Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

ঈদের আগে প্রবাসী আয় কমা ভালো লক্ষণ নয়

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঈদের আগে প্রবাসী আয় কমা ভালো লক্ষণ নয়

সব অভিজ্ঞতাকে মিথ্যা প্রমাণ করে গত মার্চ মাসে ঘটেছে এক অসম্ভব ঘটনা। এ মাসে আমাদের প্রবাসী আয় কমেছে, কমেছে মানে বেশ কমেছে। অথচ এখন পবিত্র রমজান মাস। সামনে ঈদ, আনন্দের উৎসব। এ মাসে এবং পবিত্র কুরবানির ঈদের সময় আমাদের প্রবাসী ভাই-বোনেরা বাবা-মা, ভাই-বোনের কাছে ডলার পাঠান বেশি বেশি করে। বলাই বাহুল্য, ঈদ খরচ, রোজার মাসের ব্যয় নির্বাহের জন্য। এটাই আমাদের অভিজ্ঞতা। প্রত্যেক বছরেই তা হয়। কিন্তু এবার ঘটে গেল বিরাট ব্যতিক্রম। সরকারিভাবে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় (ডলার) মার্চ মাসে এসেছে অনেক কম। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২ দশমিক ১০ এবং ২ দশমিক ১৬ বিলিয়ন (বিলিয়ন সমান শত কোটি) ডলার। বিশাল অঙ্কের টাকা। অথচ চলতি বছরের মার্চে যেখানে বেশি পরিমাণ রেমিট্যান্স আসার কথা, সেখানে এসেছে মাত্র ১ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার। এ পরিমাণ ডলার ২০২৩ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে মোটামুটিভাবে এসেছিল। কিন্তু এবারই ঘটল ব্যতিক্রম। সরকারিভাবে রেমিট্যান্স এসেছে কম। অথচ আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, আমাদের ডলার সংকট কেটে গেছে। এমনকি তারা বলছে, রপ্তানির পরিমাণও বাড়ছে। বিদেশিরা ঋণ দিতে তৈরি হচ্ছে। কত আশাবাদ তাদের! বলা হচ্ছে, মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সব জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। দেশ শ্রীলংকার মতো হবে-এ কথা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বালা-মুসিবত আর নেই।

সরকারের এ আশাবাদ শতভাগ সত্য হোক, বাস্তবায়িত হোক-এটাই আমরা চাই। কারণ তাহলে বেঁচে যাব আমরা। বড় কষ্টে আছে মানুষ। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, শুধু রেমিট্যান্সই মার্চ মাসে কম আসেনি, রপ্তানির পরিমাণও এ মাসে কমেছে। ডিসেম্বর ২০২৩ এবং জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২৪-এ আমাদের রপ্তানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৩, ৫ দশমিক ৭২ এবং ৫ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে মার্চ মাসে রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৫ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। অথচ সামনে শুধু পবিত্র ঈদ উৎসবই নয়, ১৪ এপ্রিলে পড়েছে আমাদের আনন্দের আরেক উৎসব-নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ। এ সময়ই রেমিট্যান্স ও রপ্তানির ক্ষেত্রে এ হতাশাজনক সংবাদ। তাহলে মানুষ ঈদ কীভাবে করবে?

এ প্রশ্নটি আরও বড় হচ্ছে, কারণ দেখা যাচ্ছে গ্রামের মানুষের ব্যাংক আমানত হ্রাস পাচ্ছে। এর অর্থ কী? এর অর্থ হলো, তাদের হাতে টাকা নেই। ব্যাংকের তারল্য সংকট তো আছেই। সরকার সমানে দেশি-বিদেশি ঋণ এখনো করে যাচ্ছে। সরকার তার বিল-বন্ডে অতিরিক্ত সুদ দিয়ে বাজার থেকে ঋণ করছে। বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছে টাকা পাবে। সরকার সেই টাকা দিতে পারছে না। সরকারের রাজস্ব কোনোভাবেই বাড়ছে না। আমদানির পরিমাণ কমানো হয়েছে। রপ্তানি যা হচ্ছে তার প্রকৃত পরিমাণ কী, তা কেউ জানে না-রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মেলালে মেলে না। বাজারে বহু পণ্যের ক্রেতা নেই। কৃষকদের হাতে টাকা নেই। মানুষের ভোগব্যয় কম। এ অবস্থার মধ্যেই এসেছে পবিত্র ঈদ এবং পহেলা বৈশাখ। তাহলে কি মানুষের অন্য কোনো আয়ের উৎস আছে? হতে পারে ঋণ একটা উৎস। এমনিতেই দেশের ৩০ শতাংশ লোক ঋণী। হয়তো আরও ঋণ তারা করবে। এছাড়া আর অন্য কী পথ আছে? তবে কি ‘হুন্ডিতে’ ডলার আসছে? এসব প্রশ্ন এখন সবার।

কেউ কেউ বলছেন, খোলাবাজারে ডলারের দাম বেশি। প্রবাসীরা এ কারণে সরকারিভাবে ডলার পাঠায় না। তারা পাঠায় ‘হুন্ডিতে’। কেউ কেউ আসার সময় ক্যাশ ডলার নিয়ে আসে। এবারও নাকি অনেক ডলার রোজার মাসে অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে এসেছে এবং আসছে। এ টাকায় ঈদের খরচ তারা মেটাবে। কত ডলার এভাবে আসছে? এর কোনো হিসাব কারও কাছে নেই। তবে আসছে। এখানে কোনো ‘দেশপ্রেম’ কাজ করে না। খোলাবাজারে বেশি দাম পেলে প্রবাসীরা কেন ডলার পাঠাবে ব্যাংকের মাধ্যমে? চাহিদা ও সরবরাহের এই গ্যাপের মধ্যেই কাজ করে ‘হুন্ডিওয়ালারা’। গত ৫০-৫২ বছরে হুন্ডির বিরুদ্ধে বহু কথা শুনেছি, বহু পদক্ষেপ দেখেছি; কিন্তু হুন্ডির আকার-প্রকার বেড়েছে বৈ কমেনি।

‘হুন্ডি’ একটি অর্থনৈতিক কাজ। এর উপযোগিতা আছে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের কাছেই। উপযোগিতা নেই সরকারের কাছে। সরকার কোনো রাজস্ব পায় না। এখন এটা ঘটছে আরও বেশি। চারদিকে কালো টাকা, আমদানি বন্ধ। অথচ পণ্য দরকার। পণ্যের চাহিদা আছে। এ চাহিদা হয় আমদানির মাধ্যমে, নয়তো চোরাচালানের মাধ্যমে মেটাতে হবে। এখানেই হুন্ডির কাজ। এ মুহূর্তে যা ঘটছে বলে মনে হয়, তা বলা হচ্ছে এভাবে। চোরাচালানের পরিমাণ বেড়ে গেছে। কারণ আমদানি নিষিদ্ধ, সীমিত। ডলার নেই। অতএব, চোরাচালানের মাধ্যমে পণ্য আসছে। আবার রয়েছে ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’। অর্থাৎ পণ্যের দাম কম দেখানো। এতে ব্যবসায়ীদের খরচ কম পড়ে, পণ্যের পড়তা কম পড়ে। সরকারের রাজস্ব কমে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ করে পণ্য আনলে সরকারিভাবে ডলার লাগবে কম। কিন্তু যিনি রপ্তানিকারক, তিনি তো কম দামে পণ্য দেননি। তিনি তার দামটি ঠিকই নিয়েছেন। ওই টাকা কোত্থেকে আসবে? অবশ্যই তা ‘হুন্ডিওয়ালারা’ জোগান দেবে। তাদের সেই কাঠামো/ব্যবস্থা আছে। তারা দেশের বাইরেই ডলার জোগাড় করবেন, রয়েছে ক্যাশ ডলার, সোনা। এর মাধ্যমেও তারা রপ্তানিকারকের পাওনা টাকা (আন্ডার ইনভয়েসিং এবং প্রকৃত মূল্যের পার্থক্য) পরিশোধ করবেন।

একইভাবে ব্যবসা চলবে চোরাচালানের ক্ষেত্রে। খবরে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবেশী দেশ থেকে সমানে চিনি চোরাচালান হয়ে আসছে। আসবে না কেন? খবরে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবেশী দেশে যেখানে চিনির কেজি ৪৬ রুপি (বাংলা টাকায় ৬০), সেখানে আমাদের টিসিবি (ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশ) চিনি বিক্রি করে ১৩৫-১৪০ টাকা কেজি দরে। খোলাবাজারে আরও বেশি। সেখান থেকে আমরা যে চিনি কিনি, তা ‘সুগার কেইন’ বা আখ থেকে তৈরি কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। দামে যদি এই তফাৎ থাকে, তাহলে ক্রেতারা কী করবে? ‘দেশপ্রেমিক’ ব্যবসায়ী, চোরাচালানিরা কী করবে? বসে থাকবে? নিশ্চয়ই না। কোনো বাধাই-ধর্মীয়, আইনি, প্রশাসনিক ও সামাজিক-তারা মানবে না। যেখানেই লাভ, মুনাফা, অতিরিক্ত মুনাফা, সেখানেই ব্যবসায়ীরা। চিনির ব্যবসা এ অবস্থায় পড়ায় আমাদের মিল মালিকরা তাদের বাঁচানোর জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছেন। তারা বলছেন, কয়েক মাস ধরে প্রতিবেশী দেশ থেকে চিনি চোরাচালান হয়ে আসার ফলে (১ এপ্রিলের খবর) বৈধভাবে আমদানি কমে গেছে। সরকার লোকসান দিচ্ছে রাজস্বে। দেশীয় চিনি পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো বলছে, বৈধভাবে চিনি এলে শুল্ক দিতে হয় অনেক বেশি। এতে তারা পেরে উঠছে না। অতএব, বাঁচানো হোক তাদের।

দেখা যাচ্ছে, আমাদের বার্ষিক চিনির চাহিদা ২০-২২ লাখ টন। দেশে উৎপাদিত হয় যৎসামান্য। বাকি সব চিনি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর সুবাদে চিনি ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা করে ‘লাল’ হচ্ছেন, আর ভোক্তাদের পকেট হচ্ছে শূন্য। চোরাচালানের চিনি তাদের কাজে লাগে। কিন্তু প্রশ্ন, এই চোরাচালানকৃত চিনির মূল্য প্রতিবেশী দেশের ব্যবসায়ীদের কীভাবে পরিশোধ করা হবে? সরকারিভাবে তো ডলার পাওয়া যাবে না এই দায় পরিশোধের জন্য। বাংলাদেশেরও প্রচুর বিভিন্ন ধরনের পণ্য নেই, যা দিয়ে ওই টাকা পরিশোধ করা যাবে। তাহলে উপায়? উপায় ‘বন্ধু’ হুন্ডিওয়ালারা। তারা বিগত ৫০-৫২ বছরে বিরাট এক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে আন্তর্জাতিকভাবে। আগে ছিল শুধু প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে। প্রযুক্তি, প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয়, ভোগ চাহিদা, পরিবহণ ব্যবস্থা, বাড়তি আয়, ঘুস-দুর্নীতি ‘হুন্ডিওয়ালাদের’ ব্যবসায় মদত জোগাচ্ছে। কোন কোন বড় ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক এই অবৈধ হুন্ডি ব্যবসায় নেই, তা গবেষণা করে দেখার বিষয়। বর্তমানে অনুমান করা যায়, প্রবাসীদের ডলার হুন্ডিওয়ালারা বিদেশেই রেখে দিচ্ছে। প্রবাসীদেরকে দেশে মুহূর্তের মধ্যে তারা টাকা দিয়ে দিচ্ছে। তারা ডলারপ্রতি দাম দিচ্ছে বেশি। সরকার তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যেতে প্রবাসীদের ডলারপ্রতি দুই টাকা বেশি করে দিচ্ছে। হুন্ডিওয়ালারা তখন আরও বেশি দিচ্ছে। ডলার বাজারে তৈরি হচ্ছে দ্বৈতমূল্য ও অস্থিরতা। চোরাচালানকৃত পণ্যের টাকা হুন্ডিওয়ালারা তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে রপ্তানিকারকদের দিয়ে দিচ্ছে। আমাদের রপ্তানিকারকদের অনেক টাকা, ঘুসখোরদের টাকা এই হুন্ডির বাজারে প্রাণশক্তি জোগাচ্ছে। পণ্যের অভাব, চাহিদা, চোরাচালান, হুন্ডি, ডলার এবং স্বর্ণের ব্যবসা সব একাকার হয়ে তৈরি হয়েছে বিশাল এক অবৈধ বাজার-কালো অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক কালো অর্থনীতি। এতে মদত দিচ্ছে দেশের অনেক আইন, বিদেশি আইন।

অনেকের মতে, আমাদের মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন আইনই হুন্ডিওয়ালাদের সহায়ক শক্তি। এই আইনে টাকা বৈধ থাকতে হয়। অথচ বাজার ভর্তি অবৈধ টাকায়। চোরাচালান থেকে, ঘুস-দুর্নীতি থেকে, অতি মুনাফা থেকে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে কালো টাকা। কালো টাকা, চোরাচালান এবং ঘুস-দুর্নীতির সহায়ক শক্তিই ‘হুন্ডিওয়ালা’। আমাদের দেশে বহু ‘হুন্ডিওয়ালা’ বড় বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি হয়েছেন। অতীতে বহু হুন্ডিওয়ালার নামও কাগজে ছাপা হয়েছে। বিচারের কথা হয়েছে। আগে এ কাজ করত অবাঙালি এবং ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা। এখন এ কাজ করে বিশাল বিশাল ব্যবসায়ী গ্রুপ, যারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের কারণে এখন আমাদের প্রবাসী আয় বাড়ছে না। ডলার চলে যাচ্ছে তাদের হাতে। তাদের শক্তি আরও বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রতিকার কী? ৫০-৫২ বছরে হয়নি, ভবিষ্যতে হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম