নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের শহরেই আমাদের বাস
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
টাকা-পয়সা থাকলে ঢাকা শহর যে কত আরামদায়ক ও আনন্দের শহর, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ কথা আমরা যতটুকু বুঝি, তার চেয়ে বেশি বোঝে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। যারা দিনকে রাত করে ডলার কামাই করেন। সত্যিই তো ঢাকা শহর কী শুধু আরামের শহর, এ শহরের সুযোগ-সুবিধা বরং বেড়েই চলেছে। উদাহরণ দিই, কিছুদিন আগেও ২-৩ ঘণ্টা লাগত উত্তরা থেকে মতিঝিল আসতে। এখন ৩০ মিনিটও লাগে না। খরচও কম। আরাম-শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মেট্রো। একই অবস্থা শান্তিনগর, মতিঝিল থেকে গুলশানে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে। আগে লাগত এক থেকে দেড় ঘণ্টা যেতেই। এখন ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ হওয়ার ফলে কুড়িল-বসুন্ধরা সিটি থেকে শান্তিনগর-মতিঝিল আসা যায় ৩০-৪০ মিনিটে। আর দূর-দূরান্তের কথা যদি বলি তাহলে তো রয়েছে পদ্মা সেতুর কথা, রয়েছে ঢাকা-কক্সবাজার ট্রেনের কথা। কত সময় লাগত আগে যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল যেতে? আর এখন? ৩-৪ ঘণ্টা। কত কষ্ট ছিল সড়কপথে কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়া। এখন কমলাপুর ট্রেনে ওঠা, সকাল বেলা কক্সবাজার। মনে করলে সারা দিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরতি ট্রেনেই ঢাকায় আসা যাচ্ছে। এমনতর আরও কত উদাহরণ আছে। এসব দিয়ে বলাই যায় ঢাকা ‘তিলোত্তমা শহর’ না হোক, সুযোগ-সুবিধার শহর হয়ে উঠছে। আনন্দের জোগাড়ও এখানেই। স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষার সেবা, অবকাঠামোগত নানা সুবিধা এখানেই। খেয়ে-পরে আনন্দও এখানেই। মফস্বলে যা পাওয়া যায় না, তা পাওয়া যায় ঢাকায়। মফস্বলে জিনিসপত্রের যে দাম তার চেয়ে কম দামে জিনিসপত্র পাওয়া যায় ঢাকায়। নেত্রকোনায় মাছ নেই, কিশোরগঞ্জে মাছ নেই। ঢাকায় আছে। বোঝাতে চাইছি, ঢাকা শহর আনন্দের শহর, সুযোগ-সুবিধার শহর, স্কুলের শহর, ভোগের শহর। ব্যাস এটুকুই। দৃশ্যত তাই। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে আরেক খবর। কী সে খবর?
ঢাকা শহর, শহরের জীবন, নগরবাসীর জীবন এক অনিশ্চয়তার জীবন, নিরাপত্তাহীনতার শহর, ঝুঁকিপূর্ণ শহর, অসহায়ত্বের শহর। কারণ কী? কারণ এ শহরের বাসিন্দাদের অধিকাংশই শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষ, নিুবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ, চাকরিজীবী, বেসরকারি চাকরিজীবী মানুষ। এ শহরে বসবাস করে প্রচুর সংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত লোক। এদের জীবন এখন অনিশ্চয়তার জীবন। মূল্যস্ফীতি এদের তিলেতিলে মারছে। চাকরির নিশ্চয়তা নেই। চাকরিচ্যুতি নিত্যদিনের ঘটনা। বসবাসের ব্যবস্থা দিন দিন ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। আবাসন একটি বড় সমস্যা। বাসা ভাড়া বাড়ছেই, বাড়ছে। সঞ্চয়ের পরিমাণ দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। অথচ বেতন সেভাবে বাড়ে না, মজুরি সেভাবে বাড়ে না। শিক্ষা, পরিবহণ-যাতায়াত, স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় দিন দিন ঊর্ধ্বমুখী। বিদ্যুতের ব্যয় অসম্ভব। যেসব মধ্যবিত্তের ঋণের টাকায় গাড়ি আছে, তাদের তেল খরচ আবারও বেড়েছে। কী বোঝা যাচ্ছে? অনিশ্চয়তার শহর নয় কি? নিরাপত্তাহীনতার শহর নয় কি?
আগের দিনে বেসরকারি খাতের চাকরি ছিল সরকারি চাকরির মতোই নিশ্চিত চাকরি। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা, গ্র্যাচুইটির টাকা নিয়ে অবসর গ্রহণ করা যেত। মালিকরা কর্মচারীদের সুখ-দুঃখ বুঝত। অযথা কারও ‘পেটে লাথি’ মারত না। রাস্তায় ফেলে দিত না। নিশ্চিতভাবে ঘর-সংসার করা যেত। ছেলেমেয়ের শিক্ষা চলত। ছিল সঞ্চয়পত্র, যা থেকে নিরাপত্তার সঙ্গে সুদ পাওয়া যেত। একখণ্ড জমি পাকিস্তান আমলে কেনা যেত। তারপর স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে একটি ফ্ল্যাট কেনা যেত। শহরের ভালো এলাকায় কম পয়সায় বাসা ভাড়া পাওয়া যেত। বিদ্যুৎ, যাতায়াত, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় ছিল সহ্যসীমার মধ্যে। বলা যেত আমি চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করেছি। এখন সরকারি চাকরি ছাড়া এ কথা বলার কোনো সুযোগ আর নেই। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের পোষ্য, আদরের পোষ্য। বেসরকারি খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির কোনো নিরাপত্তা নেই। যে কোনো মুহূর্তে রাস্তায় বসিয়ে দিচ্ছে কর্মচারী-কর্মকর্তাদের। যেন আরেক আমেরিকা, যাকে আমরা দিনরাত গালাগাল করি। এখন সুবিধা অনেক। চিঠিও ধরাতে হয় না। কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে ওঠে খবর-‘কাল থেকে অফিসে আসবেন না।’ দাবি-দাওয়া, পাওনার খবর কী? কেউ জানে না। মামলা করা হবে? এর টাকা কোথায়? এমনও হচ্ছে, মধ্যবয়সে মধ্যবর্তী পর্যায়ের নির্বাহীরা চাকরিচ্যুত হয়ে দোকান দিচ্ছে-মুদি দোকান, ওষুধের দোকান। ফ্ল্যাট কিনে থাকলে তার কিস্তি দিতে পারছে না। ভাড়া বাসা হলে বাসা ছেড়ে যেতে হচ্ছে ‘ঘুপচিতে’, অথবা গ্রামে, মফস্বলে। ভোগ কমাতে হচ্ছে, তিন কেজি চিনির জায়গায় এক কেজি। ছেলেমেয়েদের স্কুল বদল করতে হচ্ছে। সঞ্চয় ভেঙে খেতে হচ্ছে। বাসায় বিদ্যুৎ খরচের টাকা নেই। রিকশা ছেড়ে পদব্রজে চলাফেরা করতে হচ্ছে।
এখন নতুন জগৎ। স্বপ্নভঙ্গের জগৎ। রাস্তায় বসে পড়া। অসম্ভব কষ্টের জীবন। এক জীবনের অর্ধেকের মধ্যেই উত্থান-পতন। অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা কুরে কুরে খাচ্ছে মধ্যবিত্ত, নিুবিত্তকে। এক কেজি পুঁটি মাছের দাম ৬০০-৮০০ টাকা। ৮০০-১০০০-১২০০ টাকা কেজির নিচে মাছ নেই। চৈত্র মাসেও লাউয়ের দাম ৫০-৬০ টাকা। মাংস খাওয়া, মাছ খাওয়া মানুষ ছেড়ে দিচ্ছে। অথচ গ্রামেও যেতে পারছে না। গ্রামে বিদ্যুৎ গেছে, অবকাঠামো হয়েছে। সেখানে যাদের জায়গা আছে, তাদেরও বাড়ি-ঘর করা, নির্মাণ করা, মেরামত করার জন্য লাখ-লাখ টাকা লাগে। জায়গা নিয়ে কিছু করা অসম্ভব বিষয়। লাখ লাখ নয়, কোটিতেও হয় না। অনিশ্চয়তা, হতাশা, রোগ-শোক, গৃহহীনতা এবং সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত জীবন। তাহলে কী দাঁড়াল? উন্নয়ন আছে, অবকাঠামো আছে, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সবই আছে, আছে বাজার। কিন্তু এসবের ধারেকাছে যাওয়ার উপায় নেই।
এমন কথা ছিল কি? নিশ্চিতভাবেই না। মুক্তিযুদ্ধের কথা ছিল-সবার জন্য ভাত-কাপড়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, কর্মসংস্থান, স্থিতিশীল মূল্য পরিস্থিতি। বৈষম্যহীন সমাজ ছিল আমাদের সবার কাম্য। এর জন্যই তো এতবড় সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ-নয় মাসের যুদ্ধ। কিন্তু আজ কী দেখতে পাচ্ছি? পরিষ্কার বাংলাদেশ দুভাগে বিভক্ত। গরিবের বাংলাদেশ, মধ্যবিত্তের বাংলাদেশ; বিপরীতে ধনী, অতিধনীদের বাংলাদেশ। গরিবের বাংলাদেশ, মধ্যবিত্তের বাংলাদেশ, অবসরপ্রাপ্তদের বাংলাদেশ এক অনিশ্চয়তার বাংলাদেশ, নিরাপত্তাহীন বাংলাদেশ, ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশ। দেখা যায় স্পষ্টতই কেউ এদেশে থাকতে চায় না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশিরা যেতে চায় ইউরোপে। মধ্যবিত্ত যেতে চায় ইউরোপে, আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায়। আর ধনী, অতিধনীরা চলে যাচ্ছে দুবাই, মালয়েশিয়া, কেম্যান আইল্যান্ড, ভার্জিন আইল্যান্ড ইত্যাদি ‘নিষ্কর’ দেশে। এই দেশ কি আমরা চেয়েছিলাম? বলাই বাহুল্য মূল ‘কালপ্রিট’ হচ্ছে বেতন-ভাতা-মজুরি বা অর্থ সংকট। যে হারে মল্যস্ফীতি ঘটছে, সে হারে মজুরি, বেতন, ভাতা বাড়ছে না। ২০২৪ সালের মার্চেই মজুরি বেড়েছে ৭ দশমিক ৮০ শতাংশ হারে। আর মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ হারে। এ হিসাব বাংলাদেশ ব্যুরো অফ স্ট্যাটিস্টিক্সের (বিবিএস)। প্রকৃত অবস্থা আরও খারাপ। এটা ঘটে চলেছে বছরের পর বছর ধরে। প্রাক-স্বাধীনতাকালের সঙ্গে বর্তমান অবস্থার তুলনা করলে ভয়াবহ চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ৫০০-৫৫০ টাকায় যে সংসার চলত প্রাক-স্বাধীনতাকালে, আজ তা লাখ টাকাতেও সম্ভব নয়। অথচ মানুষের আয় তো সেভাবে বাড়েনি। তখন চাকরিজীবীরা খরচ শেষে মাঝে মাঝে কিছু সোনা কিনতে পারত-ছেলেমেয়েদের বিয়ে-শাদির জন্য। টাকা লাগত ১০০ টাকার মতো। আজ সে সোনার দাম এক লাখ ২০ হাজার টাকা তোলা। ভাবা যায়! মধ্যবিত্ত কি ওই বাজারে যেতে পারে? না, তবে অনেকে যায়। এরা কারা? এরা যে দুর্নীতিগ্রস্ত লোক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হতে পারে অতিলোভী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। সিন্ডিকেটওয়ালা, হুন্ডিওয়ালা, চোরাচালানি, মধ্যস্বত্বভোগীরা সব দখল করে নিচ্ছে। বৈষম্য উঠছে চরমে। ঢাকার চারদিকে খালি রিসোর্ট আর রিসোর্ট। কারা এর মালিক? তাদের ওই টাকা কোত্থেকে এলো? কারা সেখানে বেড়াতে যায়? কেউ কি তার হিসাব রাখে? ঢাকার আশপাশের প্রায় সব সরকারি সম্পত্তি, নদী-নালা, খাল-বিল কারা দখল করেছে? সেগুনবাগিচা, পুরানা পল্টন, শান্তিনগর, বেইলি রোড, সিদ্ধেশ্বরীতে সরকারি জমি, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, শত্রু সম্পত্তি দখল করে কারা ফ্ল্যাট বাড়ি বানিয়ে বিক্রি করেছে? সবাই জানে ওইসব ফ্ল্যাটের বেচাকেনা নেই। খাজনা নেয় না সরকার। অসহায় মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবী।
পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে উন্নয়ন, আগ্রাসী বাজার অর্থনীতি একশ্রেণির লোককে সিঙ্গাপুরের শ্রেষ্ঠ ধনী করেছে, আর লাখ লাখ মধ্যবিত্ত, কোটি কোটি সাধারণ মানুষকে করেছে অসহায়, নিরাপত্তাহীন। তাদের জীবন হয়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ। পুরো সমাজ দখল করে নিয়েছে ‘মধ্যস্বত্বভোগীরা’, সিন্ডিকেটের মালিকরা, চোরাচালানি, হুন্ডিওয়ালারা। এ দোর্দণ্ড প্রতাপ চক্রের হাতে আমরা আজ অসহায় জাতিতে পরিণত হয়েছি। অনিশ্চয়তায় ভরপুর আমাদের জীবন। স্বপ্ন দেখার মতো কিছু নেই। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা বলার কিছু নেই। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে আমরা এখন দ্বিধাগ্রস্ত। আমরা নিজেরাই আদর্শচ্যুত। অথচ প্রতি মুহূর্তে হাজার রকম আদর্শের কথা আমরা বলছি। এ পরিস্থিতি থেকে বাঁচার কোনো পথ আছে কি? যার সঙ্গেই কথা হয়, তাকেই হতাশা ব্যক্ত করতে দেখি/শুনি। তবু কিছু আশা রাখতে চাই। কারণ নইলে মৃত্যু, অসুখ-বিসুখ! আমাদের অবিলম্বে আগ্রাসী বাজার অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকারি খরচ কমাতে হবে, সরকারি খরচের গুণগতমান বৃদ্ধি করতে হবে। ধনী, অতিধনীদের ‘ট্যাক্স’ করতে হবে।। ‘শিশু শিল্পের’ আওতা কমাতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে খরচ বাড়াতে হবে। বাজেটের আকার ছোট করতে হবে। ঋণের পরিমাণ কমাতে হবে। ঋণখেলাপিদের বিচার আগে, পরে হবে ‘ব্যাংক-মার্জার’। আরও অনেক পথ আছে-ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়