Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বিচ্ছিন্ন করো না, যুক্ত করো

Icon

আফরোজা পারভীন

প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিচ্ছিন্ন করো না, যুক্ত করো

আমার এক লেখকবন্ধু প্রায়ই বলত, আধুনিক জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা এলিয়েনেশন বা বিচ্ছিন্নতা। সে আমাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছিল। বলেছিল, ধরো তোমার পরিবারটি বড়, যৌথ, চারপাশে অনেক লোকজন তোমার, কিন্তু তুমি মনে করছ না তোমার পাশে কেউ আছে, কেউ তোমার কথা ভাবছে। আসলে তুমি মনের দিক থেকে বিচ্ছিন্ন, অনেকের মধ্যে থেকেও একা। এ বিচ্ছিন্নতার কারণ চারপাশের লোকজন তোমাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না, তুমি প্রশ্ন করলে উত্তর দিচ্ছে না, নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, হাসাহাসি করছে, তুমি কিছু বললে এমন ভাব করছে যেন তুমি কিছুই জানো না, তোমাকে যেন ওরা দেখছেই না। অথচ যারা এসব করছে তারা সবাই তোমার নিজের। অন্য কেউ করলে তোমার খারাপ লাগত না হয়তো, কারণ তাদের সঙ্গে তোমার রক্তের সম্পর্ক নেই। এদের সঙ্গে আছে। তাই এদের কাছে তোমার এক্সপেকটেশন বেশি। কিন্তু এদেরও কাছ থেকেই তুমি যা চাচ্ছ, তা পাচ্ছ না। তাই আস্তে আস্তে সবার মধ্যে থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছ।

আমার বন্ধু বেশ কয়েক বছর হলো মারা গেছে। তার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে ছিল। বন্ধুবান্ধবও ছিল। জানি না সে বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত ছিল কিনা। সে যা চাইত, তা পেয়েছিল কিনা!

কেউ ইচ্ছা করে বিচ্ছিন্ন হয় না। পরিবেশ পরিস্থিতি তাকে বিচ্ছিন্ন করে। বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য খুব বেশি খারাপ ব্যবহার, গালাগাল বা মারধরের দরকার হয় না। নির্লিপ্ততা, নিস্পৃহতা, উপেক্ষাই যথেষ্ট। এগুলো শারীরিক পীড়নের চেয়ে বেশি পীড়ন করে। সেই পীড়ন থেকেই সৃষ্টি হয় বিচ্ছিন্নতা। নিঃসঙ্গতা আর বিচ্ছিন্নতা এক নয়। নিঃসঙ্গ মানুষের সঙ্গী থাকে না। তাই সে একা, সঙ্গীহীন। কিন্তু বিচ্ছিন্ন মানুষ সঙ্গী থাকার পরও একা।

বিচ্ছিন্নতা এক প্রবল মানসিক সমস্যা। যা কোনো কোনো মানুষকে মৃত্যু অবধি ঠেলে নিয়ে যায়। সম্প্রতি আমার ক্যাম্পাসে একটি ঘটনা ঘটেছে। এক ফ্ল্যাটে বয়স্ক মা, ছেলের বউ আর ছেলে থাকতেন। মধ্যরাতে ওপর থেকে কাপড় জড়ানো অবস্থায় মা পার্কিং স্পেসের ছাদে পড়ে যান। তিনি মৃত অবস্থায় পড়েছিলেন, না পড়ে মারা গিয়েছিলেন জানা যায়নি। ব্যাপারটা খুব নিঃশব্দে ঘটেছে। সাধারণত ক্যাম্পাসে কেউ মারা গেলে মাইকিং করে জানাজায় শরিক হতে বলা হয়। এক্ষেত্রে তা হয়নি। জানি না এটা আত্মহত্যা, না হত্যা। তবে জানি উপর থেকে নিচে পড়ার মতো কোনো স্পেস নেই। ছাদ তালাবদ্ধ থাকে। কী করে কোথা থেকে তিনি পড়লেন সেটা রহস্য। পরে শুনেছি ছেলে-বউমার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল না মহিলার। কোনো ছেলে বা বউ তাদের মাকে মেরে ফেলবে এতটা ভাবি না। তবে কি তার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল বিচ্ছিন্নতা? তাই তিনি নিজেকে সরিয়ে নিলেন! এক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে কিনা নিশ্চিন্ত না হলেও এমন ঘটনা কিন্তু ঘটে। কেউ নিজেকে শেষ করে দেন, কেউ ধুঁকে ধুঁকে মরেন। কেউ বিচ্ছিন্নতা থেকে নানারকম অসুখে আক্রান্ত হন। ভুলে যাওয়া অসুখ হয়। নিজের মানুষকেও চিনতে পারেন না অনেকে। কারণ তার অবচেতন মন এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে, সূক্ষ্ম স্নায়ুর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায়। যে তাকে অবজ্ঞা করে অবচেতন মন হয়তো তাকে চিনতে চায় না!

সাধারণত প্রবীণ এবং বয়স্ক মানুষরাই বেশি বিচ্ছিন্নতায় ভোগেন। সন্তানরা আস্তে আস্তে বড় হয়ে যায়। তাদের নিজের নিজের জগৎ তৈরি হয়। একসময় যে সন্তানদের মুখে তুলে খাওয়াতে হতো, হাত ধরে হাঁটাতে হতো, সাহায্য ছাড়া যারা নিজেকে পরিষ্কার পর্যন্ত করতে পারত না, তারা তখন নিজের পায়ে দাঁড়ায় শুধু না, দৌড়ায়। সত্যি কথা বলতে কী, প্রাণিজগতে মানুষের চেয়ে অসহায় কেউ নেই। অধিকাংশ পশুপাখি জন্মের অল্প সময়ের মধ্যে দাঁড়াতে, হাঁটতে উড়তে শেখে। মানুষই ব্যতিক্রম। তার নিজের কাজ নিজে করতে অনেক সময় লাগে। আর সেই বাচ্চাটাই যখন বড় হয়, তখন যার হাত ধরে, কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়াতে শেখে তার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে নির্লিপ্ত আচরণ করে। সে হয়তো সেটা বুঝতেও পারে না। কিন্তু বৃদ্ধ মা-বাবার মনে হয়, ছেলে তাকে বাহুল্য মনে করছে। এ থেকেই আসে বিচ্ছিন্নতা।

শুধু বয়স্ক আর প্রবীণরা বিচ্ছিন্নতায় ভোগেন এমন না, অনাদরে অবহেলায় বিভিন্ন বয়সের মানুষ বিচ্ছিন্ন হন। কেউ কেউ মাদকাসক্ত হন, কেউ অনৈতিক পথে চলে যান, এমনকি মস্তিষ্ক বিকৃতিও ঘটে অনেকের।

বেকার এবং অসফল মানুষও বিচ্ছিন্ন হন। পরিবার এবং সমাজের অবজ্ঞায় তারা নিজেদের গুটিয়ে নেন। অন্যরা তাদের নিচু চোখে দেখছে ভেবে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন তারা।

পৃথিবী এখন ডিজিটাল। দিন যত যাচ্ছে, নিত্য নতুন প্রযুক্তি আসছে। যার অনেক ব্যবহার প্রবীণরা জানে না। এমনিতেই তারা নতুন জেনারেশনের চেয়ে পিছিয়ে আছে। নানা কারণে সন্তানসন্ততির সাহায্য-সহায়তা তাদের দরকার হয়। যে সহায়তা আপনজনদের নিজ থেকে এগিয়ে এসে করার কথা সেটা যখন তারা করে না, উপরন্তু সাহায্য চাইলে এড়িয়ে যায়, তখন শুরু হয় বিচ্ছিন্নতা। বিধবা বা বিপত্নীক ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা আরও বেশি। কারণ শেয়ার করার মতো কেউ পাশে থাকে না।

বন্ধুহীনতা বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। আগের দিনের মানুষ ঘরে মন খারাপ হলে পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে যেত। তাদের সঙ্গে কথা বলে হালকা হতো। চিঠি লিখত, ডায়েরি লিখত। এখন পোস্ট অফিস নেই, চিঠি লেখার চল নেই। এখনকার চল হলো টেক্সট করার, যা অনেক প্রবীণ জানে না। মানুষ বড় ব্যস্ত। কথা বলার সময় তাদের নেই। এখন আর সে অর্থে প্রতিবেশীও নেই। পাড়া বেড়ানোর চল ওঠে গেছে। ‘পাড়া বেড়ানো’ শব্দটা বিলুপ্তির পথে। সোশালাইজেশনের অভাবে বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। বিচ্ছিন্নতা বাড়াচ্ছে অনলাইন কেনাকাটা। আগে হাটবাজারে যেত মানুষ। বিশেষ করে পরিবারের বয়স্ক লোকেরাই এ কাজটা করতেন। বাড়িবাড়ি ফেরিওয়ালা আসত, মেলা বসত। নারীরা সেখান থেকে জিনিস কিনতেন। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলতেন, দাম দর করতেন। ভালো সময় কেটে যেত। এখন সেসবের বালাই নেই। বেশির ভাগ প্রবীণ প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত নয় বলে কেনাকাটা নবীনরাই করেন। এ কাজটাও প্রবীণদের হাত থেকে চলে গেছে।

আত্মীয়তাও কমে গেছে এখন। বাধ্য না হলে কেউ কারও বাড়িতে যান না। সাধারণত বিয়ে এবং কুলখানি ছাড়া আত্মীয়স্বজনের দেখা হয় না। শীত, গ্রীষ্মে নানাবাড়ি-দাদাবাড়ি বেড়ানোও নেই। ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনির সুবাদে প্রবীণরা একসঙ্গে মিলিত হয়ে কিছুটা সময় কাটাবেন, সে সুযোগও নেই। এখন মানুষ বেড়াতে যায় বিদেশে। সেখানে হাঁটাচলার সমস্যা বলে বয়স্করা প্রায়ই বাদ পড়েন। তাহলে বিচ্ছিন্ন তো হবেনই।

বয়স্কদের সম্মান করার ব্যাপারটাও অনেক কম এখন। মুরুব্বিকে সালাম দেওয়া, কেউ এলে উঠে দাঁড়ানো, চেয়ার ছেড়ে দেওয়া, ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসা করার চল ওঠে গেছে প্রায়। তাই প্রবীণরা কোথাও যাওয়ার আগে দুবার ভাবেন। ভাবেন গেলে আবার অবাঞ্ছিত হবেন না তো। সিনেমা দেখতে যাওয়ার সময়, খেতে যাওয়ার সময় কোনো কোনো পরিবার প্রবীণদের বাদ দেন তাদের শরীর খারাপ বলে। অথচ সিনেমাটা দেখলেই হয়তো তাদের ভালো লাগত। সবার সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্যও একাত্ম ভাবত। নিজেকে ওদেরই একজন ভাবত।

সমাজ নেই, বন্ধু নেই, প্রতিবেশী নেই, বেড়ানোর জায়গা নেই, তাহলে এ মানুষগুলো যাবে কোথায়? পরিবারই তাদের শেষ ভরসা। সেই পরিবারই যদি তাদের প্রতি নিস্পৃহ হয়, তাহলে তারা বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য। সেটাই ঘটছে।

অনেকে বৃদ্ধাশ্রমের বিপক্ষে বলেন। আমি মনে করি, পরিবারে রেখে বিচ্ছিন্ন করে রাখার চেয়ে বৃদ্ধাশ্রম ভালো। কারণ সেখানে অন্য বৃদ্ধরা থাকেন। তাদের সমস্যাগুলো মোটামুটি একরকম। তাদের সঙ্গে শেয়ার করে কিছুটা অন্তত ভালো থাকতে পারেন। স্বাধীনভাবে থাকতে পারেন, সম্মানের সঙ্গে থাকতে পারেন।

পরিবারের কেউ যাতে বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত না হয়, সেজন্য পরিবারের লোকেরই সচেতন থাকা দরকার। দরকার সহমর্মিতা, ভালোবাসা। ভাবা দরকার এমন দিন সবার জীবনেই আসে। পরিক্রমা এক অব্যাহত প্রক্রিয়া। থামে না। আজ যে নবীন, কাল সে প্রবীণ। আজ যে যুক্ত, কাল সে বিযুক্ত। এ বিচ্ছিন্নতার ভাগ্য একদিন তাদেরও হতে পারে। কারণ, প্রকৃতি গুণে গুণে সব ফিরিয়ে দেয়।

আফরোজা পারভীন : কথাশিল্পী, গবেষক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম