আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে জোর দিতে হবে উৎপাদনে
মো. বশিরুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাজ্যে তাজা সবজির চরম সংকট দেখা দিয়েছে, এমন খবর আলোড়ন তুলেছিল। তবে, ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের বরাতে যে প্রতিবেদনের কথা বলা হয়েছিল, পরবর্তীকালে তারাই বলছে, এরকম কোনো প্রতিবেদন তারা ছাপেনি। হয়তো এ ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত থাকতে পারে। আসলে, যুক্তরাজ্যের এ ঘটনা উল্লেখের কারণ হচ্ছে দেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে এটিই আমার আলোচনার বিষয়বস্তু।
একবার ভাবুন, আপনার সঙ্গে অনেক টাকা। আদরের সন্তান আবদার করল বাজারে গিয়ে সে টাটকা শাকসবজি কিনে আনবে। সন্তানকে নিয়ে গেলেন বাজার করতে; কিন্তু একি! বাজারে গিয়ে দেখলেন কিছুই নেই। চাহিদামতো সবজি কিনতে পারছেন না। এমনকি মিলছে না তিনটির বেশি টমেটো। শুধু সবজিই নয়, আলু, পেঁয়াজ কিংবা ডিমেও দেখা দিয়েছে হাহাকার। বর্ণিত প্রেক্ষাপট কাল্পনিক বাস্তবতা। হয়তো সে দুর্দিন এখনো আমাদের আসেনি। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এমন পরিস্থিতি এসেও যেতে পারে। এখন বলি এতসব নাটকীয় প্রারম্ভিকতার কারণ কী।
এখন বৈশাখ মাস। প্রচণ্ড গরম। ফুলকপি বা বাঁধাকপির মতো সবজি এখন বাজারে দেখলে কেউ চমকে ওঠে না। কারণ, চলতি বছর শীত গেছে; কিন্তু বাজার থেকে যায়নি এ সবজিটি। টমেটোর নাম তো মৌসুমি সবজির খাতা থেকে উঠে গেছে গত কয়েক বছরে। কৃষিবিজ্ঞানীদের গবেষণা আর মাঠপর্যায়ে চাষিদের পরিশ্রম; সঙ্গে ঝুঁকি গ্রহণের ইচ্ছার সুফল এটি। তাপসহিষ্ণু শীতকালীন সবজির উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীরাই। এজন্য শীতের সবজি সারা বছর পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া রয়েছে কৃষিবিজ্ঞানীদের উচ্চফলনশীল ও প্রতিকূলতাসহিষ্ণু নতুন নতুন জাত আর প্রযুক্তির উদ্ভাবন; ফলে খাদ্যশস্য, সবজি ও ফল উৎপাদনে বৈচিত্র্য এসেছে। ফসল উৎপাদনে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে।
শুধু অগ্রগতিই হয়নি, আমরা বিশ্বে মাছ, আলু, পেঁয়াজ, শাকসবজিসহ ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে আছি শীর্ষ দশে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সরবরাহ বাড়লে ও পণ্য উদ্বৃত্ত হলে স্বাভাবিকভাবেই এসবের দাম কম হওয়ার কথা। স্বস্তি পাওয়ার কথা সাধারণ মানুষের। কিন্তু দৃশ্যত দেখা যাচ্ছে উৎপাদন বৃদ্ধি, সরবরাহ বৃদ্ধি ও উদ্বৃত্তের কোনো সুফল আমরা পাচ্ছি না। আমাদের সবচেয়ে উদ্বৃত্তের ফসল হচ্ছে আলু। উৎপাদন মৌসুম শেষ হতে না হতেই এবার আলুর বাজার চড়া, ভারত থেকেও আসছে আলু। তবুও ঈদের ছুটিতে সরবরাহ কমের অজুহাতে ফের চড়তে শুরু করেছে আলুর বাজার; খুচরায় প্রতি কেজির দাম উঠেছে ৬০ টাকা। পাশাপাশি সরবরাহ ঠিক থাকলেও খুচরা বাজারে পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে ক্রেতার এসব পণ্য কিনতে বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। তবে কি আমদানিকারক, পাইকারি ব্যবসায়ী, ফড়িয়া-দালাল ও খুচরা ব্যবসায়ীরা সব সুবিধা নিয়ে নিচ্ছে?
একসময় আমরা চাল, আলু রপ্তানির গল্প শুনতাম। আর এখন আমরা আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছি। এমন অবস্থায় চাল, গম, চিনি, তেল, আটা, রসুন, ডাল, পেঁয়াজ ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিপত্রের জন্য আমরাও আমদানিনির্ভর। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার গত ২৩ ডিসেম্বরের ঘোষণা অনুসারে বিশ্বে খাদ্য আমদানিতে বাংলাদেশ তৃতীয় শীর্ষ দেশ।
এটা ঠিক, কোনো একক দেশের পক্ষে সব প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন করা সম্ভব নয়। বাবা-দাদার মুখে শুনতাম স্বনির্ভর কৃষকের গল্প। সে স্বনির্ভর কৃষকও দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে-যিনি একসময় তার প্রয়োজনীয় সবকিছু নিজে উৎপাদন করতেন; দেশগুলোও তেমনি। তারা এখন আমদানি-রপ্তানি করে পরস্পরের প্রয়োজন মেটায়। এটা এমন এক বাস্তবতা, যুদ্ধের মধ্যেও বাণিজ্য চলে। ইউক্রেনে যুদ্ধ হচ্ছে; আবার সেখান থেকে পণ্যসামগ্রী রপ্তানি অব্যাহত আছে, বিশেষত কৃষিপণ্য। মূলত ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সরকার যে কোনো পণ্য আমদানি কিংবা রপ্তানি করে থাকে। যখন স্থানীয়ভাবে পণ্য উৎপাদনে ঘাটতি হয়, তখন সরবরাহ কমে আসায় সে পণ্যের মূল্য বাড়ে। তখন সরকার ভোক্তার স্বার্থে সে পণ্য আমদানি করে। আর অর্থনীতির সূত্রই হচ্ছে, পণ্যের সরবরাহ কমলে, দাম বাড়ে, আবার সরবরাহ বাড়লে, দাম কমে। কিন্তু আমদানির পরও যে তা দামের ওপর সবসময় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, সে কথাও বলা যাচ্ছে না।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর দেশে ১ কোটি ৪ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। দেশের চাহিদা ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন। অপরদিকে পেঁয়াজের উৎপাদন বছরে সাড়ে ছত্রিশ লাখ টন, চাহিদা ২৫ লাখ টন। সে ক্ষেত্রে আলু এবং পেঁয়াজের চাহিদা স্থানীয়ভাবে মিটিয়ে যাওয়ার কথা; কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আমদানি হচ্ছে। আমদানি করা হচ্ছে ভরা মৌসুমে। এ অবস্থায় আলু, পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করার ফলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অধ্যাপকের কাছ থেকে শুনেছি, জাপানে চালের দাম তুলনামূলকভাবে একটু বেশিই। চালের দামের ব্যাপারে সে দেশের একজন মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনারা বাইরে থেকে কম মূল্যে কেন চাল আমদানি করেন না ও কৃষকের কাছ থেকে অনেক বেশি মূল্যে ক্রয় করতে হচ্ছে কেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, বাইরে থেকে চাল আমদানি করলে অবশ্যই অনেক কমে চাল পাওয়া যাবে। তখন তাকে আবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাহলে কেন আমদানি করছেন না? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, আমাদের দেশের সবদিকে সমুদ্র। যুদ্ধসহ যে কোনো দুর্যোগে আমরা বিশ্ব থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারি, তখন তো আমরা বাইরে থেকে চাল আমদানি করতে পারব না। তাই আমাদের দেশের কৃষককে বাঁচাতে হবে ও যুদ্ধের কারণে যদি বহির্বিশ্ব থেকে জাপানে খাবার আমদানি বন্ধ হয়ে যায়, তখন কি আমরা টয়োটা গাড়ি খেয়ে থাকব?
উন্নয়নশীল বিশ্বের এমন অনেক দেশ আছে, যারা কেবল তাদের দেশের কৃষককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, তাদের কৃষি পেশা থেকে বিমুখ না হওয়ার জন্য নানাবিধ প্রণোদনা দিয়ে থাকে। কৃষক যেন সম্মানের সঙ্গে থাকতে পারে, সেজন্য তারা আমদানি পণ্যের সস্তা মূল্য পাওয়া সত্ত্বেও তা করে না। বাজার ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানোর জন্য প্রান্তিক কৃষকের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বাজারে এনে বিক্রি করার ব্যবস্থা করে দেয় সরকার। কৃষককে তার উৎপাদন, শ্রম আর লভ্যাংশের প্রাপ্যটুকু বুঝিয়ে দিয়ে, তবেই সে পণ্যের বাজার দর নির্ধারণ করে। এটা ঠিক, বর্তমানে কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কৃষি ঋণ, কৃষি প্রণোদনা, প্রশিক্ষণ, ফসল বিমাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকের সহায়তা প্রদান করছে। সেই সঙ্গে কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে এনজিও ও বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। তারপরও কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে তেমন কোনো পরিবর্তন আসছে না বলে আমি মনে করছি। এর কারণ হচ্ছে, কৃষক এসব সুবিধা ঠিকমতো পাচ্ছেন না। আর এ পেশাটাই তাদের কাছে অলাভজনক হয়ে উঠছে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সেই কাল্পনিক বাস্তবতার কথা। যেখানে কৃষি ও কৃষকের অস্থিত্ব বিলীন মানেই হলো আমাদেরই অস্থিত্ব সংকট। তাই বাজার চাহিদানুযায়ী, কৃষিপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও লাভজনক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে করণীয় বিষয়গুলো-প্রথমত, বাজার চাহিদা অনুযায়ী ফসল নির্বাচন করতে হবে। সেই সঙ্গে জমি ও আবহাওয়া নির্বাচিত ফসলের উপযোগী কিনা, তা অবশ্যই যাচাই করতে হবে। ফসল নির্বাচনে মাটির উর্বরতার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। এক্ষেত্রে মাটির উর্বরতা উন্নয়নে ফসল ধারায় একই ফসল বারবার চাষ না করে, শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে এবং বছরে জমিতে কমপক্ষে একটি শিমজাতীয় ফসল, যেমন ডালজাতীয় ফসল (মসুর, ছোলা, খেসারি, মুগ এবং মাষকলাই ইত্যাদি), শিম ও বাদাম চাষ করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো একটি ফসল চাষে বেশি লাভ হলে সবাই সেই ফসলের চাষ শুরু করেন; ফলে উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বাজারমূল্য কমে যায়। তখন সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ওই ফসল চাষ থেকে বিরত থাকে। ফলে, পরবর্তীকালে বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারমূল্য বেড়ে যায়। ফসল চাষে এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, কৃষককে তাদের ন্যায্যমূল্য দিতে হবে। ফসলের মাঠ কেটে পুকুর করা বন্ধ করতে হবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সব খাল ও নদী উদ্ধার করে সচল করতে হবে। মনে রাখতে হবে, কৃষিই বাংলাদেশের শেকড় এবং শেকড়কে ভুলে গেলে পতন অনিবার্য। আমদানিনির্ভর খাদ্যনীতি থেকে বের হতে প্রয়োজন কমপক্ষে ১০ বছরমেয়াদি উপযুক্ত পরিকল্পনা!
আসুন-কৃষি, কৃষক আর কৃষি পেশাকে দেখি এক অনন্য উচ্চতায়। কেননা, এ দেশের কৃষি আর কৃষক বাঁচলেই কেবল বেঁচে থাকতে পারব আমি, আপনি, আমরা সবাই। স্বপ্নে বোনা ফসলের খেতে রাগ-দুঃখ আর অভিমানে সেই স্বপ্ন নিজের হাতেই ভেঙে ফেলা সেই কৃষকের আর্তনাদ আমরা আর দেখতে চাই না। এ লজ্জা হবে আমাদের সবার, এ ব্যর্থতা এ জাতির প্রতিটি সন্তানের। ২০১৪ সালে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে ভারতীয় গরু আসা বন্ধ করে দেয়। আর সেটাই হয়েছে বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ। এখন বাংলাদেশ গবাদিপশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবি করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। আমি মনে করি, আমদানি কমিয়ে উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করা এখন সময়ে দাবি।
কৃষিবিদ মো. বশিরুল ইসলাম : উপ-পরিচালক, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
mbashirpro1986@gmail.com