অগ্নি সতর্কতা হোক সারা বছরের এজেন্ডা
সালাহ্উদ্দিন নাগরী
প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো স্থাপনায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।
সবশেষ গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে আগুন লেগে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে কার্ডিয়াক বিভাগের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ)। সৌভাগ্যবশত এ ঘটনায় কেউ প্রাণ হারায়নি।
তবে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী হিসাবে এখনো দাঁড়িয়ে আছে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনটি। মনে হচ্ছে, এটি বিদ্রুপের হাসি দিয়ে আমাদের আইন অমান্যতা ও অতি লোভকে কটাক্ষ করে যাচ্ছে।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী মানুষ এখনো ভবনটির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকেন। কেউ কেউ আবার বিড় বিড় করে কী যেন বলেন।
কেউ আবার যানবাহন থামিয়ে একটু দাঁড়িয়ে চোখ মোছেন, আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুলে মোনাজাত করেন। উল্লেখ্য, এই বহুতল ভবনের আগুনে ৪৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়, যা এখনো আমাদের স্মৃতিতে ঘুরেফিরে আসে।
দেশের বিভিন্ন আবাসিক, বাণিজ্যিক ও অন্যান্য স্থাপনায় আগুন লেগে জানমাল ও সহায়-সম্পত্তির ক্ষতির তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে ঘরবাড়ি তৈরিতে আগে খড়, কাঠ, বাঁশের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে আগুন লাগত বেশি। কোনো এলাকায় আগুন লাগলে মহল্লার পর মহল্লা পুড়ে ছারখার হয়ে যেত। তখন ফায়ার ব্রিগেড ছিল না।
বালতি দিয়ে পানি ছুঁড়ে আগুন নেভানো হতো। এখন মফস্বলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কমেছে, শহরে বেড়েছে। ২০১০ সালের ৩ জুন রাতে পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক গুদাম থেকে ছড়ানো আগুনে ১২০ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় রাসায়নিক গুদামের আগুনে প্রাণ হারায় ৭১ জন। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন লেগে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু কথা হলো, এর পরও কি আমরা সতর্ক হয়েছি বা হচ্ছি?
গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটি সবসময় আলো ঝলমল করত। আটতলা এ ভবনটির অনুমতি ছিল বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের। কিন্তু রেস্তোরাঁ করার কোনো অনুমতি না থাকার পরও সেখানে ১৪টি রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকান ছিল। ভবনের তৃতীয় তলা ছাড়া অন্য সব তলাতেই ছিল রেস্তোরাঁ। হরেকরকম খাবারের পসরা সাজতো এ ভবনের রেস্তোরাঁগুলোয়।
দুপুর থেকে মধ্যরাত অব্দি হাজারো মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকত ভবনটি। ছোট দুটি লিফট দিয়ে সবার চলাচল ছিল এ ভবনে। একটি সংকীর্ণ সিঁড়ি থাকলেও তা ওঠানামার জন্য ব্যবহৃত হতো না। রান্নার কাজে ব্যবহৃত ঢাউস ঢাউস গ্যাস সিলিন্ডার ও অন্যান্য জিনিসপত্রে ঠাসা ছিল পুরো সিঁড়ি।
প্রকৃতপক্ষে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার সহজ, স্বাভাবিক ব্যবস্থা না থাকায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ভবনে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল না, যার ফলে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই নেভানোর কার্যক্রম শুরু করা যায়নি।
দাহ্য উপকরণ দিয়ে দোকানপাট ও রেস্তোরাঁর ডেকোরেশন এবং বড় বড় গ্যাস সিলিন্ডারের কারণে আগুন দ্রুত বিভিন্ন তলায় ছড়িয়ে পড়ে। মৃত ব্যক্তিদের শরীর আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়নি, এমনকি শরীরে পোড়া দাগও কম ছিল। প্রচণ্ড গরম ধোঁয়ায় শ্বাসনালী পুড়ে এবং অক্সিজেনের অভাবে দম বন্ধ হয়ে প্রায় সবাই মৃত্যুবরণ করেছেন।
ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে আগুন লাগার কারণ ও প্রতিকারের বিষয়টি বহুল আলোচিত। শহরাঞ্চলে বিভিন্ন স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণের অনুমোদনের সঙ্গে রাজউক, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, পিডব্লিউডি, সিডিএ, আরডিএ এবং আরও যেসব সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান জড়িত, তাদের আরও সতর্ক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে অগ্নিদুর্ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। স্থাপনা নির্মাণে যেসব শর্ত পালন করতে হয়, এর সবকিছুই ইমারত নির্মাণ নীতিমালায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। কিন্তু সেগুলো যথাযথভাবে প্রতিপালন না করায় ধারাবাহিকভাবে শুধু অগ্নিকাণ্ড বা স্থাপনা ধসে পড়াই নয়, আরও অনেক ধরনের বিপদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমাদের।
বহুতল ভবনের নকশা অনুমোদনে রাজউক কর্তৃক ফায়ার সার্ভিসের ক্লিয়ারেন্স প্রয়োজন হয়। ফায়ার সার্ভিসের আইন অনুযায়ী অন্যূন সাত তলার উপর যে কোনো ভবনই বহুতল। আর রাজউকের আইন অনুযায়ী ১০ তলা বা তদূর্ধ্ব ভবন বহুতল। ফলে রাজউক ১০ তলার নিচের ভবনের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র চায় না।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে এই ভবনগুলো ‘অনুমোদিত অগ্নিনিরাপত্তা’ ব্যবস্থা ছাড়াই গড়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর শতকরা ৯৫ ভাগ ভবনেরই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ঠিক নেই। বিগত কয়েক বছরে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি, যা মোট অগ্নিদুর্ঘটনার প্রায় ৩৭ শতাংশ। ভবন নির্মাণের সময় অগ্নিনির্বাপণের বিধানগুলো মানা হচ্ছে কিনা, তা যাচাই ও তদারকি যথাযথভাবে করা হয় না।
লক্ষ করা যায়, কোনো একটি বড় অগ্নিকাণ্ডের পর ভবিষ্যতে অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধের তোড়জোড় চলে, নেওয়া হয় নানা উদ্যোগ। কিন্তু কদিন পরই সব উদ্যোগ স্তিমিত হয়ে পড়ে। বস্তুত এ কারণেই দেশে অগ্নিদুর্ঘটনা কমছে না, বরং বাড়ছে। তাই আমরা মনে করি, অগ্নি সতর্কতার বিষয়টি সারা বছরই জারি রাখা উচিত। আরেকটি অগ্নিকাণ্ডের অপেক্ষায় থাকা উচিত নয়।
অতীতে যা হওয়ার হয়েছে, অন্তত এখন থেকে আমরা কি পরিকল্পনামাফিক একেকটি অঞ্চল গড়ে তুলতে পারি না? আমাদের শহরগুলোতে আবাসিক, বাণিজ্যিক, দাপ্তরিক, শিক্ষা ও অন্য নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। একটির গা ঘেঁষে আরেকটি স্থাপনা গড়ে উঠেছে। সরু, অন্ধকার, নোংরা, স্যাঁতসেঁতে সিঁড়ি বেয়ে মানুষকে ওঠানামা করতে হয়।
অনেক ভবনের সিঁড়িতে এবং কোনো কোনো কক্ষে সূর্যের আলোর দেখা পাওয়া যায় না। উঁচু অনেক ভবনে একটিমাত্র সিঁড়ি রাখা হয়েছে। একটি সিঁড়ি দিয়ে কখনোই ঝুঁকি মোকাবিলা করা যায় না। যদি সিঁড়ির দিকেই কোনো বিপদ ঘটে, তাহলে মানুষের বের হওয়ার কোনো বিকল্প পথই থাকবে না। প্রত্যেক বহুতল স্থাপনায় মানসম্পন্ন একাধিক সিঁড়ির ব্যবস্থা রাখতে হবে। সিঁড়ির কোনো অংশকে কখনোই ময়লা-আবর্জনা রাখার জায়গা বা স্টোর রুমে পরিণত করা যাবে না।
অবাক করার বিষয় হলো, অনেক ভবন বা স্থাপনার নিচের তলায় রয়েছে গ্রিল তৈরির কারখানা, দোতলায় কমিউনিটি হল, তিন তলায় খাওয়ার দোকান, চার তলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাঁচ তলায় অফিস, ছয় তলায় আবাসিক ফ্ল্যাট। কোনো পরিকল্পিত নগরীতে এত বিচিত্র উদ্দেশ্য সংবলিত কাঠামো থাকার কথা নয়। বাণিজ্যিক ভবনগুলোর ভেতরের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়, একেকটা ফ্লোরকে পার্টিশন দিয়ে বানানো ছোট ছোট খুপরিতেই কর্মজীবীদের সারাদিন কাটাতে হয়।
বৈদ্যুতিক সামগ্রীর ব্যবহার যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার, সুইচ ও অন্যান্য সরঞ্জাম টেকসই হয় না এবং এগুলোয় দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেশি। ফলে একটু হেরফের হলেই শর্টসার্কিট থেকে বড় বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। কোথাও কোথাও মেয়াদোত্তীর্ণ ফায়ার এক্সিটিংগুইশার রিফিলই করা হয় না, অনর্থক শুধু দেওয়ালে শোভা পায়।
ভবনের ধার ঘেঁষে বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ডিশ, ইন্টারনেটের তার এলোমেলো ও বিপজ্জনকভাবে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় রাখার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করতে হবে এবং সব সঞ্চালন লাইন মাটির নিচে নিয়ে যেতে হবে। প্রতিটি বড় স্থাপনার অন্তত দুই পাশে অগ্নিকাণ্ড বা অন্যান্য বিপদে যেন দড়ি বা তার বেয়ে নামতে পারা যায় সে জন্য ছাদ ও পিলারে হুকের (আঁকড়া) ব্যবস্থা রাখতে হবে।
প্রত্যেক এলাকায় বিকল্প পানির উৎসের ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রয়োজনে রাস্তার মোড়ে মোড়ে হাইড্রেন্ট নির্মাণ করা যেতে পারে। এফ আর টাওয়ারের অগ্নিনির্বাপণে হাতিরঝিল থেকে হেলিকপ্টারে পানি নিয়ে যাওয়া খুব একটা স্মার্ট ব্যবস্থা হিসাবে বিবেচিত হয়নি। এফ আর টাওয়ার অগ্নিকাণ্ডে ছাদের উপর আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের কোনো না কোনোভাবে উদ্ধার করা গিয়েছিল। তাই পাশাপাশি অবস্থিত বহুতল ভবনের ছাদগুলোকে সেতু দিয়ে সংযুক্ত করা হলে আটকেপড়া ব্যক্তিরা পার্শ্ববর্তী ভবন দিয়ে অনায়াসে বের হয়ে আসতে পারবেন।
ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপণ সংশ্লিষ্ট স্থাপনা ও এলাকার বাসিন্দাদের সম্পৃক্ত করে অগ্নিকাণ্ড ও অন্যান্য বিপদ মোকাবিলার অর্থবহ মহড়া পরিচালনা করতে হবে। এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডে ‘স্পাইডার ম্যান’ খেতাবপ্রাপ্তির মতো সাহসী তরুণদের অগ্নিকাণ্ড ও অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি রাখতে হবে, প্রয়োজনের মুহূর্তে যেন তাদের কাছ থেকে যথাযথ সেবা গ্রহণ করা যায়।
আমাদের দেশ নিম্নমানের পণ্যসামগ্রীতে ভরে গেছে। এসি, ফ্রিজ, টিভি, এমনকি লিফট খুব অল্প সময়েই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এসি বিস্ফোরণ, লিফটে অগ্নিসংযোগ এবং লিফট ছিঁড়ে প্রাণহানির মতো খবরগুলো শুনতে হয় প্রায়ই। যেসব সামগ্রী ব্যবহারের সঙ্গে শত শত মানুষের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন জড়িত, সেসব ক্ষেত্রে অধিকতর সচেতন হতে হবে।
অফিস-আদালত, মার্কেট, পার্ক, রাস্তার মোড় ও বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে ময়লা পরিষ্কার করার নামে আবর্জনা জড়ো করে পুড়িয়ে দেওয়া অনেকটা নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। মাথার উপরের বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সেবা সংস্থার সঞ্চালন লাইন ছুঁই-ছুঁই করা ওই আগুন যে কোনো মুহূর্তে মহাবিপদ ডেকে আনতে পারে। আগুনে পুড়িয়ে আবর্জনা পরিষ্কারের এ অভ্যাস আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বন্ধ করতে হবে।
রাস্তা, সেতু, বিভিন্ন ধরনের স্থাপনায় পিলার, বিম, লিনটেইল নির্মাণে লোহার রডের পরিবর্তে বাঁশের ফালি বা কঞ্চির ব্যবহার, কোনো কোনো ক্ষেত্রে লোহার শিক ছাড়া শুধু খোয়া, বালি, সিমেন্ট দিয়েই ঢালাই কাজ সম্পন্ন করার ঘটনা মানুষকে রীতিমতো আতঙ্কিত করে তুলছে। এ ধরনের স্থাপনা উদ্বোধনের আগেই ভেঙে পড়ে জানমালের ক্ষতির কারণ হচ্ছে।
অনেক দেশই প্রকৃতির সঙ্গে সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে পেরেছে। আর মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ তো একান্তই আমাদের কর্মের ফল। অতীতের দুর্যোগগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা না নেওয়ায় এবং নিজেদের সংশোধন না করায় অগ্নিকাণ্ড ও অন্যান্য দুর্যোগ নিয়মিত সংঘটিত হয়ে চলেছে। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হওয়ার শুভক্ষণে আমাদের আইন অমান্যতা, অসাবধানতা, অসচেতনতা, বেখেয়ালিপনা এবং অন্যায় লোভের কারণে জানমাল ও রাষ্ট্রের সম্পদ আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যাবে, এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
সালাহ্উদ্দিন নাগরী : কলাম লেখক
snagari2012@gmail.com