Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

সরকারি ব্যয়ের গুণগত দিকগুলো আলোচিত হোক

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সরকারি ব্যয়ের গুণগত দিকগুলো আলোচিত হোক

আমরা ছোটবেলায় ‘মচ্ছব’ খেতে যেতাম। ‘মচ্ছব’ মানে মহাউৎসব। সাধারণত এর আয়োজন হতো শীতকালে যখন ফসল উঠত, বাজারে থাকত শাকসবজি। ‘মচ্ছবের’ আয়োজক বর্ণাঢ্য পরিবার। ওই উৎসবে শত শত লোক আহার গ্রহণ করত। এতে থাকতেন হিন্দু-মুসলমান উভয়ই। ছিল আলাদা আলাদা ব্যবস্থা। মহাআনন্দে স্বাদের নিরামিষ রান্না খেতাম, পাচকরা সাধারণত উড়িয়া। অপূর্ব ছিল তাদের রান্নাকৃত খাবারের স্বাদ। আজকাল গ্রামে গ্রামে এসব অনুষ্ঠান আছে কিনা বলতে পারব না। তবে শহরে শহরে আছে। শহরে এই ‘মচ্ছব’ হচ্ছে ঠিকাদারদের (কনট্রাক্টর) ‘মচ্ছব’। তারা চুপ থাকে সারা বছর। জাগ্রত হয় মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন মাসে। এ মাসগুলো আমাদের অর্থবছরের (জুলাই-জুন) শেষ চার মাস। চার মাসে তারা ‘মচ্ছব’ আকারে যে কাজ করে, তা সারা বছরেও হয় না। এই ‘মচ্ছবের’ আয়োজক বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। তারা ‘উন্নয়নের’ কাজ করান কনট্রাক্টরদের দিয়ে। উন্নয়ন মানে ‘ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’। প্রতিবছর শত শত প্রকল্প থাকে, যেসব কাজ সমাপ্ত করতে হয়। এর জন্য বাজেট আছে, বাজেট বরাদ্দ আছে। পরিকল্পনা কমিশন, এর বাস্তবায়ন ইউনিট, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সবাই এর সঙ্গে জড়িত। সবার জন্যই এই ‘মহাউৎসব’। মহাআনন্দের উৎসব। তবে ভাত-সবজি খাওয়ার উৎসব নয়। উৎসব টাকা বানানোর। উৎসব অল্প সময়ে বিশাল টাকার মালিক হওয়া। সবাই মিলেঝুলে খাওয়া আর কী! উপলক্ষ্য কোনো ধর্মীয় উৎসব নয়, নয় কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানও। উপলক্ষ্য হচ্ছে অবকাঠামোর উন্নয়ন, অবকাঠামোর নির্মাণ। এটা এক বিশাল যজ্ঞ। প্রতিবছর দুই লাখ, আড়াই লাখ টাকার ‘খরচের’ উৎসব। যেমন-২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ উন্নয়ন মচ্ছবে ব্যয় কত হবে জানেন? খরচ হবে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। তাও উন্নয়ন বাজেটের আকার কাটছাঁট করার পর। আগে ছিল মূল বরাদ্দ ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। শিক্ষা-স্বাস্থ্যে বেশি বেশি কাটছাঁট করেই ২০২৩-২৪ অর্থবছরে খরচ হবে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এর আলামত দেখা যাচ্ছে এখন রাস্তায়।

এই যেমন শান্তিনগর এলাকায় রাস্তা কাটা হচ্ছে মেশিন দিয়ে। অনেক রাস্তা। সুবিধা অনেক। শ্রমিক লাগে কম। মেশিনের সঙ্গে শ্রমিকের ঝগড়া। শ্রমিকের কাজ করে দিচ্ছে মেশিন। অল্প সময়, খরচ কম কিনা জানি না। এ রাস্তা খেঁড়াখুঁড়ি, তাও মার্চ থেকে জুনের মধ্যে এটা নিত্যদিনের ঘটনা। সারা বছর খবর থাকে না। বাজেটের টাকা পড়ে আছে, ফেরত চলে যাবে। তাড়াতাড়ি খরচ করো উন্নয়নের টাকা। তা না হলে টাকা ফেরত চলে যাবে। তা কী করে হয়! জলদি, তাড়াতাড়ি রাস্তা খনন করো, যা যা করার করো। বছরের কাজ তিন মাসে করো। এটা আমার নিজের কথা নয়। সরকারি তথ্যে গেলেই এর সত্যতা মিলবে। দেখা যাবে ৮-৯ মাসে উন্নয়ন প্রকল্পের (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) কাজ হয় বড়জোর ৩০-৪০ মাসে। দেখা যায় অর্থবছরের শেষ তিন-চার মাসে কাজ হয় ৬০-৭০ শতাংশ। জিন-পরিরা কাজ করে দিয়ে যায়। যেমন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মার্চের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির কাজ হয়েছে ৪২ শতাংশ। ২০১৯-২০ থেকে শুরু করে ২০২৩ পর্যন্তও একই চিত্র। কিন্তু বছর শেষে দেখা যায় উন্নয়নকর্ম সূচিত কাজ শেষ হয়েছে ৯০-৯৫ শতাংশ। যেমন ২০২১-২২ অর্থবছর ‘এডিপি’ বাস্তবায়নের হার ছিল ৯৩ শতাংশ। তার মানে বছরের ৯ মাসে কাজ হয়েছে ৪৫ শতাংশ, আর তিন মাসে হয়েছে ৪৮ শতাংশ। বলা যায় ম্যাজিক পারফরম্যান্স। বলাই বাহুল্য, প্রতিবছরই এটা ঘটে। এর কারণ কী? কারণ অনেক। এসব কারণ বহুল আলোচিত, বহুল চর্চিত। কিন্তু এর কোনো সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না আজ ৫০-৫২ বছরেও। এটা কি আমাদের ব্যর্থতা, না ইচ্ছাকৃত গাফিলতি? বলা হয় জুলাই মাসে বাজেট শুরু হয়। বরাদ্দের টাকা তারপর মন্ত্রণালয়ে যায়। মন্ত্রণালয় প্রকল্প তৈরি করে, প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়। টেন্ডার দেয়, রি-টেন্ডার হয় কখনো কখনো। কাজের অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব করতে করতে এবং আরও জটিল সব প্রক্রিয়া শেষ করতে লেগে যায় ৮-৯ মাস। বসে থাকা আর কী? যেই এসব প্রক্রিয়া শেষ হলো, তখন ঠিকাদাররা ‘মচ্ছবে’ লেগে যায়। কাজ শেষ করতে পারে না। কিন্তু বাস্তবায়নের সার্টিফিকেট (প্রজেক্ট কমপ্লিশন) নিয়ে ঠিকাদাররা সব টাকা তুলে নেয়। ইত্যবসরে মানুষের ভোগান্তি যা হওয়ার হয়। এক মাসের কাজ দুই মাসে হয়।

আবার অনেক কাজ আছে যা শেষ করতে ঠিকাদাররা মাসের পর মাস সময় নেয়। মার্চ গরমের মাস। এপ্রিল, মে ও জুনে বৃষ্টি আসে। কাজ শেষ করতে লেগে যায় দীর্ঘ সময়। কিছুই করার নেই। মানুষের ভোগান্তি, আর ঠিকাদারদের টাকা বানানোর উৎসব ‘মচ্ছব’। শুধু ঠিকাদার বলি কেন, সংশ্লিষ্ট সবারই ‘মচ্ছব’। কথা হচ্ছে, অনেক দিন ধরে এ ‘মচ্ছবে’ বিরতি আনা যায় কিনা। কিন্তু না, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। একবার প্রয়াত অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব বলেছিলেন, তিনি অর্থবছরের গণনা পুনর্বিবেচনা করবেন। এবং তা এমনভাবে করবেন, যাতে বর্ষাকাল আমাদের উন্নয়ন কাজে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি করতে না পারে। বর্ষাকাল অর্থাৎ মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই এ সময়টা কাজে কোনো অগ্রগতি হয় না। অথচ ওই সময়েই সব প্রক্রিয়া শেষ করে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে হাত দিতে হয়। এ প্রসঙ্গে প্রতিবেশী দেশের কথা এসেছিল। তাদের অর্থবছর শুরু হয় এপ্রিল মাসে, শেষ হয় মার্চ মাসে। অর্থাৎ কাজের সময় আসতে আসতে তখন আবহাওয়া অনুকূল থাকে।

না, এ ব্যাপারে আর কোনো আলোচনা হয়নি। অথচ বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা দরকার। কারণ আমাদের বহুবিধ ‘বৎসর’। ‘আর্থিক বছর’, ‘ক্যালেন্ডার বছর’ এবং বিভিন্ন কোম্পানির অনুসৃত যার যার নিজস্ব বছর। যেমন সরকারের রাজস্ব বছর ‘জুলাই-জুন’। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক বছরও তা-ই। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অর্থবছর ক্যালেন্ডার বছর-জানুয়ারি-ডিসেম্বর। এতে কি অসুবিধা হয় না? পরিসংখ্যান মেলাতে, তুলনা করতে বেশ বেগ পেতে হয়। কী অসুবিধা বিষয়টি নিয়ে ভাবার? জানি না। কোনো পরিবর্তনই আমাদের আকৃষ্ট করে না। পুরোনো নিয়েই আমাদের আনন্দ। যেমন সাপ্তাহিক ছুটি বহুদিন ছিল রোববার। করা হলো শুক্রবার। তারপর সাপ্তাহিক ছুটি হলো দুদিন-শুক্র ও শনিবার। তখন কী আপত্তি! বলা হচ্ছিল আমাদের ছুটি শুক্র ও শনিবার। পশ্চিমা ক্রেতাদের ছুটি রোববার। তিন দিনের প্যাঁচে আমদানি-রপ্তানি বিঘ্নিত হবে। ভীষণ আপত্তি ব্যবসায়ীদের, ব্যাংকারদের। তাদের ‘ঋণপত্র’ (এলসি) খুলতে অসুবিধা হবে। আজ কী মনে হয়? আজ কি কেউ কোনো আপত্তি করে? দুদিন ছুটিতে কি আমদানি-রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? না, ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বরং এসব বৃদ্ধি পেয়েছে-বৃদ্ধি পেয়েছে প্রশংসনীয়ভাবে। তখন এও বলা হয়েছিল দুদিন ছুটিতে অফিস-আদালতে কর্মদক্ষতা হ্রাস পাবে। উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাবে। কী মনে হয় এখন? উৎপাদনশীলতা বরং বেড়েছে। আজকাল বরং ইউরোপের অনেক দেশের কোম্পানিগুলো চার দিনের অফিস করেছে। এতে তাদের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে। কর্মচারী, কর্মকর্তারা বাসায় সময় দিতে পারছে। পরিবারের দিকে নজর দিতে পারছে। ‘টেনশন’ হ্রাস পাচ্ছে। কাজে সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পেয়েছে। অতএব, বলাই যায় পরিবর্তন দরকার। পরিবর্তনের জন্য বিচার-বিবেচনা শুরু করা দরকার। তা হবে কি? জানি না।

আরেকটি বিষয় বলে আজকের নিবন্ধ শেষ করব। বিষয়টি হচ্ছে সরকারি খরচের গুণগত দিক। আমাদের উন্নয়ন ব্যয়ে যে অপচয়, চুরি, দুর্নীতি হচ্ছে, সে সম্পর্কে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম একবার বলেছিলেন, ‘একজন দুর্নীতি করে বেশি মুনাফা, সুযোগ-সুবিধা নেবে, রাস্তায় অর্ধেক কাজ করে টাকা নিয়ে যাবে, দুর্নীতির কারণে আমি আমার প্রাপ্য পাচ্ছি না’-এ বিষয়গুলো কেন সংসদে সোচ্চার কণ্ঠে শুনতে পাই না, তা বুঝতে পারি না। একই ধরনের উক্তি সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বহুবার বহু উপলক্ষ্যে করেছেন। তিনি উন্নয়ন প্রকল্পে ‘গুচ্ছ দুর্নীতি’ হয় বলে উল্লেখ করেছিলেন। আরও বলেছিলেন এত টাকা আমাদের পূর্বপুরুষরাও দেখেনি। কাজেই মাথা গরমের মতো অবস্থা। এসব উক্তি শুধু তারা দুজনেই করেননি। সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল মজুমদার, প্রয়াত অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেবও বহুবার করেছেন।

এসব উল্লেখ করার কারণ একটিই। বোঝানো যে ‘উন্নয়ন প্রকল্পে’র খরচ নিয়ে দেশে ‘মচ্ছব’ হচ্ছে বহুদিন থেকে। এটা কোনো বিশেষ সরকারের ঘটনা নয়। এটা ঘটছে সরকার নির্বিশেষে। বাড়ছে দিন দিন। অথচ এ নিয়ে আমাদের আলোচনা-বিতর্ক হচ্ছে সীমিত আকারে। এ মুহূর্তে আমাদের আলোচনা ব্যাংকিং এবং ঋণখেলাপির সমস্যা নিয়ে। কোনো সন্দেহ নেই, এ সমস্যা তীব্র ও জটিল। কিন্তু এ সমস্যার ওপর আলোচনার কারণে উন্নয়ন প্রকল্পে লুটপাটের আলোচনা কার্পেটের নিচে চাপা পড়বে কেন? পড়া উচিত নয়। হিসাব দেই একটা। ব্যাংক খাতে মোট বকেয়া, মানে প্রদত্ত ঋণের পরিমাণ মোটামুটি ১৫ লাখ কোটি টাকা। এর কত শতাংশ ‘খেলাপি ঋণ’? সরকারি হিসাবে ১০ শতাংশ। কিন্তু অনেকেরই এ পরিসংখ্যানে আস্থা নেই। তাদের ধারণা, এটা কমপক্ষে ২০-২৫ শতাংশ হবে। আচ্ছা ধরে নিই তা ২৫ শতাংশ। তাহলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪ লাখ কোটি টাকার নিচে। বিশাল পরিমাণ টাকা। কিন্তু তা ৫০-৫২ বছর ব্যাংকিং ব্যবসা করার পর। তবে খেলাপি ঋণের বিপরীতে মামলা আছে। আসা যাক উন্নয়ন বাজেটে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দ হচ্ছে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এখন প্রশ্ন, এ টাকার কত অংশ খরচ হয়, কত অংশ দুর্নীতির কবলে? তার হিসাব আমাদের কাছে নেই। যদি ২৫ শতাংশ টাকা দুর্নীতি খেয়ে ফেলে বলে ধরে নিই, তাহলে এর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। একই পরিমাণ টাকার অপচয়/দুর্নীতি হয় রাজস্ব বাজেটে। দুইয়ে মিলে কত টাকা হয়? আর ৫০-৫২ বছরের হিসাব ধরলে উন্নয়ন ও রাজস্ব বাজেটের কত টাকা দুর্নীতিগ্রস্তদের হস্তগত হয়েছে? নিশ্চিতভাবে খেলাপি ঋণের চেয়ে কম হবে। অথচ খেলাপি ঋণের বিপরীতে ‘মামলা/দাবি’ আছে। উন্নয়ন ও রাজস্ব বাজেটের চুরির টাকার বিপরীতে কোনো ‘মামলা মোকদ্দমা’ নেই। তাহলে কী দাঁড়াল? সরকারি ব্যয়ের গুণগত দিক নিয়ে কি অধিকতর আলোচনা/বিতর্ক দরকার নয়?

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম