Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ঈদের আনন্দ ফিকে হয়ে যায় নানা বিপর্যয়ে

Icon

সালাহ্উদ্দিন নাগরী

প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঈদের আনন্দ ফিকে হয়ে যায় নানা বিপর্যয়ে

মানুষের জীবনে প্রতিটি দিন যেন ঈদের আনন্দ নিয়ে আসে, এটাই ঈদের শিক্ষা। কিন্তু ঈদ-আনন্দকে উপভোগ করার জন্য ঈদ-প্রস্তুতির ধাপগুলো মসৃণভাবে অতিক্রম করা অনেক ক্ষেত্রেই সহজসাধ্য হয় না।

বেশ কয়েকদিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে দোকানপাট ও বিভিন্ন স্থাপনায় ধারাবাহিকভাবে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে চলেছে। উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ, বিশেষত দোকান মালিক ও কর্মীরা। কারণ এর সঙ্গে তাদের রুটি-রুজির সম্পর্ক। তারপরও এসব নিয়েই আমাদের ঈদ উদযাপন করতে হচ্ছে।

আমরা যত উপরে উঠছি, মনে হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা ও ভোগান্তি যেন প্রতিযোগী হয়ে পিছু নিচ্ছে। জনগণকে নির্বিঘ্নে ঈদ-প্রস্তুতি ও উদযাপনের ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়ার জন্য যেসব সংস্থা, ব্যক্তি জড়িত, তাদের কি কোনো গাফিলতি, দায়িত্ব পালনে অনীহা, অদূরদর্শিতা বা অক্ষমতা আছে? নতুবা এত ভোগান্তি কেন? আমরা তো স্বস্তিকর ঈদ-প্রস্তুতি চাই। আমরা কি প্রতিবছর ঈদ আয়োজনের বাধাগুলোকে একটু একটু করে সমন্বয় করতে পারি না? ঈদ সামনে রেখে প্রতিবছর যে বিষয়গুলো দেশের মানুষকে হয়রানির মধ্যে ফেলে সেগুলো একটু আলোচনা করা যাক।

এ সময় রাজধানী ও অন্যান্য শহরে বিভিন্ন ধরনের অপরাধী বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এ চক্রের মধ্যে রয়েছে ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, পকেটমার। কেউ কেউ মাঝেমধ্যে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও অধিকাংশই থাকে অধরা, বাস, ট্রেন, লঞ্চ স্টেশন, মার্কেট-বাজার হলো এদের টার্গেট এরিয়া। এদের কবলে পড়ে খোয়া যাচ্ছে মানুষের টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন, মানিব্যাগসহ নানা ধরনের জিনিসপত্র।

অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা জনসমাগমের স্থানগুলোতে ফেরিওয়ালা ও পাবলিক পরিবহণে যাত্রীবেশে ডাবের পানি, চা-কফিসহ বিভিন্ন পানীয় ও খাবারের সঙ্গে চেতনা-নাশক মিশিয়ে, রুমালে ক্লোরোফর্ম দিয়ে মানুষকে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে। এদের পাল্লায় পড়ে কত ট্রেনযাত্রীকে হাসপাতালের বেডে ঈদের সেমাই খেতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া চেতনা-নাশক ওষুধ বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও যেসব অসাধু ওষুধ বিক্রেতা অধিক মুনাফার জন্য অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের কাছে তা বিক্রি করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

এ সময় সক্রিয় হয়ে ওঠে ছিনতাইকারী চক্র। শহর-বন্দরে নিরিবিলি জায়গায় একা পেয়ে টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন ইত্যাদি ছিনতাই করে তারা দ্রুত কেটে পড়ে। পকেটমাররা যেন এ সময়টির অপেক্ষায় থাকে সারা বছর। ঈদ সামনে রেখে সারা দেশে, বিশেষত রাজধানীতে জালনোট চক্র বেপরোয়া হয়ে ওঠে; তারা আসল নোটের মাঝে জালনোট মিশিয়ে সাধারণ মানুষকে ফতুর করে ছাড়ে।

ফুটপাত দখল করে জুতা-স্যান্ডেল, কাপড়-চোপড়, ফল-ফুল বিক্রি ঈদের মাসে ভিন্ন রূপ ধারণ করে, রাস্তা দিয়ে হাঁটা কঠিন হয়ে পড়ে। ফুটপাতের দোকানদার, বাস, ট্রাক, লেগুনা, এমনকি ভিক্ষুকের কাছ থেকেও চাঁদা তুলতে চাঁদাবাজরা কসুর করে না। তাই দোকানিরাও জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে প্রকারান্তরে জনগণের পকেট থেকে চাঁদার অংশটুকু সমন্বয় করে নিচ্ছে। এসব জালিয়াত চক্রের সদস্য, ছিনতাইকারী ও চাঁদাবাজদের শুধু গ্রেফতার করলে হবে না, তাদের বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

ঈদ সামনে রেখে দেশের আনাচে-কানাচে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরির অবৈধ কারখানা গড়ে ওঠে। গোপনে পরিচালিত ওইসব কারখানায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মান-নিয়ন্ত্রণের তোয়াক্কা না করেই চলতে থাকে সেমাই উৎপাদন এবং পোড়া মবিলে ভাজা হতে থাকে লাচ্ছা সেমাই। জনগণকে ভেজাল ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর খাদ্য গ্রহণ থেকে পরিত্রাণ দিতে হলে খাদ্য উৎপাদক, প্রক্রিয়াজাতকারক ও পরিবেশকদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে।

সেমাই, লাচ্ছা সেমাই, দই, বিভিন্ন মিষ্টান্ন দ্রব্য, ফুচকা তৈরির অবৈধ, অস্বাস্থ্যকর সব ফ্যাক্টরি উচ্ছেদ করতে হবে। ঈদের প্রাক্কালে আমাদের প্রতিজ্ঞা হতে পারে-‘ভেজাল মিশ্রিত খানা, আর না, আর না’। খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণকারীদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে। নতুবা অদূর ভবিষ্যতে আমাদের মেধাহীন, রুগ্ণ ও অসুস্থ জাতিতে পরিণত হতে হবে। অসুস্থ জাতির কাছ থেকে কখনোই সর্বোচ্চ প্রাপ্তি আশা করা যায় না।

বিগত কয়েক বছরের হিসাব বলছে, প্রায় ৭০-৮০ লাখ মানুষ ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি বা অন্যত্র যায় ঈদ উদযাপনের জন্য। টিকিট সংগ্রহ থেকে শুরু করে যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছা পর্যন্ত পদে পদে ভোগান্তি। বাস, লঞ্চ, ট্রেনের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ৩-৪ গুণ যাত্রী নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল আমাদের গা-সহা হয়ে গেছে।

লাইসেন্সহীন চালকের মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেসবিহীন বাস, লাইট-ফ্যানহীন পুরোনো জরাজীর্ণ ট্রেনের বগি ঈদযাত্রীদের আদরণীয় বাহনে পরিণত হয়। যাত্রাপথের ধকল ও ক্লান্তিতে পানসে হয়ে যায় ঈদ-আনন্দ। তাই যাদের বাড়ি যাওয়ার পিছুটান বিভিন্ন কারণে একটু শিথিল, যাত্রার ভোগান্তি বিবেচনা করে তারা ঈদযাত্রাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন।

প্রায় বাতিল হয়ে যাওয়া লক্কড়ঝক্কড় লঞ্চের মেঝে ও কার্নিশে লোহার পাত লাগিয়ে, নতুনভাবে রং মেখে ঝকঝকে করে নদীতে নামানো হয়। দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে নাড়ির টানে বাড়িমুখী যাত্রীদের সেটাই বরণ করে নিতে হয়। ঈদে লঞ্চডুবির ঘটনাও কম নয়। পানিপথের ঈদযাত্রাকে নিরাপদ করার জন্য চলাচলের অনুপযোগী লঞ্চগুলোকে কোনোভাবেই চলাচল করতে দেওয়া যাবে না, এ জন্য তদারকির ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার প্রায় দুবছর হতে চলল। তাই দক্ষিণবঙ্গের মানুষ এখন আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে লঞ্চযাত্রা করবেন না, এটাই প্রত্যাশা।

উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের ভেতরে বিভিন্ন স্থানের দূরত্ব ও যাত্রাপথের সময়কে সমন্বয় করতে হবে। নব্বইয়ের দশকে মগবাজার বা মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে গাজীপুর শহরে পৌঁছাতে সময় লাগত সর্বোচ্চ ৪৫ মিনিট। এখন সেটা ৩-৪ ঘণ্টার যাত্রাপথে পরিণত হয়েছে। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলের যাত্রাপথ ছিল দুঘণ্টার। এখন সেটা বেড়ে ৪-৫ ঘণ্টায় ঠেকেছে।

মহাসড়কে যানজটের অসংখ্য কারণের মধ্যে ভাঙাচোরা রাস্তা, গাড়ির অতিরিক্ত চাপ, মহাসড়কের একাধিক রাস্তার সংযোগস্থলগুলোতে এলোপাতাড়ি গাড়ি রাখা, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা অন্যতম। ঈদের সময় যানজট সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। মহাসড়কগুলোর যেসব সংযোগস্থলে সবসময় যানজট লেগে থাকে সেসব স্থানে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা যেতে পারে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বিআরটি প্রকল্পের সাতটি ফ্লাইওভার খুলে দেওয়ায় এ পথে এবাবের ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হবে বলে আশা করছেন যাত্রী ও পরিবহণসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। একইসঙ্গে এসব অবকাঠামো এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেন দুদিন পরপর নষ্ট হয়ে যানজট ও জনভোগান্তির কারণ না হয়।

ঈদের আগের দিন থেকে পরবর্তী কয়েকটা দিন ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর প্রায় ফাঁকা থাকে। যানজট থাকে না। আর এ সময়ে ধনীর দুলালরা গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অনেকেই বন্ধু-বান্ধব নিয়ে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পাগলা ঘোড়ার মতো গাড়ি চালায়; ফাঁকা রাস্তায় ফুটপাত, দোকাপাট, পথচারীর ওপর গাড়ি তুলে দিয়ে যানমালের ক্ষতির কারণ হয়। কয়েক বছর আগের ঘটনা। ঈদের পরদিন ভোরবেলা এক বয়স্ক দম্পতি মেয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য সিএনজির অপেক্ষায় ফুটপাতে দাঁড়ানো অবস্থায় প্রচণ্ড গতির একটি প্রাইভেট কার তাদের উপরে আছড়ে পড়ে; ঘটনাস্থলে দুজনেরই মৃত্যু হয়।

পরে দেখা যায় ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন এক মাতাল তরুণ বন্ধু-বান্ধবসহ ফুর্তি করতে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিল। শহরে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণকারীদের ঈদ-পরবর্তী সময়গুলোতে আরও কঠোরভাবে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। একইসঙ্গে ধনীর দুলালদের অভিভাবককে তার পোষ্যদের শাসন করা, নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখা দরকার, ফাঁকা রাস্তায় দুর্ঘটনার হার অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। তাই গাড়ি যে চালাচ্ছে সে প্রকৃত ড্রাইভার কিনা, সে মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছে কিনা, রাস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে এ বিষয়গুলো পরীক্ষা করার ব্যবস্থা না নিলে ঈদে দুর্ঘটনা কমানো যাবে না।

গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে যখন কোনো হেলপার বসে, তখন দুর্ঘটনার আশঙ্কা বহুগুণে বেড়ে যায়। তাই ঈদযাত্রাকে নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে হেলপার, অপ্রাপ্তবয়স্ক, লাইসেন্সহীন কেউ যেন স্টিয়ারিংয়ে বসতে না পারে, এখন থেকেই তা মনিটর করতে হবে। ফিটনেসবিহীন পুরোনো সব ধরনের যানবাহন সড়ক-মহাসড়ক থেকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে।

আমরা ক’জন জানি লাক্সারি বাসের একেকজন ড্রাইভার একনাগাড়ে কয়টি ট্রিপ দেয়? তারা নাকি একটানা ৩-৪টি ট্রিপ দেয়। অর্থাৎ টানা ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে স্টিয়ারিং ধরে রাখে। এরকম পরিস্থিতিতে চালকের ক্ষণিক অন্যমনস্কতার জন্য যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে তাকে কি খুব বেশি দোষ দেওয়া যায়? এ বিষয়টি নিয়ে মালিক ও ড্রাইভার সমিতি এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের আলোচনা করা ও সিদ্ধান্তে আসা দরকার। আমাদের দেশে ট্রেন, বাস, লঞ্চপথে দুর্ঘটনার হার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। বাস ও ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ আর চলতে দেওয়া যায় না। জানমালের নিরাপত্তা বিবেচনায় আমাদের এ ব্যাপারে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে।

দেশে রাস্তাসহ আনুষঙ্গিক ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটেছে এবং যাত্রীবান্ধব যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। নাগরিক সেবাগুলো দ্রুততার সঙ্গে মানসম্মত ও যথাযথভাবে পরিবেশিত হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে মানুষের জীবন ও চলাচল আরও নিরাপদ করতে হবে। ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে আনতে হবে। ঈদ-প্রস্তুতিকে আরও সুন্দর করার জন্য দক্ষতা প্রদর্শনের এটাই সময়। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সাজাতে হবে। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার যাত্রার কয়েক বছর হয়ে গেল। তাই এ অগ্রযাত্রায় প্রাপ্ত অর্জনগুলোকে আরও মজবুত করার মাধ্যমে স্বস্তিকর ঈদসেবা প্রদানে আমাদের সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।

সালাহ্উদ্দিন নাগরী : কলাম লেখক

snagari2012@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম