পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনে সুফল মিলবে কি?
আবু তাহের খান
প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের বিপদ সম্পর্কে সম্প্রতি সরকারকে আবারও সতর্ক করলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। এ প্রসঙ্গে শ্রীলংকার উদাহরণ টেনে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক এক সেমিনারে তিনি বলেছেন, ‘স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের কারণে বিপজ্জনক পথে রয়েছে বাংলাদেশ। শ্রীলংকা এ ধরনের স্বল্পময়াদি ঋণের ফাঁদে পড়েছিল। ঋণের সুবিধা সে দেশের সেবা খাতে যথার্থভাবে যুক্ত হয়নি। বাংলাদেশেও এমন ঋণ বাড়ছে’ (সমকাল, ৫ এপ্রিল ২০২৪)। এর আগেও বিষয়টি নিয়ে তিনি একাধিকবার দেশের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তাতে বৈদেশিক ঋণগ্রহণের গতি সাময়িকভাবে হলেও কিছুটা শ্লথ হয়েছিল বলে মনে হলেও এখন আবার তারা সে পুরোনো পথেই হাঁটছেন বলে মনে হচ্ছে।
পায়রায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের জন্য স্বল্পমেয়াদি ঋণ চাওয়া হচ্ছে চীনের কাছে, যে বন্দর স্থাপনের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। আর প্রয়োজন যে নেই, তার বিভিন্ন প্রমাণাদিও ইতোমধ্যে অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে বহুবার বিভিন্ন পর্যায়ে তুলে ধরা হয়েছে। অধ্যাপক মইনুল ইসলাম তার একাধিক লেখায় এসব তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরে, পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনসহ আরও বেশকিছু প্রকল্প গ্রহণ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। এতদসত্ত্বেও গত ৩ এপ্রিল বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূতের কাছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন তথা পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের মতো প্রকল্পের জন্য ঋণ চাওয়া হয়েছে, যে ঋণ অবধারিতভাবেই স্বল্পমেয়াদি ও ব্যয়বহুল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইতোমধ্যে পায়রায় স্থাপিত সমুদ্রবন্দরের সিংহভাগ ক্ষমতাই যেখানে অব্যহৃত অবস্থায় পড়ে আছে এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে যেটি ইতোমধ্যে অলাভজনক বলেও প্রমাণিত হয়েছে, সেখানে পায়রায় নতুন করে আরেকটি গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের চিন্তা, অন্য কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে, খুবই অদূরদর্শিতাপূর্ণ নয় কি? উল্লেখ্য, প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পায়রাবন্দরের প্রথম টার্মিনালটি ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করার পর থেকে ২০২২ পর্যন্ত পরবর্তী ছ’বছরে সেখানে জাহাজ ভিড়েছে মাত্র ২৬০টি এবং তা থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে মাত্র ৬১৩ কোটি টাকা (বিবিসি বাংলা, ২৮ অক্টোবর ২০২২)। বন্দরের আওতায় আরও বেশকিছু অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলমান আছে, যেগুলো সম্পন্ন হলে এর মোট স্থাপন ব্যয় আরও বহুগুণে বেড়ে যাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিপুল ব্যয়ে স্থাপিত যে বন্দরে ৬ বছরে জাহাজ ভিড়ে মাত্র ২৬০টি আর আয় হয় মাত্র ২৬০ কোটি টাকা, সে বাস্তবতাকে পাশে রেখে সেখানে স্বল্পমেয়াদি ও ব্যয়বহুল বৈদেশিক ঋণের অর্থে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের চিন্তা অনেকটাই অবিমৃষ্যকারিতা নয় কি?
কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ বর্তমানে চলমান আছে, যা ২০২৬ সাল নাগাদ সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। এবং নির্মাণাধীন ওই গভীর সমুদ্রবন্দরের কাম্য মাত্রার লাভজনকতা নিশ্চিত করে এর পূর্ণাঙ্গ সদ্ব্যবহারের বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। কারণ এর সম্ভাব্য প্রতিবেশী ব্যবহারকারী হিসাবে শুধু ভারতের কথা না ভেবে নেপাল, ভুটান ও চীনকেও কীভাবে প্রতিযোগিতামূলক বিবেচনা দিয়ে এর সঙ্গে যুক্ত করা যাবে, সে বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে ইউনান প্রদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এ বন্দরের মাধ্যমে করানোর ব্যাপারে চীনের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তেমন কোনো কার্যকর অগ্রগতি হয়েছে বলেও জানা যায় না। মোটকথা, নির্মাণাধীন মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের কাম্য ব্যবহারের বিষয়টিই এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত নয়। এ অবস্থায় পায়রাতে দ্বিতীয় আরেকটি গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের ধারণা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন যে লাভজনক হবে না, তার পর্যাপ্ত প্রমাণ ও স্বীকৃতি সরকারি নথিপত্র ও সংশ্লিষ্ট সমীক্ষা প্রতিবেদনেই রয়েছে। নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ২০২১ সালের ২০ এপ্রিল বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। তাছাড়া পায়রা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা নানা বিশ্লেষণ করেছেন। যেটুকু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য প্রায় সত্তর কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল ঠিক রাখা চ্যালেঞ্জের বিষয়। তাছাড়া স্টাডিতে দেখা যাচ্ছে, জায়গাটি ঠিক বন্দরের জন্য যথাযথ নয়। এসব নানা কারণে গভীর সমুদ্রবন্দরের চিন্তা বাদ দেওয়া হয়েছে।’ বস্তুত এ সংক্রান্ত সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সব সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনেই পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের বিষয়টিকে সম্পূর্ণ অলাভজনক ও অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পায়রাতে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের বিষয়ে অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের বিষয়টি ছিল একটি জবরদস্তিমূলক সিদ্ধান্ত। আঞ্চলিক রাজনীতির কারণে এটিকে গভীর সমুদ্রবন্দর বানানোর চেষ্টা হয়েছিল। এটি কখনোই গভীর সমুদ্রবন্দর হতো না’ (বিবিসি বাংলা, ২০ এপ্রিল ২০২১)। তো এ যখন পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ফলাফল ও অর্থনীতিবিদদের মতামত, তখন কেন, কী উদ্দেশ্য ও কোন যুক্তিতে ওই গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রদানের জন্য চীনা রাষ্ট্রদূতের কাছে অনুরোধ পেশ করা হলো, তা মোটেও বোধগম্য নয়। এবং বিশেষ করে তা এমন মুহূর্তে, যখন দেশের অর্থনীতিতে একটি চরম বিপন্নদশা চলছে এবং অধ্যাপক রেহমান সোবহানের মতো একজন দায়িত্বশীল অর্থনীতিবিদ বলতে বাধ্য হচ্ছেন, স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের কারণে বাংলাদেশ এখন শ্রীলংকার মতোই বিপজ্জনক পথে রয়েছে। আর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দেওয়া পরিসংখ্যানও বলছে, বৈদেশিক ঋণের বোঝা এখন বস্তুতই অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছে গেছে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২০২৩ সালের জুনে যেখানে ছিল ৭ হাজার ৭৬ কোটি মার্কিন ডলার, সেখানে মাত্র ছ’মাসের ব্যবধানে একই বছরের ডিসেম্বরে তা প্রায় দেড় গুণ (৪৩ শতাংশ) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার। আর এসব ঋণের কিস্তি এখন ঋণ করে পরিশোধ করতে হচ্ছে (প্রথম আলো, ৫ এপ্রিল ২০২৪)। এমনি পরিস্থিতিতে নিছক আঞ্চলিকতার বোধ থেকে কিংবা ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিশেষকে সুবিধাদানের জন্য কিংবা রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে সম্ভাব্য দাতা দেশকে খুশি করার জন্য এ ধরনের ঋণ নেওয়া হলে শেষ পর্যন্ত নিজ দেশের জন্য তা বড় ধরনের বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে; যে আশঙ্কার কথা সরকারের দিক থেকে বারবারই অস্বীকার করা হচ্ছে। আমরাও চাই, সরকারের আশাবাদই সত্য হোক; কিন্তু অর্থমন্ত্রী কি দয়া করবে বলবেন, ১০ হাজার ৩৪ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণ বাংলাদেশ কোন কোন উৎস থেকে অর্থ নিয়ে তা পরিশোধ করবে? কিংবা নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী কি বলবেন, তাদের ইতঃপূর্বেকার সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের বিষয়টি অযৌক্তিক বলে প্রতীয়মান হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যেখানে এটিকে বাদ দেওয়া হয়েছিল, সেখানে এখন কোন বিবেচনায় এটাকে যৌক্তিক বলে প্রমাণের চেষ্টা করা হবে? আমাদের রাজনীতিকরা কি তাহলে এমনটিই মনে করছেন, ‘বৈদেশিক ঋণের এ বিপুল দেনা ভবিষ্যতে কে কীভাবে পরিশোধ করবেন, সেটি ভবিষ্যতে যারা দায়িত্বে থাকবেন তাদের ব্যাপার। আমাদের কাজ হচ্ছে লোকরঞ্জনবাদী কিছু প্রকল্প নিয়ে বর্তমানকে ঝলমলে দেখানো’! আর এ অবস্থাকেই সেতুমন্ত্রী বোধহয় বর্ণনা করেছেন, ‘পাবলিক যা খায়’ বলে।
সিদ্ধান্ত প্রণেতা রাজনীতিকদের ও রাষ্ট্রের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এ দেশের ধনীদের নাম যতই ফোর্বসের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় উঠে আসুক না কেন, এ দেশের সাধারণ মানুষ আসলেই খুব কষ্টে আছে। লুটেরা বিত্তবান কোটিপতির আয়ের সঙ্গে দিনমজুরের আয়ের গড় করে জনগণের মাথাপিছু আয়ের অঙ্ককে যত বড় করেই দেখানো হোক না কেন, তাতে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন ধারণের কষ্টের এতটুকুও লাঘব হচ্ছে না। তার ওপর আপনারা যখন বলেন, মানুষ খুব সুখে ও আনন্দে আছে, তখন আপনাদের সে অমৃত বচনগুলোকে উপহাস ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। ক্ষুধা ও পুষ্টিহীনতার কষ্ট শুকনো মুখ দেখে খানিকটা আঁচ করা যায়। কিন্তু উপহাসের কষ্ট শুধুই ভার জমায় বুকের ভেতর। আর সে কষ্ট বোঝার সামর্থ্য আপনাদের নেই। তবে আপনারা আপাতত দয়া করে কেবল এটুকু বুঝলেই কৃতজ্ঞ থাকব, কঠিন শর্তের স্বল্পমেয়াদি এসব ঋণের বোঝা বইবার সামর্থ্য এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির একেবারেই নেই। আর তা নেই বলেই অনুরূপ ঋণের অর্থে পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের মতো অলাভজনক প্রকল্প গ্রহণ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাই।
আবু তাহের খান : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)