দুর্যোগ মোকাবিলার কাজটি ঠিকমতো হচ্ছে তো?
ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের নিয়তি, বিশেষ করে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় এ অঞ্চলের একটি অবধারিত বিষয়। ছোট, মাঝারি, বড় কিংবা অতিবড় সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় প্রায় প্রতিবছর যে কোনো সময় ঘটতে দেখা যায়। তবে মে এবং নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় প্রলয়ংকরী রূপ ধারণ করে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করে। এসব ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় আমাদের নানামুখী প্রচেষ্টা ও প্রস্তুতির অন্ত নেই। বিশেষ করে প্রলয়ংকরী ঝড়ে মৃতের সংখ্যা কমে আসার বিষয়টি কিছুটা স্বস্তিদায়ক।
তবে কৃষি, গৃহ ও যোগাযোগব্যবস্থায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তেমনভাবে কমানো সম্ভব হয়নি। মৎস্য, চিংড়িঘের ও গবাদি পশু রক্ষায় নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও তেমন সাফল্য আসেনি। এর পেছনে নিু মানসিকতার পাশাপাশি রয়েছে প্রকল্পগুলোর সঙ্গে জড়িত একশ্রেণির অসাধুর অতিমুনাফা লাভের ঘৃণ্য তৎপরতা। কদিন আগে ঘূর্ণিঝড় রিমালে মানুষের প্রাণহানির সংখ্যা আগের ঝড়গুলোর তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। বনের পশুও মারা গেছে অগণিত। তথ্য অনুযায়ী, কসবাতে ২৮টিসহ সুন্দরবনে অন্তত ১১৯টি হরিণের মৃতদেহ মিলেছে। অন্যান্য বিপর্যস্ত এলাকায় গবাদি পশু বেশি মারা গেছে। শুধু হাতিয়ায় দুই হাজার গবাদি পশু ভেসে গেছে। উপকূলীয় এলাকায় কোথাও কোনো মুরগির ফার্ম অবশিষ্ট নেই। একটানা ৩৬-৩৭ ঘণ্টা লবণাক্ত পানির নিচে থাকায় সুন্দরবনের সব মিঠা পানির আধার লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে বনের পশু মিঠাপানির অভাবে লোকালয়ে চলে এলে স্থানীয়দের জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
এছাড়া উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনাসহ দেশের ১৯ জেলায় মাছ ও চিংড়িঘেরের ওপরও রিমালের তাণ্ডব স্পষ্ট। বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে, খুলনার পাইগাছা, কয়রায় ৫৫৭৫টি মাছের ঘের, ৩৫ হাজার চিংড়িঘের নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। মোড়েলগঞ্জের ৩৫ কিমি. বেড়িবাঁধ গুঁড়িয়ে গেছে। মূলত উপকূলীয় জেলাগুলোয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও বেকার যুবকরা মাছচাষের ওপর নির্ভর করে থাকে, এলাকার অর্থনীতিকেও সচল রাখে। তাদের ঘেরে কাজ করে হাজারও শ্রমিক। ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে এখন তাদের চোখে শুধুই কান্না। আশ্রয়শিবিরে থাকায় প্রাণে বাঁচলেও বাড়িতে ফিরে নিশ্চিহ্ন চিংড়িঘের দেখে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
মোড়েলগঞ্জের চিংড়িচাষিদের অভয় দেওয়া হয়েছিল, এখানকার বেড়িবাঁধের উচ্চতা চৌদ্দ ফুট হওয়ায় এত উঁচুতে পানি উঠবে না। কিন্তু ঝড়ের সময় পানির উচ্চতা ষোলো ফুট পেরিয়ে যাওয়ায় ঘেরে বেড়াও নেই, মাছও অবশিষ্ট নেই। রিমালে ভেসে গেছে ৬৯৭ কোটি টাকার মাছ। এছাড়া ৫৪১টি নৌযান, ৬৩৫টি স্লুইসগেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিপর্যস্ত এলাকার দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে এলাকার মানুষ এখন বাঁচার উপায়ের কথা ভাবছেন।
এর আগে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আইলা-সিডরের চেয়ে এবারের রিমাল ছিল মাঝারি ও মৃদু ধরনের। দিনের বেলায় আঘাত হেনেছে বেশি। এরপরও ১১ জনের প্রাণহানিসহ এত ক্ষয়ক্ষতি হলো কেন? এবার তারা ঘুরে দাঁড়াবেনই বা কীভাবে?
উপকূলীয় জেলাগুলোর মৎস্য, চিংড়িঘেরের ওপর নির্ভরশীল মানুষ এখন সেই দুশ্চিন্তায় ঘুরপাক খাচ্ছেন। এতদিন মুখ ফুটে কিছু না বললেও রিমালের তাণ্ডবে নিঃস্ব হয়ে এখন তারা বেড়িবাঁধ নির্মাতাদের দোষারোপ করছেন। রিমাল আসার আগেই জোয়ারের চাপে অনেক স্থানে বাঁধ ভাঙা ছিল। সেগুলো মেরামত করে দেওয়া হয়নি। ফলে রিমালের প্রভাবে ভাঙা অংশ দিয়ে প্রবল বেগে পানি ঢুকে মৎস্য, চিংড়িঘের বিলীন হয়ে গেছে।
ফিবছর অর্থ বরাদ্দ আসে বিপুল পরিমাণে; কিন্তু বেড়িবাঁধ সেই অনুযায়ী মজবুত করে মেরামত করা হয় না। কাদা-বালির বাঁধ প্রতিবছর জোয়ারের পানির ধাক্কায় ভেঙে যায়। তারা বলছেন, ‘ত্রাণ চাই না, শক্ত বাঁধ চাই’।
আসলে ত্রাণ, দান ও সাহায্য ইত্যাদি সাময়িক উপকারের বিষয়। এতে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করা যায় না। বিশেষ করে যারা ত্রাণ পেতে মরিয়া এবং ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাদের ফাও খাওয়ার লোভলালসা আক্রান্ত করে ফেলে। এদের দিয়ে টেকসই উন্নয়ন লাভ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। অপরদিকে, যারা বিপর্যস্ত মানুষের জন্য বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রকল্প নিয়ে তৎপর হয়ে উঠেন, তারাও সাময়িক দানখয়রাত ও ত্রাণ দিয়ে উপদ্রুত এলাকা থেকে সটকে পড়েন। খাপছাড়া এসব কাজে প্রতিবছর কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের যেমন অপচয় হয়, দুর্যোগকবলিত মানুষ এ দিয়ে শুধু সবার কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাততে শিখে। সরকারি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে নির্লোভ মানুষের সংখ্যা মুষ্টিমেয়। ফলে সরকারি বরাদ্দকৃত অর্থের ক্ষেত্রে ব্যাপক নয়ছয় হয়ে থাকে। ভুক্তভোগী মানুষ বরাদ্দের অর্থের নাগাল পায় না।
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার অধিকাংশ মানুষ রিমালে মৎস্য ও চিংড়িঘেরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হিসাবে ঠিকাদারদের উদাসীনতা ও অবহেলাকে দায়ী করছেন। এর সঙ্গে লোভী ও অসাধু হোয়াইট কালার চক্রের যোগসাজশ তো আছেই। যারা চান প্রতিবছরই বাঁধ ভাঙুক এবং নতুন করে অর্থ বরাদ্দ আসুক। এতে অসাধু চক্রের লাভ! এগুলো ওপেন সিক্রেট হলেও সবাই নির্বিকার। মানুষের জন্য টেকসই কল্যাণের কথা চিন্তা করার সঠিক মানুষ কোথায়?
উপকূলীয় এলাকায় যত প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ই হোক না কেন, তা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা মানুষের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এজন্য আগাম প্রস্তুতি হিসাবে কী কী করতে হবে, তা মানুষের বোধগম্যতার মধ্যেই নিবিষ্ট আছে; কিন্তু ফিবছর বরাদ্দের টাকা লুট করে মজবুতভাবে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার করা না হলে এবং প্রলয়ংকর ঘূর্ণিঝড় তাণ্ডব চালালে এর দায়ভার কে নেবে?
এবারের মৃদু ঘূর্ণিঝড় রিমালে প্রভাবে মৎস্য, চিংড়িঘেরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি তথা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে এর ভয়ংকর প্রভাবের আশঙ্কার কথা নতুন করে বলার দরকার নেই। সেসবের মূল কারণ এলাকার মানুষই বলে দিয়েছে। তাই ঠিকাদারদের নয়ছয় রুখতে জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপের শিক্ষা নেওয়া উচিত। অনেকদিন আগে আমি ওকিনাওয়ার রিওকিউজ ইউনিভার্সিটিতে এডিবি আয়োজিত বিশ্ব পরিবেশের ওপর এক কনফারেন্সে অংশ নিয়েছিলাম। ওকিনাওয়ায় অনেক ছোট ছোট দ্বীপ আছে। ভ্রমণসূচিতে ছিল একটি ছোট্ট দ্বীপের তীরে সমুদ্র দেখতে যাওয়া। এমনভাবে এ দ্বীপের কিনারা বেঁধে সাজানো হয়েছে, প্রচণ্ড বাতাসে সমুদ্রের পানি পাথরে ধাক্কা লেগে অনেক ওপরে উঠে ঝরনার মতো পর্যটকদের গায়ে ছিটকে পড়ে। সেখানে সেটা সবাই বেশ মজা করে উপভোগ করে। এডিবির কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে আমি বাংলাদেশি জানতে পেরে একজন বলেন, তোমাদের দেশে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় বাঁধ নির্মাণে অনেক অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়; কিন্তু কাজগুলো ওকিনাওয়ার মতো টেকসই করে তৈরি করা হয় না কেন? এরা সমুদ্রতীর কতটা টেকসই করে বেঁধেছে, তোমরা নদীর তীরগুলো দুর্বল করে বাঁধ, যা প্রতিবছর ভেঙে যায়।
ভদ্রলোক জাইকার হয়ে অনেকদিন বাংলাদেশে কাজ করেছেন। তাই আমাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন বলে মনে হলো। আমার নীরবতা দেখে তিনি নিজেই উত্তরটা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তোমাদের প্রকৌশলীরা অতি চালাক অথবা ঠিকাদাররা অপেশাদার, অনভিজ্ঞ-তাইতো বলবে? নাকি অন্যকিছু? রিমালে বেড়িবাঁধ ভেঙে মাছের ঘের ভেসে যাওয়ার চিত্র দেখে ওই কথাগুলো বারবার মনে হচ্ছিল।
ঘূর্ণিঝড় রিমাল ছিল মাঝারি ধরনের, তবে ঘন বৃষ্টি ও দীর্ঘসময় বাতাস হয়েছে। সে কারণে বাড়িঘর, সবজি ফসল, মাছের পুকুর-ঘের সবকিছু ডুবে ভেসে একাকার হয়ে গেছে। অর্থনীতিতে এর প্রভাব অতি মারাত্মক হতে পারে। বিশেষ করে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগ ছাড়াও সারা দেশে ব্যাপক ফসলহানি, মৎস্যসম্পদের ক্ষতি, রাস্তাঘাট, বাড়িঘর পুনঃমেরামত প্রভৃতির প্রভাব কাটিয়ে ওঠা কারও কারও জন্য খুব কঠিন হতে পারে। ঋণ করে চিংড়ি ঘেরে বিনিয়োগকারীরা চোখে অন্ধকার দেখছেন। এদের শুধু ত্রাণ না দিয়ে নিজ পেশায় ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বিনা সুদে ঋণপ্রদান জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের নিত্যসাথি। ফিবছর কয়েকবার ঘূর্ণিঝড়, খরা, বন্যা প্রভৃতি দুর্যোগের সঙ্গে দুর্ভোগ ও দারিদ্র্য ঘুরেফিরে আসে। শুধু অর্থ বরাদ্দ দিয়ে যে প্রাকৃতিক বিপদ মোকাবিলা করা যায় না, সেটা রিমালের ক্ষয়ক্ষতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। একটি টেকসই মোকাবিলা বেষ্টনী তৈরির জন্য মানবদরদি, নির্লোভ মানুষগুলোকে সম্পৃক্ত করে ধাপে ধাপে ফলোআপের মাধ্যমে প্রকৃতির রুদ্ররোষের বিরুদ্ধে টিকে থাকার প্রচেষ্টা আমাদেরই করতে হবে।
ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd