলনা উপশিরোনামে প্রতিবেদনটি বিবৃত হয়েছে। খুলনা পুলিশ স্টেশন কেস ১২নং ৫ মার্চ ১৯৭২-এ রেকর্ডকৃত। ৪৫৭/৩৭৬ একটি বাংলাদেশ পুলিশ কেস চালু হয়। রিপোর্টে দেখা যায় খুলনার ইকবাল নগর এলাকার [কাজী] শওকত আলী মামলাটির বাদী। হুমায়ূন কবীর বালু তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা। বিবাদীকে (একজন ইউনিফর্ম অফিসার) ধর্ষণ চেষ্টাকালে স্থানীয় আরও কয়েকজনের সহায়তায় হুমায়ূন কবীর বালু হাতেনাতে ইকবাল নগর এলাকায় ধরেন ও পুলিশে সোপর্দ করেন। পরে বিবাদী জামিন লাভ করেন।
জামিনে মুক্তি পেয়ে বিবাদী কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে ৯ মার্চ ১৯৭২ রাত আনুমানিক ১২:৪৫-এর (আগে-পরে) হুমায়ূন কবীর বালুকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় ১৫ ইকবাল নগরস্থ তার পৈতৃক বাড়ি ভাঙচুর করে বিবাদী ও তার সঙ্গীরা। পরিবারের অভিযোগ পেয়ে পুলিশ তার খোঁজ শুরু করে। পরদিন সকালে শহরের জোড়া গেট এলাকায় তাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ছাত্র সমাজ ক্ষিপ্ত ও প্রতিবাদী হয়। তারা দোষীদের সবাইকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি করে। একই সঙ্গে ‘বাংলাদেশ ফোর্সে’র শহরে অনুপ্রবেশ বন্ধের দাবি জানায়। [প্রাসঙ্গিক প্রতিবেদনটির ইংরেজি থেকে অনুবাদ]
জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘটনার পরপরই অবগত করেন খুলনায় বসবাসকারী তার ভাই শেখ আবু নাসের (সূত্র : সেখ সালাউদ্দীন জুয়েল, সংসদ-সদস্য, খুলনা-২-এর ১৩ জানুয়ারি ২০২১ খুলনা প্রেস ক্লাবের নির্বাহী সদস্যদে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে অনানুষ্ঠানিক বক্তব্য)। জেনারেল এম এ জি ওসমানী ওয়্যারলেস মেসেজে হুমায়ূন কবীর বালুর সন্ধান পেতে বার্তা দেন। এ ঘটনার পর দীর্ঘদিন খুলনা সদর হাসপাতালে ভর্তি থেকে তাকে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। তদানীন্তন কর্নেল আবুল মঞ্জুর ও মেজর সুবিদ আলী ভূইয়া খুলনা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাকে দেখতে আসেন।
১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পরিবর্তিত বাস্তবতায় এ ঘটনাটির রাজনীতিকীকরণের চেষ্টা হয়েছে। যথারীতি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা ও বর্ণনা করা হয়েছে। এ দুর্লভ্য পুলিশি নথিটি তৃতীয় নয়নে বিষয়টিকে দেখার সুযোগ উন্মুক্ত করেছে।
২০০৫ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সার্ক সম্মেলনের সময় সাফমা’র (সাংবাদিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার) সদস্য অনেক বিদেশি (দক্ষিণ এশীয়) সাংবাদিক বাংলাদেশে আসেন। তাদের একটি দল খুলনায় আসেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খুব কাছাকাছি সংঘটিত সাংবাদিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান করতে। তাদের প্রশ্ন থেকে জানতে পারি তদানীন্তন জোট সরকারের পক্ষ থেকে (তাদের) বলা হয়েছে, ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন এ অঞ্চলে সাংবাদিকরা চোরাচালানে জড়িত ও তারই অন্তর্দ্বন্দ্বে খুন হচ্ছেন। এ কথা ছিল সর্বৈব অসত্য ও যারপরনাই মর্মাহত হওয়ার মতো। এর অল্প দিন পর একই বছর ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন আয়োজিত সন্ত্রাসবিরোধী জাতীয় কনভেনশনে এর প্রতিবাদ জানানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৪ সালের ২৮ জুন হুমায়ূন কবীর বালু হত্যাকাণ্ডের পরদিনই বিশেষ প্রোগ্রামে খুলনায় আসেন। তখন তিনি বিরোধীদলীয় নেতা। তিনি তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, প্রায় ছয় মাস আগে যখন তিনি সাংবাদিক মানিক সাহা নিহত হলে একইভাবে এসেছিলেন ও খুলনা প্রেস ক্লাবে প্রতিবাদ সভায় যোগ দিয়েছিলেন, তখন (সভার সভাপতি) হুমায়ূন কবীর বালু তার নিজের জীবননাশের আশঙ্কা প্রকাশ করে শেষবার দেখতে আসার অনুরোধ করেছিলেন। হায়! দেখা যায়, ভবিষ্যৎদ্রষ্টার কথার মতো তা ফলে গেল। সেই অনুরোধ রক্ষার জন্যই তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীর পক্ষ থেকে বার্তা পাঠিয়ে রাখা হয়, তার খুলনায় উপস্থিতির পরই যেন দাফন কার্যক্রম করা হয়। তিনি তখন এ হত্যাকাণ্ডকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন। রাজনৈতিক কারণে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েই তালিকা করে বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী, সমর্থক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুবর্তী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হচ্ছে, আরও হবে, তিনি বলেন। পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ তেমনই ঘটেছিল। বালু হত্যাকাণ্ডটি যে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, তারও প্রমাণ স্পষ্ট হতে থাকে। এ আকস্মিক হত্যাকাণ্ডে তার পরিবারকে অসীম মানবিক সংকটে নিমজ্জিত হতে হয়। জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসাবে কঠিন বাস্তবতা মোকাবিলা করতে হয় আমাকে।
আসিফ কবীর : হুমায়ূন কবীর বালুর জ্যেষ্ঠ সন্তান