ভুটানি স্পেশাল ইকোনমিক জোনের সুবিধা পেতে যা করণীয়
মো. আব্দুল লতিফ বকসী সবুজ
প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কুড়িগ্রামে উন্নয়নের সুবাতাস বয়ে নিয়ে এসেছে ভুটানি স্পেশাল ইকোনমিক জোন। কুড়িগ্রামের অবহেলিত মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হতে যাচ্ছে অনেকদিন পর। সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তনের সুযোগ এসেছে হাতের কাছে, লুফে নিতে হবে কুড়িগ্রামের মানুষকে। মনে রাখতে হবে কোনো কিছুই আপনাআপনি পাওয়া যায় না। এক সময় কুড়িগ্রাম ছিল মঙ্গাপীড়িত। বছরের একটি সময় মানুষ কর্মহীন হয়ে না খেয়ে থাকত। ছোট্ট একটি জেলা দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদ, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমর নদীসহ অনেক শাখা-প্রশাখা নদী মিলে প্রায় ১৬টি নদী প্রবাহিত। প্রতিবছর নদীভাঙনে হাজার হাজার পরিবার ভূমিহীন হয়ে পথে দাঁড়ায়।
কাজের সুযোগ না থাকায় দেখা দিত মঙ্গা। মঙ্গা শব্দটার সঙ্গে কুড়িগ্রামের মানুষ খুবই পরিচিত। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের দারিদ্র্র্যসীমার নিচে বসবাস করা মানুষের সংখ্যা কুড়িগ্রাম জেলায় বেশি। নদীভাঙনে ভিটা-মাটি হারিয়ে কুড়িগ্রাম ছেড়েছেন অনেকেই। অনেকে নদীরক্ষা বাঁধে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরকারের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের ফলে এখন আর মঙ্গা নেই কুড়িগ্রামে। কুড়িগ্রামের মানুষ ত্রাণ চায় না, চায় কাজ। কাজ করে খেতে কুড়িগ্রামের মানুষ পছন্দ করে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে মানুষ খুঁজে পেয়েছে কাজের সন্ধান, কৃষিতে এসেছে বৈচিত্র্য। অনেকেই জেলার বাইরে কাজ খুঁজে নিয়েছেন। তাদের পরিবারগুলো এখন আর না খেয়ে থাকে না। কুড়িগ্রাম অঞ্চলের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, বাবা-মাকে ছেড়ে কেউ বাইরে কোথাও যেতে চাইত না কাজের সন্ধানে। শত কষ্টেও থাকত বাবা-মার সঙ্গে। এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে, দেশের সর্বত্র এখন কুড়িগ্রামের মানুষকে কাজ করতে দেখা যায়। এবার সুযোগ এসেছে হাতের মুঠোয়। ভুটানি স্পেশাল ইকোনমিক জোনের শিল্প কল-কারখানায় বিপুল কাজের সুযোগ আছে, কাজগুলোর বেশির ভাগই টেকনিক্যাল। কাজের ওপর মজুরি নির্ভর করবে। কাজ জানলে মজুরি বেশি, তা না হলে সেই দায়সারা মজুরি। তাই কুড়িগ্রামের মানুষকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হতে হবে, তবেই মিলবে বেশি বেতনের কাজ।
স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য হলো-দেশব্যাপী শিল্প কলকারখানার বিকেন্দ্রীকরণ, দেশের সুষম উন্নয়ন ও বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ইত্যাদি। এতে শিল্প মালিকরা বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন এবং বিনিয়োগ বাড়াবেন। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশে ৭৫ হাজার একর জমিতে ১০০টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তুলে দেশের ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং আরও ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালে লন্ডনে ভুটানের রাজা ও রানির সঙ্গে এক দ্বিপক্ষীয় আলোচনা সভায় কুড়িগ্রামে স্পেশাল ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব দেন। এ বিষয়ে তারা সম্মতি জানালে কুড়িগ্রাম জেলার কুড়িগ্রাম-ভুরুঙ্গামারী সড়কে কুড়িগ্রাম শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরে ধরলা নদীর ব্রিজসংলগ্ন সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের মাধবরাম মৌজায় ভুটানি স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন ইতোমধ্যে ১৩৩ দশমিক ৯২ একর খাসজমি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) হস্তান্তর করেছে। প্রয়োজনে আরও জমি প্রদান করবে সরকার। এলাকার অনেক মানুষ বাপ-দাদার ভিটা-মাটি হারাবেন, তারপরও তারা খুশি, এখানে একটি স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে উঠবে। নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হবে, সে আশায়।
বাংলাদেশ ও ভুটান সরকারের যৌথ উদ্যোগে জি-টু-জি (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) ভিত্তিতে প্রস্তাবিত ভুটানিজ স্পেশাল ইকোমিক জোন এ অঞ্চলের মানুষকে আশার আলো দেখাচ্ছে। মানুষের মধ্যে ব্যাপক আশার সঞ্চার হয়েছে। এখানে শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠবে, ছেলেমেয়েদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, সধারণ মানুষের আয় বাড়বে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। তবে এ স্পেশাল ইকোনমিক জোনের সুবিধা ঘরে তুলতে হলে আমাদের নিজেদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে, হতে হবে দক্ষ জনশক্তি।
শিক্ষার পাশাপাশি শিল্প কলকারখানায় কাজ করার মতো দক্ষতা অর্জন করতে হবে। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেদের তৈরি করতে হবে দক্ষ জনশক্তিতে। তা না হলে দেশের অন্য অঞ্চলের মানুষ এসে সে সুবিধা লুফে নেবে। আমরা সেই পিছিয়েই থাকব। আমাদের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। এতে করে প্রতিটি জেলার মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির সরকারি পরিকল্পনা সফল হবে না। এজন্য দলমত নির্বিশেষে আমাদের সবাইকেই কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তৈরি করতে হবে দক্ষ জনবল।
কুড়িগ্রামের ভুটানি স্পেশাল ইকোনমিক জোনে কৃষিভিত্তিক শিল্প কলকারখানা, উৎপাদিত কৃষি পণ্য সংরক্ষণ ছাড়াও বেশকিছু ভারী শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠারও পরিকল্পনা রয়েছে। উৎপাদিত পণ্য বাংলাদেশ-ভুটানের চাহিদা পূরণ করে পার্শ্ববর্তী দেশে রপ্তানি করার পরিকল্পনা রয়েছে। ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ সুবিধার কারণেই কুড়িগ্রামে এ স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এতে করে উৎপাদিত পণ্য অতিসহজে কম খরচে সড়কপথে ভুটানে পরিবহণ করা সহজ হবে। শিল্পে নিয়োজিত কর্মী সহজলভ্য হওয়ার কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ কম হবে, সবদিক বিবেচনা করেই এ স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার জন্য কুড়িগ্রামকে বেছে নেওয়া হয়েছে। একটি শিল্প এলাকা গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত জমি, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, আমদানি-রপ্তানির সুবিধা, শিল্প কারখানার জন্য পর্যাপ্ত দক্ষ জনশক্তি, বিদ্যুৎ-গ্যাসসহ সরকারের বিশেষ সুবিধা প্রয়োজন হয়। এছাড়া কুড়িগ্রাম-ভুটান বাণিজ্যিক এ সম্পর্কের পাশাপাশি ভারতের ‘সেভেন সিস্টার’খ্যাত অঞ্চলগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগের অপার সুযোগ সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য এ সেভেন সিস্টারের মানুষের কাছে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পণ্যের মান ও কম মূল্যই এর মূল কারণ। ফলে কুড়িগ্রামের সোনাহাট স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন চালু করা সহজ হবে। এ অঞ্চলের মানুষ এ পথ দিয়ে ভারত এবং সহজে ভুটান যাতায়াত করার সুযোগ পাবে। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী লালমনিরহাট জেলার পরিত্যক্ত বিমানবন্দর ও ভারতের সঙ্গে ব্রিটিশ আমলের রেলপথ আবার চালু করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। শুধু ভুটান নয়, ভারতের সেভেন সিস্টারের জনগণও উপকৃত হবে। এ অঞ্চলের মানুষ উন্নত পণ্য কম দামে প্রত্যাশা করে। সবদিক বিবেচনা করেই ভুটান জি টু জি পদ্ধতিতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য এগিয়ে এসেছে। আমরা কুড়িগ্রামে এ বিনিয়োগকে স্বাগত জানাই।
ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক কুড়িগ্রামে স্পেশাল ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠাসহ তিনটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছেন। রাজা ওয়াংচুক ২৮ মার্চ কুড়িগ্রামে বাংলাদেশ ও ভুটান সরকারের যৌথ উদ্যোগে প্রস্তাবিত ‘ভুটানিজ স্পেশাল ইকোনমিক জোন’-এর জন্য নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করেন। নির্ধারিত স্থান এবং স্থানীয় মানুষের ব্যাপক আগ্রহে তিনি খুবই খুশি। এরপর তিনি কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী উপজেলার সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে সড়কপথে ভারত হয়ে ভুটান ফিরে যান, যে পথে আগামীতে উৎপাদিত পণ্য ভুটানে যাবে। এ প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি দেখার জন্য তিনি আবার কুড়িগ্রাম সফরের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে দেশের পরিকল্পিত সুষম উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ১০০টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। প্রতি জেলায় কমপক্ষে একটি করে স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলা হচ্ছে। এর মধ্যে ৩৭টি পিপিপি অর্থাৎ পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৪৬টি স্পেশাল ইকোনমিক জোনের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে, বেশ কয়েকটি স্পেশাল ইকোনমিক জোনের কাজ সমাপ্তির পথে। সেখানে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানি শিল্পকারখানা স্থাপন করেছে, বিনিয়োগ হচ্ছে বিপুল অর্থ। দেশের মানুষ এর সুফল ভোগ করতে শুরু করেছে।
ইতোমধ্যে বেসরকারি উদ্যোগে নরসিংদীর পলাশে এ কে খান অর্থনৈতিক অঞ্চল, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় আব্দুল মোমেন অর্থনৈতিক অঞ্চল, নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্থনৈতিক অঞ্চল, মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চল, গাজীপুরে বে অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং নারায়ণগঞ্জে আমান অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে।
দেশের অর্থনীতি টেকসই করতে ডাইরেক্ট ফরেন ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) খুবই প্রয়োজন। সরকার দীর্ঘদিন ধরেই এফডিআই বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং বিনিয়োগকারী দেশে ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের আওতায় নির্মিত বাংলাদেশ স্পেশাল ইকোনমিক জোন (জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল) নারায়ণগঞ্জে বিগত ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছেন। এতে আনুমানিক ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করা হবে। ১ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এখানে জাপানের প্রায় ৩০টি এবং অন্যান্য দেশের প্রায় ৪০টি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপের প্রয়োজনে কলকারখানার জন্য বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময়। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী ভারত পণ্যের একটি বড় বাজার। বাংলাদেশের চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদিত পণ্য বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করার সুযোগ রয়েছে। জি টু জি পদ্ধতিতে চাইনিজ এবং ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।
স্পেশাল ইকোনমিক জোনে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন ধরনের বিশেষ সুযোগ-সুবিধার বা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এতে রয়েছে কর অবকাশ সুবিধা, আয়ের ওপর কর মওকুফ, যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধাসহ অনেক কিছু।
মো. আব্দুল লতিফ বকসী সবুজ : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা
latif.bakshi@gmail.com