Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সমস্যা কোথায়?

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সমস্যা কোথায়?

কবিগুরু রবিঠাকুরের ‘প্রান্তিক’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতার পঙক্তি দিয়ে নিবন্ধের সূচনা করছি : ‘নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,/শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস-/বিদায় নেবার আগে তাই/ডাক দিয়ে যাই/দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে প্রস্তুত/হতেছে ঘরে ঘরে।’

দেশবাসী সম্যক অবগত আছেন, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন, ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধসহ নানামুখী সংকটে বিপর্যস্ত বৈশ্বিক অর্থনীতি। এ পরিপ্রেক্ষিতে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির তথ্য দেশের গণমাধ্যমে প্রতিনিয়তই প্রচারিত হচ্ছে। জনশ্রুতিমতে, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেবা সংস্থাসহ সর্বত্রই অশুভ শক্তির অপতৎপরতা জনগণের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। ঘুস-দুর্নীতি ও হয়রানির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানেই ঘাপটি মেরে থাকা শর্ষের ভূতগুলো সক্রিয়। এদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতা দেশের সব উন্নয়ন অর্জনকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে। জনগণের মধ্যে এসব ভূত তাড়ানোর শক্তি অত্যন্ত সীমিত। সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে অচিরেই সবকিছু মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।

বিজ্ঞজনের মতে, অনেক ক্ষেত্রে জনগণের দুর্ভোগ বাড়িয়ে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপকৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে কিনা, তার প্রয়োগিক বিশ্লেষণ জরুরি। দল ও নেতাকর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, শিষ্টাচার, সহিষ্ণুতার মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা-সমঝোতার পরিবেশ বজায় রেখে সব ধরনের অশুভ পন্থা নস্যাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণই সুস্থ রাজনীতির পরিচায়ক। অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সুরা অবৈধ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের হীন উদ্দেশ্যে সবসময় রাজনৈতিক কলহ-বাগবিতণ্ডা জিইয়ে রাখার জন্য অপচেষ্টা অব্যাহত রাখে। মিথ্যাচার-প্রতারণা-জালিয়াতি-ছলচাতুরীতে পারঙ্গম ব্যক্তিরা তথাকথিত খুঁটির জোরের বদৌলতে উচ্চশিক্ষা থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদ-পদক-পদায়ন দখলে নিয়ে পুরো দেশবাসীকে যেন জিম্মি করে ফেলেছে। এসব ব্যক্তি সমাজে কমবেশি চিহ্নিত। এদের ক্ষমতার বলয়-প্রভাব অধিক মাত্রায় প্রবল বলে সৎ-যোগ্য-দক্ষ-নীতি-নৈতিকতায় ঋদ্ধ ত্যাগী মানুষরা এদের বিরুদ্ধে সাহস করে সত্য প্রকাশে অপারগ। ক্ষেত্রবিশেষে পরীক্ষিত, সমাজস্বীকৃত, জননন্দিত ব্যক্তিদের নানাভাবে ফাঁসিয়ে দিয়ে অযথা হয়রানি-অপমানিত-লাঞ্ছিত করতে এরা কুণ্ঠাবোধ করছে না।

প্রচলিত ধারণামতে, স্বার্থান্বেষী মহল তাদের কুৎসিত উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যস্ত এবং এদের প্রায় সবাই বর্ণচোরা সেজে বঙ্গবন্ধুর কথা মুখে বেশি বেশি উচ্চারণ করলেও তাদের অন্তর ন্যূনতম আদর্শিক চেতনায় ঋদ্ধ নয়। তাদের অনেকে বিভিন্ন স্থানে কৌশলে ঢুকে পড়ে সরকারের ক্ষতি করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তাছাড়া দেশ ও সরকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে। দেশকে উন্নতির কাঙ্ক্ষিত সোপানে নিয়ে যেতে সরকার সচেষ্ট থাকলেও প্রশাসনসহ সর্বক্ষেত্রে দলবাজি ও দলাদলির অপসংস্কৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। পেশাজীবীদের অনেকে বুদ্ধিজীবী হওয়ার পরিবর্তে নিজেদের পেশিশক্তিতে পরিণত করেছেন। এর ফলে রাতারাতি রং ও ভোল পালটানো কর্মকর্তা-কর্মচারীর সারিও দীর্ঘ হচ্ছে। সুবিধাবাদী কর্মকর্তাদের বেশিরভাগ ব্যক্তিস্বার্থে দ্রুত পদোন্নতিসহ প্রাইজ পোস্টিং নিতে মরিয়া। বিশেষ করে ‘পাওয়ার হাউজগুলোয়’ এক ধরনের অদৃশ্য নিজস্ব বলয় তৈরি করতে অনেকেই সক্ষম। ফলে প্রকৃত পেশাদার ও মেধাবীদের যথাযথ মূল্যায়ন না করে বরং অবমূল্যায়নের পথকে বিস্তৃত করা হচ্ছে। প্রশাসনসহ সমাজের সর্বক্ষেত্রে এক ধরনের হাইব্রিড চাটুকার ও ক্ষমতাধরদের দ্রুতই জয়জয়কার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ চক্রের খপ্পরে পড়ে একদিকে সরকার এবং অপরদিকে দেশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এদের সিংহভাগ ক্ষমতার অপব্যবহারে মোটাতাজা হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রমতে, এরা সুকৌশলে দুর্নীতি করেছে এবং দুর্নীতির অর্থ অবৈধ উপায়ে বিদেশে পাচার করে চলেছে। তবে এটাও সত্য, সবকিছু প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। এজন্য দেশের স্বার্থে দেশপ্রেমিক সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সহযোগিতার হাত প্রশস্ত করতে হবে।

লোভ-লালসা, স্বজন-অঞ্চল-বন্ধুপ্রীতি, তদবির-লবিং ইত্যাদি অপসংস্কৃতির কারণে শিক্ষা-বাণিজ্য-ভূমি-হাসপাতাল-ব্যাংক-গণমাধ্যমসহ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার ব্যক্তিবিশেষের কুপ্রবৃত্তি সভ্য সমাজ অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গে অবলোকন করছে। সব কিছু গিলে খাওয়ার এ অসম প্রবণতা ও হীন পন্থার দৃষ্টান্ত তৈরির চেষ্টাগুলোকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। অন্যথায় ব্যর্থতার দায়ে আগামী প্রজন্মের কাঠগড়ায় আমাদের অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। বর্তমানে রাজনীতির আবরণে অর্থ-ক্ষমতালিপ্সু কথিত রাজনীতিকদের বিবেকবর্জিত কর্মকাণ্ডে জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিদিনই বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। প্রকৃতপক্ষে দলের পদ-পদবি, জবরদখল, চাঁদা-টেন্ডারবাজি, ঠিকাদারি-হাটের ইজারাসহ বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ড নিয়ে এলাকায় হত্যাকাণ্ডসহ নানা ধরনের ভয়ংকর অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অপরাধ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশে চলছে দুর্বৃত্তায়ন। আদর্শিক রাজনীতির অভাবে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-বিরোধ প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান।

স্মরণযোগ্য, ১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি কুমিল্লায় বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির প্রথম ব্যাচের সমাপনী অনুষ্ঠানে অফিসারদের দিকনির্দেশানামূলক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তোমরা আদর্শবান হও, সৎ পথে থেকো। মনে রেখো, মুখে হাসি বুকে বল, তেজভরা মন, মানুষ হইতে হবে, মানুষ যখন। মাঝে মাঝে আমরা অমানুষ হয়ে যাই। এত রক্ত দেওয়ার পরও যে স্বাধীনতা এনেছি, চরিত্রের পরিবর্তন অনেকের হয় নাই। এখনো ঘুসখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, মুনাফাখোরি বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত এদের আমি অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি। চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনি। কিন্তু আর না। বাংলার মানুষের জন্য জীবনের যৌবন আমি কারাগারে কাটিয়ে দিয়েছি। এ মানুষের দুঃখ দেখলে আমি পাগল হয়ে যাই।...পাকিস্তানিরা সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেছে। কাগজ ছাড়া আমার জন্য কিছু রেখে যায় নাই। বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে আমাকে আনতে হয়, আর এই চোরের দল আমার দুঃখী মানুষের সর্বনাশ করে, এভাবে লুটতরাজ করে খায়। এবার আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, যদি ২৫ বছর এ পাকিস্তানি জালেমদের বিরুদ্ধে, জিন্নাহ থেকে আরম্ভ করে চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে বুকের পাটা টান করে সংগ্রাম করে থাকতে পারি, আর আমার ত্রিশ লাখ লোকের জীবন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি, তাহলে পারব না? নিশ্চয় ইনশাআল্লাহ পারব।’

বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘এই বাংলার মাটি থেকে দুর্নীতিবাজ, এই ঘুসখোর, এই মুনাফাখোর, এই চোরাকারবারিদের নির্মূল করতেই হবে। আমিও প্রতিজ্ঞা নিয়েছি, তোমরাও প্রতিজ্ঞা নাও, বাংলার জনগণও প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করো। আর না। ধৈর্যের সীমা হারিয়ে ফেলেছি। এজন্য জীবনের যৌবন নষ্ট করি নাই। এজন্য স্বাধীনতার জন্য রক্ত দেয় নাই। যে কয়েকটা চোরাকারবারি, ঘুসখোর, মুনাফাখোর দেশের সম্পদ বাহির করে নিয়ে আসে, জিনিসপত্র গুদামজাত করে মানুষকে না খাইয়ে মারে, উৎখাত করতে হবে বাংলার বুক থেকে তাদের। দেখি কতদূর তারা টিকতে পারে। চোরের শক্তি বেশি, না ইমানদারের শক্তি বেশি, সেইটাই এখন প্রমাণ হয়ে যাবে। অন্যায়ের কাছে কোনোদিন মাথানত করি নাই। বারবার পাকিস্তানিরা আমাকে ফাঁসি দিতে চেয়েছে। বারবার বুক টান করে আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি। কারণ আল্লাহ আমার সহায় ছিল। বাংলার জনগণের আমার ওপর দোয়া ছিল। এখনো সেই দোয়া আছে। ইনশাআল্লাহ, তোমাদের সাহায্য, তোমাদের সহানুভূতি, তোমাদের কাজ, জনগণের ভালোবাসা আর ইমানদার মানুষের সহযোগিতায় এ দুষ্কৃতকারীদের নির্মূল করতেই হবে।’

দেশপ্রেমিক সচেতন মহলের মতে, সুবিধাভোগীদের বেপরোয়া দৌরাত্ম্য এবং ষড়যন্ত্রকারীদের অপতৎপরতায় সোনার বাংলা বিনির্মাণে সৎ-যোগ্য-মেধাবী মানবসম্পদ যথাযথ মর্যাদাসীন হতে ব্যর্থ হচ্ছে। এখনো প্রকৃত অর্থে জ্ঞান, নীতি-নৈতিকতা, সততা ও দেশপ্রেমের অনন্য প্রতীক হিসাবে যারা পরীক্ষিত; তাদের মূল্যায়ন অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হচ্ছে। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে লিপ্ত বর্ণচোরা-অনুপ্রবেশকারী-অন্ধকারের শক্তির সঙ্গে অদৃশ্য যোগসাজশ বা আপসকামিতায় পারদর্শী কথিত রাজনীতিক-ব্যবসায়ী-পেশাজীবী ব্যক্তিদের কুৎসিত মনোবৃত্তিকে পরাস্ত করা সব নিবন্ধিত দল-সরকার-দেশবাসীর পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। নির্মোহ ও ত্যাগী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অবমূল্যায়নের মাধ্যমে অপাঙক্তেয়-বিতর্কিত-অযাচিত দোষী সাব্যস্ত করার সব উদ্দেশ্য নস্যাৎ করে প্রান্তিক ও ন্যায়পরায়ণতায় অবিচল ব্যক্তিদের যথাযোগ্য মূল্যায়ন করে যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিত করা না হলে জাতি শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, ভবিষ্যৎকে আলোকময় করার সব সৎ উদ্যোগও বিফলে যাবে।

চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ-অসৎ-অযোগ্য-অদক্ষ ব্যক্তিদের পদচারণা বন্ধ করা না হলে দেশে বিরাজমান সমস্যাগুলো আরও প্রকট আকার ধারণ করার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত পথে জাতিকে পরিচালনা করা সময়ের জোর দাবি এখন। চলমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের দায়ভার কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় আদর্শের মৌলিক স্তম্ভগুলোকে জাতির মননে প্রোথিত করার উদ্যোগ অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। শর্ষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভয়ংকর ভূতগুলোকে প্রচণ্ড আঘাতে জর্জরিত করে সব ক্ষেত্র থেকে এদের তাড়ানোর জোরালো দাবি দেশব্যাপী উচ্চারিত হচ্ছে। জনগণের এ দাবি উপেক্ষিত হলে এর অনিবার্য পরিণতি দেশকে অন্ধকারের গহ্বরের কোন পর্যায়ে নিমজ্জিত করবে, তা অনুধাবন করার সময় মনে হয় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম