Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

প্রশাসনিক সংস্কার থেমে গেল কেন?

Icon

বিমল সরকার

প্রকাশ: ১১ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রশাসনিক সংস্কার থেমে গেল কেন?

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদকালে (২০০৯-২০১৩) নতুন জেলা ঘোষণার দাবিতে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর ও ভৈরব হঠাৎই উত্তাল হয়ে ওঠে। দুটি উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার সর্বস্তরের জনগণ, যার যার এলাকার অনুকূলে পৃথক জেলা ঘোষণার দাবিতে যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে, তা সারা দেশেই ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। দল ও মতের ওপরে উঠে সবাই সোচ্চার হন ‘বাজিতপুর জেলা চাই’ কিংবা ‘ভৈরব জেলা চাই’ দাবিতে। আন্দোলনকারীদের একের পর এক কর্মসূচি পালনের ফলে স্থলপথ, নদীপথ ও রেলপথে যাতায়াতের ক্ষেত্রে অচলাবস্থা দেখা দেয়। বাজিতপুর আর ভৈরব যেখানেই হোক; পরিস্থিতি এমন হয় যে দেশের ৬৫তম জেলা ঘোষণার বিষয়টি যেন কেবল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু যে কারণ আর পরিস্থিতিতেই হোক, জেলা দাবির আন্দোলনটি ক্রমে স্তিমিত হয়ে আসে। প্রশাসনিক সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং তা সরকারের সাধারণ প্রশাসনেরই অংশ। বিভাগ, জেলা, মহকুমা (সাবেক), উপজেলা বা থানা, ইউনিয়ন এমন অনেক বিভাগ-বিভাজন বা প্রশাসনিক বিন্যাস রয়েছে আমাদের দেশে। ইউনিয়ন থেকে উপজেলা (সাবেক থানা), উপজেলা থেকে মহকুমা (আশির দশকে বিলুপ্ত), মহকুমা থেকে জেলা, জেলা থেকে বিভাগ ঘোষণা ও সৃষ্টি এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। আরও রয়েছে নতুন নতুন পৌরসভা সৃষ্টির উদাহরণ। পৌরসভা থেকে করপোরেশন, করপোরেশন থেকে সিটি করপোরেশন।

জেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ইউনিট বা একক। জেলার উপরে রয়েছে বিভাগ আর নিচে উপজেলা। উপমহাদেশে ইংরেজরা প্রায় দুশ বছর রাজত্ব করে। আমাদের প্রশাসনিক কাঠামো বা বিন্যাসটি মূলত ইংরেজদের হাতেই তৈরি। ভারত ভাগ হয়ে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর পূর্ববঙ্গ তথা আমাদের বাংলাদেশ অঞ্চলে জেলা পড়ে মোট ১৭টি। এগুলোর দেশের সাবেক বা বৃহত্তর জেলা হিসাবে পরিচিত। দেশভাগের সময় উপমহাদেশ তথা গোটা এশিয়ায় আয়তনে সবচেয়ে বড় ময়মনসিংহ জেলাটি পড়ে আমাদের ভাগে। সেই পঞ্চাশের দশকেই টাঙ্গাইল ও পটুয়াখালী মহকুমাকে স্বতন্ত্র দুটি জেলায় রূপান্তরের দাবি উঠলেও তা বাস্তবায়ন হয় পাকিস্তান আমলের একেবারে শেষদিকে। আওয়ামী লীগের ৬ দফা এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা প্রণীত হলে একদিকে আন্দোলন-সংগ্রাম ও গণঅভ্যুত্থান এবং সত্তরের সাধারণ নির্বাচন; অন্যদিকে ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইল ও বরিশাল (বাকেরগঞ্জ) থেকে পটুয়াখালীকে আলাদা করে স্বতন্ত্র জেলা প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া যেন সমানতালে চলতে থাকে। সারা দেশে (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) তখন কী উত্তপ্ত ও জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি! গণঅভ্যুত্থানের চোটে পাকিস্তানের দণ্ডমুণ্ডের মালিক কথিত লৌহমানব প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান ইতোমধ্যে (২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯) পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। তার স্থলাভিষিক্ত হন জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। এমনই পরিস্থিতিতে ১৯৬৯ সালে টাঙ্গাইলকে প্রদেশের ১৮তম আর পটুয়াখালীকে ১৯তম জেলা হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়। কেবল ঘোষণা নয়, নতুন জেলার যাবতীয় কার্যক্রমও শুরু হয়ে যায় সাধারণ নির্বাচন (১৯৭০) অনুষ্ঠানের আগেই। প্রণিধানযোগ্য যে, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ এক্ষেত্রে কোনো অজুহাতই নতুন দুটি জেলা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দেখা দেয়নি। ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে মোট ১৯টি জেলা নিয়ে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। পরে ২০তম জেলা হিসাবে তালিকায় যুক্ত হয় জামালপুর (১৯৭৮)। আশির দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিন্যাস করে সৃষ্টি হয় আরও তিনটি জেলার-বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি। জেনারেল এরশাদের শাসনকালে আশির দশকে ব্যাপক প্রশাসনিক সংস্কারের অংশ হিসাবে দেশের সব মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। বিগত চার দশক বা ৪০ বছর (১৯৮৪-২০২৪) পর্যন্ত দেশে জেলার সংখ্যা হয় ৬৪। তবে দীর্ঘসময়ে (১৯৮৪-২০২৪) আমাদের দেশে জেলার সংখ্যা বাড়েনি একটিও। ৪০ বছরে জেলা সৃষ্টি হয়নি একটিও; কেবল আমাদের দেশে নয়, ভারত ও পাকিস্তানেও এ এক বিরল উদাহরণ। এরশাদের পর বিগত ৩৪ বছরে (১৯৯১-২০২৪) শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ চারবার মোট বিশ বছর দেশ শাসন করে (১৯৯৬-২০০১, ২০০৯-২০১৪, ২০১৪-২০১৮ ও ২০১৮-২০২৩)। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পঞ্চমবারের মতো শপথ নিলেন। তাছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দুই মেয়াদে শাসন করেছেন মোট দশ বছর (১৯৯১-১৯৯৬ ও ২০০১-২০০৬)। এ দীর্ঘসময়ে নতুন নতুন বিভাগ ও বেশ কিছুসংখ্যক উপজেলার সৃষ্টি হয়েছে। প্রসিদ্ধ পৌর শহরকে উন্নীত করা হয়েছে সিটি করপোরেশনে। অন্তত দুশ জনপদকে পৌরসভায় উন্নীত করা হয়। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিভাগ ৮টি, জেলা ৬৪টি, সিটি করপোরেশন (ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণসহ) ১২টি, উপজেলা ৪৯৫টি এবং পৌরসভা ৩৩০টি। এমন ব্যাপক সংস্কার সম্পন্ন হলেও বলতে গেলে পৌনঃপুনিকভাবে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আমলে দেশে আর একটিও জেলা সৃষ্টি করা হয়নি। দেশে সর্বোচ্চ ১৬ কিংবা ১৫টি উপজেলা নিয়ে গঠিত জেলা রয়েছে। আর ১৪ বা ১২-১৩টি উপজেলা নিয়ে গঠিত জেলা রয়েছে বেশ কয়েকটি। আমার নিজ জেলাতেও (কিশোরগঞ্জ) উপজেলার সংখ্যা ১৩। বেশিসংখ্যক উপজেলা নিয়ে গঠিত বড় কলেবরের জেলার পাশাপাশি রয়েছে মাত্র তিনটি করে উপজেলা নিয়ে গঠিত একাধিক ছোট আয়তনের জেলা। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও দশকের পর দশক গড়িয়ে গেলে কী হবে, বাস্তবে জেলা সংস্কার বা পুনর্বিন্যাস করার কোনো উদ্যম-তাগিদ নেই। আবারও উল্লেখ করতে চাই-প্রশাসনিক সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং তা সরকারের সাধারণ প্রশাসনেরই অংশ। গত ৪০ বছরে প্রতিবেশী ভারতে কম করে হলেও দেড়শ নতুন জেলা হয়েছে। এই তো সেদিন (২০২০) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে একসঙ্গে নতুন ৭টি জেলা গঠন করার ফলে রাজ্যে মোট জেলার সংখ্যা দাঁড়াল ৩০। ভারতে জনগণনা অনুযায়ী ২০০১ সালে ৫৯৩ ও ২০১১ সালে ৬৪০টি জেলা আর বর্তমানে রয়েছে ৭৪০টি। পাকিস্তানে (সাবেক পশ্চিম পাকিস্তান) ১৯৪৭ সালে কিংবা ৪০ বছর আগে কয়টি জেলা ছিল তা আমার জানা নেই। বর্তমানে পাকিস্তানে মোট জেলার সংখ্যা ১৫০। দীর্ঘসময়ে (১৯৮৪-২০২৪) বিভাগ, উপজেলা, থানা ও ইউনিয়নের পাশাপাশি সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার সংখ্যা বাড়লেও আমাদের দেশে জেলার সংখ্যা বাড়েনি একটিও। জানা যায়, গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯১২ সালে ইংরেজরা প্রসিদ্ধ জনপদ বাজিতপুরকে মহকুমা করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। মহকুমা গঠনের লক্ষ্যে প্রায় ৬১ একর ভূমি অধিগ্রহণ করেছিল (যা সরকারি হাসপাতালের সন্নিকটে আজও বিদ্যমান)। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) শুরু হলে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে পড়ে। মাঝে গড়িয়ে যায় অনেক পানি। আশির দশকে এরশাদের আমলে নতুন করে শুরু হয় জেলা ঘোষণার আন্দোলন। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার আমলে বাজিতপুর ও ভৈরব দুটি পৃথক জেলার দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে। সর্বস্তরের জনসাধারণ তাতে সম্পৃক্ত হয়। কিন্তু জেলার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। প্রায় পনেরো বছর স্তিমিত থাকার পর জেলার দাবিতে আবারও আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছে। কেবল দেশে নয়, এবার বিদেশের মাটিতেও প্রবাসীরা সোচ্চার হয়ে জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি ‘বাজিতপুর জেলা চাই’-এমন লেখাবিশিষ্ট ব্যানার সামনে রেখে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মতবিনিময় সভার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। জানি না দেশের ৬৫তম জেলাটি দেখার জন্য দেশবাসীকে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হয়।

 

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম