Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

কালোটাকার কবল থেকে মুক্তি নেই?

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কালোটাকার কবল থেকে মুক্তি নেই?

‘হারিয়ে ধন বাপে-পুতে কীর্তন’ বলে একটা কথা বৃহত্তর ময়মনসিংহে চালু আছে। ‘কালোটাকার’ ওপর আলোচনা দেখে-শুনে এবং পড়ে এ কথাটা মনে পড়ছে। কালোটাকা প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে, তা পাচার হচ্ছে এবং হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে আমাদের। রাষ্ট্রের হিসাবে তা নেই। হারিয়ে যাচ্ছে খাতা থেকে। এসব দেখে-শুনে আমরা সবাই এখন বিলাপ করছি। বলছি, কালোটাকা ধরতে হবে, কালোটাকার মালিকদের বিচার করতে হবে। ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার করতে হবে। বিদেশে যারা টাকা পাচার করেছে, তাদের তালিকা করতে হবে। ওইসব টাকা দেশে ফেরত আনতে হবে। এসব দাবির প্রেক্ষাপট কী? প্রেক্ষাপট কালোটাকার বাড়বাড়ন্ত। দিন দিন তা স্ফীত হচ্ছে। একজন সরকারি কর্মকর্তাও হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক! সরকার এবার তাই কালোটাকা ধরার জন্য ‘আধার’ দিয়েছে, যেমন-মানুষ মাছ ধরতে ‘আধার’ দেয়। ২০২৪-২৫-এর বাজেটে কালোটাকা ‘সাদা’ করার ব্যবস্থা আছে। ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করা যাবে। এতে কেউ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না। এতেই হয়েছে বিপত্তি, সবাই বলছে এটা অবিচার। সাধারণ একজন করদাতা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর দেয় সরকারকে। সেখানে মাত্র ১৫ শতাংশ দিয়ে কালোটাকা সাদা করা হবে-এটা অন্যায়/অবিচার। এতে ভালো করদাতারা কর দিতে নিরুৎসাহিত হবে। এ যুক্তির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা কঠিন। সত্যিই তো, এটা কী করে হয়? শুধু তাই নয়, জনমত আরও কঠিন। কালোটাকার মালিকদের বিচার করতে হবে। এদের মধ্যে যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছে, তাদের শাস্তি দিতে হবে। বলা বাহুল্য, এসব দাবি সবসময়ই করা হয়েছে/হচ্ছে। এ পর্যন্ত বহুবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবারই এসব দাবি করা হয়েছে। মনে রাখা দরকার, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ স্বাধীনতা-উত্তরকালে সব সরকারই দিয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু ফলাফল আশাপ্রদ নয়।

একটি প্রতিবেদনে দেখলাম, এ পর্যন্ত সব মিলে নাকি মাত্র ৪৭ হাজার কোটি টাকা সাদা করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর দেশে কোনো পুঁজি ছিল না, পুঁজিপতি ছিল না। ১০-১৫ কোটি টাকা দিয়ে একটা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার মতো বঙ্গসন্তান ছিল না। তখন ব্যাংক হয়েছে ব্যাংকঋণের টাকায়। সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে, সে ঋণের টাকা দিয়ে ব্যাংকের মালিক হয়েছে সবাই। এসব জানা কথা। আমি ১৯৭২-৭৩ সাল থেকে অর্থনীতির ওপর কলাম লিখছি নিরবচ্ছিন্নভাবে। কালোটাকার ওপর তখনো লিখেছি, এখনো লিখছি। চোরাচালান, হুন্ডি, ঘুস-দুর্নীতির ওপর তখনো লিখেছি, এখনো লিখছি। একটা তফাত আছে। তখন টাকার অঙ্কে কালোটাকার পরিমাণ ছিল হয়তো শতকোটি। আর এখন তা বিলিয়ন (শতকোটি) বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন টাকা। এই যে অবস্থা, এটা কি একদিনে হয়েছে? খেলাপি ঋণের বোঝা যেমন ৫০-৫২ বছরে আজকের অবস্থায় এসেছে এবং এখন তা আমাদের ধ্বংস করতে প্রস্তুত, তেমনি কালোটাকার অবস্থাও তা-ই। একশ্রেণির লোক স্বাধীনতার পর থেকেই এ ‘অসৎ বৃত্তি’ গ্রহণ করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হচ্ছে/হয়েছে আর আমরা প্রতিবাদ করে যাচ্ছি।

ধরা যাক স্বাধীনতা-উত্তরকালের অবস্থা। তখন অনেকের হাতে হাতে অস্ত্র। সদ্য স্বাধীন দেশ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ততো উন্নতি হয়নি। একশ্রেণির লোকের আবির্ভাব হলো, যাদের নাম ছিল ‘ষোড়শ বাহিনী’। এরা মুক্তিযোদ্ধা নয়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ পরিপূর্ণ শত্রুমুক্ত হলে এরা নিজেদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ দাবি করে চারদিকে লুটপাট চালায়। কালোটাকার মালিক হতে থাকে। অবাঙালিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল; ইসলামপুর, নবাবপুর, নিউমার্কেটের দোকান দখল, দোকানের পণ্য বিক্রি, গুদামে রক্ষিত তাদের মালামাল লুট, ব্যাংকে রক্ষিত টাকা মেরে দেওয়া ইত্যাদি ‘কাজ’ করে বহু দুষ্ট লোক টাকার মালিক হয়। তারপর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বাণিজ্য, মানে চোরাচালান বাণিজ্য। দেশে তখন পণ্যের অভাব। নয় মাস কোনো কাজ হয়নি কোথাও। নিত্যপণ্যের অভাব। বর্ডার দিয়ে পণ্য আনত চোরাচালানিরা। রমরমা বাণিজ্য। প্রচুর টাকা। কালোটাকা। এলো ‘জনশক্তি রপ্তানির’ কাজ। যেখানে শ্রমিক পাঠাতে এক টাকা লাগে, সেখানে নেওয়া হতো দুই টাকা-ঠিক আজকের মতো। এরও নাম কালোটাকা। শুরু হলো রপ্তানি বাণিজ্য। এক টাকার পণ্য ৫০ পয়সায় বিক্রি করে তৈরি করা হলো কালোটাকা। আমদানিতে ১০ টাকার পণ্য ২০ টাকায় দেখিয়ে টাকা হলো পাচার। যোগ হলো ব্যাংকের টাকা মারা। কৃষিঋণ আদায় হয় না। পাটঋণ, চামড়াঋণের টাকা আদায় হয় না। ‘বিকল্পে’ (বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসংস্থান প্রকল্প, ছাত্রদের জন্য) দেওয়া টাকা আদায় হয় না। ঋণ মওকুফ, সুদ মওকুফ হচ্ছে সমানে। ব্যাংকের মালিকরা টাকা মেরে দিচ্ছে (১৯৯০-৯৫)। বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে। এক টাকার কাজ দুই-তিন টাকায় হচ্ছে। চোখের সামনে কালোটাকা তৈরি হচ্ছে। প্রতিদিন চোখের সামনে অফিসে অফিসে ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে কালোটাকার জন্ম হচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও তা-ই। যেখানেই কেনা-বেচা, সেখানেই দুর্নীতি, কালোটাকা। জেলখানার কয়েদিদের খাবার, হাসপাতালের রোগীদের খাবার/ওষুধ খোলাবাজারে বিক্রি করে তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন কালোটাকা। ১০ টাকার জমি ক্রয়ে ২ টাকার দলিল করে বাকি ৮ টাকা হচ্ছে কালোটাকা। ফ্ল্যাট ক্রয়েও তা-ই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ১০ টাকা বেতন ব্যাংকে, ১০ টাকা বেতন ‘ক্যাশে’-তৈরি হচ্ছে কালোটাকা। বড় বড় ক্লাবে প্রয়োজন হোক বা না হোক, প্রতিদিন একই পরিমাণ চাল, ডাল, তেল, মরিচ, লবণ, পেঁয়াজ, রসুন, চিনি ইত্যাদি ক্রয় করে সাধারণ পর্যায়ের কর্মচারীরাও বানাচ্ছে কালোটাকা। গ্রামে গ্রামে জমি কেনা-বেচা। তালিকা দেখলেই বোঝা যাবে কারা করছে এসব। ডাক্তার, উকিল, মোক্তার, টিউশনি করা মাস্টার, আর্কিটেক্ট-এদের অনেকেই প্রতিদিন তৈরি করছেন কালোটাকা। কেবল ঢাকা শহরেই ফুটপাতে ৫ লাখ হকার আছে। তাদের প্রত্যেককে প্রতিদিন ১০০ থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। বছরে এর পরিমাণ কমপক্ষে ৪০০ কোটি টাকা। এটাও কালোটাকা। প্রশ্ন, সমাজের কোন ক্ষেত্রে, কোথায় প্রতিদিন কালোটাকা তৈরি হচ্ছে না?

এখানে বোঝা দরকার কালোটাকা কোনটি। কোনো নোটই কালো নয়। সবই নোট। তাহলে ‘কালো’ বলছি কেন? কালো বলার কারণ এ টাকার ওপর কোনো ট্যাক্স দেওয়া হয়নি। সরকারের খাতায় এর কোনো হিসাব নেই। এই ‘নন-ট্যাক্সড’ আয়ের উৎস নানারকম হতে পারে। এটা হতে পারে সৎপথে রোজগারের টাকা, হতে পারে চোরাচালান, ঘুস-দুর্নীতি, হুন্ডির টাকা। এখন মুশকিল হচ্ছে-কীভাবে ধরা হবে কোনটি সৎপথের টাকা, কোনটি অবৈধ পথের টাকা। ভীষণ কঠিন কাজ। একজন ভদ্রমহিলা তার বাবার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা পেয়েছেন উপহার হিসাবে ‘ক্যাশ’। গ্রামে হাজার হাজার লোক আছে, যারা কোনো ট্যাক্স না দিয়ে বছরে হাজার হাজার টাকা জমান। কয়েক বছরে তা কত টাকা হয়? মৌলভীবাজারের যে ব্যবসায়ী ১০/২০/৩০ হাজার টাকা ট্যাক্স দেন, তিনি দিনে লেনদেন করেন লাখ লাখ টাকা। তার কত টাকা ‘কালো’, কত টাকা ‘সাদা’? চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে দিনে লেনদেন হাজার হাজার কোটি টাকা। আমাদের ব্যবসায়ী ভাইদের কয়জন কত টাকা ট্যাক্স বছরে দেন? সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আয়-রোজগারের ব্যবস্থা। কিন্তু কয়জন ট্যাক্স দেন? বহু প্রতিষ্ঠান ‘কনসালটেন্সি’ করে, তারা কি নিয়মিত ট্যাক্স দেন? বিদেশে আসা-যাওয়া, খাওয়া, বেড়ানোতে যে টাকা খরচ করে একশ্রেণির লোক, তারা কি সেই টাকা বিধিমতো ট্যাক্সের ফাইলে দেখান? টেলিভিশনের ‘টকশোতে’ যে সম্মানি পাওয়া যায়, সেই টাকা কতজন ট্যাক্সে দেখান? এসবই তো ‘নন-ট্যাক্সড’ টাকা। তবে কথা আছে। এসবের পরিমাণ খুব বেশি নয়। বেশি হচ্ছে ‘কন্ট্রাক্টরি’ খাতে। বড় বড় প্রকল্পে। ঘুস-দুর্নীতিতে টাকা বেশি। ব্যবসা খাতে বেশি। ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভেয়েসিংয়ে কালোটাকার সংশ্লিষ্টতা বেশি। অনেক ব্যবসায়ী তাদের হিসাব করেন তিনটি-এ কথা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টরা বলেছেন। একটি হিসাব তাদের নিজেদের জন্য, একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য এবং আরেকটি ‘ইনকাম ট্যাক্সের’ জন্য। এতেই বোঝা যায়, এখানে প্রতিবছর কত কালোটাকার জন্ম হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, কালোটাকার জন্ম হচ্ছে প্রতিদিন, অফিসে অফিসে, প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে, ব্যবসায়-ব্যবসায়।

কালোটাকা ধরার জন্য ১৯৭৪-৭৫ সালের দিকে তখনকার সর্বোচ্চ নোট ১০০ টাকা বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর মোশতাক সরকার সেই টাকা ফেরত দিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু কালোটাকা, চুরি-দুর্নীতি, অনিয়মে তিতিবিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমার কম্বলটা কোথায়’ (তখন দেশে দান হিসাবে হাজার হাজার কম্বল এসেছিল)? তিনি বলেছিলেন, ‘ফায়ারিং স্কোয়াড’ করব। ‘জরুরি আইন’ করে বিচারের ব্যবস্থা করেছিলেন। এরপর সামরিক শাসক এসেছে, আধা-সামরিক শাসক এসেছে, নির্বাচিত-অনির্বাচিত সরকার এসেছে। আজ কী মনে হয়? কালোটাকা কমেছে? এমন এক সময় ছিল যখন দেশে চোরাচালানির পণ্য পোড়ানো হয়েছে। ‘৫৫৫’ সিগারেট পোড়ানো হতো নিয়মিতভাবে। কতবার চোরাচালানিদের নাম-ধাম কাগজে ছাপা হয়েছে, কতবার হুন্ডিওয়ালাদের নাম কাগজে দেখেছি। কত প্রশাসনিক পদক্ষেপ দেখলাম এ পর্যন্ত। সামরিক শাসনামলে দুষ্ট ব্যবসায়ীদের ধরা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আদায় করে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। জেলা প্রশাসকরা কত পদক্ষেপ প্রতিবছর নেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এখনো বলা হচ্ছে সীমান্ত অঞ্চলে ‘ক্যাশ টাকা’র ব্যবহার অতিরিক্ত, যেমন বলা হতো স্বাধীনতার পরেও। একই অবস্থা এখনো বিদ্যমান। সীমান্ত অঞ্চলের লোকেদের দেশের ভেতরের লোকের চেয়ে বেশি ‘আয়’ বলে এক গবেষণায় দেখেছিলাম। তাদের অনেকেই দিনে ঘুমায়, রাতে কাজ করে। কেন? দুদিন আগেই পত্রিকায় দেখলাম যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ইত্যাদি অঞ্চল হচ্ছে সোনা চোরাচালানের রুট। কোথায় যায় সোনা? কারা এ ‘ব্যবসা’ করে সবাই জানে। প্রশ্ন, এতে কি সাধারণ লোক জড়িত নয়? বিপুলসংখ্যক লোক এর উপকারভোগী না হলে এ চোরাচালান চলতে পারে না। এভাবে দেখলে পরিষ্কার বোঝা যাবে-আমরা কালোটাকার ওপর ভাসছি। কারা ভাসছে বেশি? সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেছেন, উচ্চবিত্ত দুর্নীতিবাজরা বিদেশে অর্থ পাচার করছে।’ দেশে দুর্নীতি বেড়েছে তাতে সন্দেহ নেই। উচ্চবিত্ত পর্যায়ে দুর্নীতি বেশি হচ্ছে। এরা ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করছে (১৭.০৯.২৩)।

এসব কি একদিনে হয়েছে? এটা কি ‘টাকা বানাও, পুঁজি গঠন করো’ নীতির ফল নয়? এটা কি উগ্র বাজার অর্থনীতির ফল নয়? তা না হলে এ অবস্থা কেন? ৫০-৫২ বছর যাবৎ একই দাবি, একই আন্দোলন-দ্রব্যমূল্য কমাতে হবে, চোরাচালান বন্ধ করতে হবে, হুন্ডিওয়ালাদের বিচার করতে হবে, কালোটাকার মালিকদের বিচার করতে হবে, অর্থ পাচারকারীদের ধরে বিচার করতে হবে, পাচারকৃত টাকা ফেরত আনতে হবে, ‘ট্রাইব্যুনালে’ বিচার করতে হবে। আমরা দাবি করে যাচ্ছি আর সব অনাচার আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি হচ্ছেই। হুন্ডির পরিমাণ বাড়ছেই। চোরাচালান বাড়ছেই। পাচারের পরিমাণ বাড়ছেই। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছেই। কোনো প্রতিকার নেই। যারা আমাদের ‘ভাগ্যবিধাতা’, সেই রাজনীতিকরা দলমত নির্বিশেষে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিচ্ছেন, আর আমরা দাবি করছি উলটো। সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাজনীতিকদের এই যে বিভেদ-পার্থক্য, এর শেষ কোথায়? কেউ তা জানে না।

এদিকে বৈষম্য বাড়ছে। বাঙালিদের বাড়িঘর হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, ব্যাংকক, দুবাই, কানাডা, আমেরিকা ও ইউরোপে। বিত্তশালী, উচ্চবিত্তদের পরিবার চলে যাচ্ছে সেখানে। দেখাদেখি মধ্যবিত্তও রওয়ানা দিতে চায়। সাধারণ মানুষও অর্থের নেশায় ভূমধ্যসাগরে ঝাঁপ দিয়ে হলেও ইউরোপে যেতে চায়, যা ভিন্নধর্মাবলম্বীদের দেশ। কী দেশ আমরা বানালাম, যেখানে কেউ থাকতে চায় না? কী দেশ বানালাম, যেখানে কৃষকের ছেলেমেয়েরা ডলার পাঠায়, আর সে ডলার ধনীরা পাচার করে বিদেশে নিয়ে যায়? সিঙ্গাপুরের শ্রেষ্ঠ ধনী বাঙালি, আরও কত দেশে কে জানে? বিষয়টি তো সাধারণভাবে আনন্দের হওয়ার কথা ছিল। না, তা নয়। এটা প্রশ্ন জাগাচ্ছে, কেন এই নীতি? টাকা বানানোর সুযোগ দেওয়া? কেন উগ্র বাজার অর্থনীতি, যেখানে মেধা, পরিশ্রম, দক্ষতা ও প্রতিযোগিতার কোনো মূল্য নেই? কোনো উত্তর পাই না। ৩০/৪০/৫০ বছর আগে যা লিখেছি, যেসব বিষয়ের ওপর লিখেছি, আজও তা লিখে যাচ্ছি। যারা এসবের বিরুদ্ধে বলছেন, তাদের কয়জনের ‘স্টেইক’ বাংলাদেশে আছে, তাও এক প্রশ্ন। অনেক প্রশ্ন। স্বাধীনতার পর কী পাব বলে মনে করেছিলাম আর কী পাচ্ছি এখন? এখন তো মনেই হয়, আমরা লাগিয়েছি ‘মান্দার গাছ’, আর ফল আশা করছি সুমধুর আম। এটা হওয়ার নয়। ‘বুঝ হে সুজন, ধ্যানে দিয়ে মন।’

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম