Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নিরাপদ ঈদযাত্রার প্রত্যাশায়

Icon

ড. মো. রফিকুল ইসলাম

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নিরাপদ ঈদযাত্রার প্রত্যাশায়

ঈদ মানে নাড়ির টানে বাড়িফেরা আর প্রিয়জনদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া। অনেকে নিজ প্রয়োজনেই পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে বসবাস করে আসছে। আর এ ইটপাথরের যান্ত্রিক জীবন ছেড়ে আপনজনের সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটানোর জন্য ঈদে গ্রামের বাড়িতে ছুটে আসে। এ ফেরা যেন শুধু বাড়ি ফেরা নয়, নিজেকেই ফিরে পাওয়া। তবে ঈদ উৎসব যেন বাঙালির এক অন্যরকম আনন্দ, এর ওপর ধর্মীয় কর্তব্য যদি সে উৎসবের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। এ আনন্দ ও আরাধনার ষোলকলা যেন পূর্ণমাত্রা পায়। আমাদের দেশে, বিশেষ করে ঈদের সময় চুরি-ডাকাতির মাত্রা বেড়ে যায়। এ চুরি-ডাকাতি রোধে বাসাবাড়িতে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসাবে প্রতি কক্ষে তালা লাগিয়ে যাওয়াই শ্রেয়। এছাড়া বর্তমানে প্রযুক্তির যুগে যদি প্রতিটি বাসাবাড়িতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা সম্ভব হয়, সেক্ষেত্রে এ প্রযুক্তির সাহায্যে দেশের যে কোনো প্রান্তে থেকে বাসাবাড়ির সবকিছু সহজে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। এর ফলে কোনো ধরনের অসংগতি থাকলে তা চোখে পড়বে। সে অনুযায়ী, তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

উনিশ শতকের শেষদিকে ও বিশ শতকের শুরুর দিকে নবাববাড়ি থেকে তোপধ্বনি করে চাঁদ ওঠার খবর সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাবাসীদের জানিয়ে দেওয়া হতো। উল্লেখ্য, পঞ্চাশের দশকে ঈদ উৎসবের যে আনন্দ ছিল, তেমনি এ আনন্দ তো কমেইনি, বরং পুরোনো প্রথার সঙ্গে আধুনিক অনুষঙ্গ যুক্ত হয়ে ঈদকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, ঈদ উদযাপন উপলক্ষ্যে দেশের সব হাসপাতাল, কারাগার, সরকারি শিশুসদন, প্রবীণনিবাস, ছোটমণি, সামাজিক প্রতিবন্ধী কেন্দ্র, আশ্রয়কেন্দ্র, সেফহোমস, ভবঘুরে কল্যাণকেন্দ্র, দুস্থ কল্যাণ ও মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে উন্নতমানের খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা করা হয়। আর বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাস ও মিশনগুলোতে যথাযথভাবে পবিত্র ঈদ উদযাপন করা হয়। এছাড়া ঈদের দিন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিনা টিকিটে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন সব শিশুপার্কে প্রবেশ ও বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। এটি একটি মহতী উদ্যোগ। বিশেষত, ঈদে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও মমতার শিক্ষার বীজ বপন করে। এতে মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়।

ঈদে শহর ছেড়ে গ্রামে ফেরার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মেলবন্ধন। স্বাধীনতার পর থেকেই নগরের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তাই আজ শিল্পায়নের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠায় প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মূলত কর্মসংস্থানের আশায় মানুষ নগরে আসছে। সংগত কারণে ঈদকে কেন্দ্র করে বিপুলসংখ্যক মানুষ দেশের প্রান্তিক এলাকায় আবার ছড়িয়ে পড়ে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকাশ এমনিতেই শহর আর গ্রামের মধ্যকার দূরত্ব কিছুটা হলেও কমিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের তথা সারা দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তনসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এর সুফলও দেশবাসী পাচ্ছে। অর্থাৎ যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির ফলে যানজট কিছুটা কমছে। এদিকে ঈদের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, ঘরমুখো মানুষের মধ্যে গ্রামের বাড়িফেরা নিয়ে ততই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। এ সুযোগে একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে ধুলা দিয়ে নির্দ্বিধায় টার্মিনালগুলোতে করছে টিকিট বাণিজ্য। এর সঙ্গে টিকিটের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বিড়ম্বনায় ফেলছে যাত্রীদের। এমনিতে জীবনযাত্রার মান নিয়ে অনেকে শঙ্কিত। এর কারণ নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। এর সঙ্গে পরিবার-পরিজনদের জন্য ঈদের পোশাক-পরিচ্ছেদ কিনতে মানুষের হিমশিম অবস্থা। সেই সঙ্গে টিকিট কালোবাজারে বিক্রির কারণে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা পড়েছে। এছাড়া বাড়তি ভাড়া দিয়ে বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও ফেরিসহ নানা ধরনের ছোট ও হালকা যানবাহনের মাধ্যমে বাড়ি ফিরতে হয়। তদ্রূপ অনেকে বাস ও লঞ্চের টিকিট না পেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লোকাল বাস, ট্রাক ও ট্রেনের ছাদেও যায়। এ যেন বাড়ি ফেরার এক লড়াই। মানুষের এই উপচে পড়া ভিড়ের চিত্র গণমাধ্যম প্রচার করে থাকে। দেখা যায় বাস, লঞ্চ ও ট্রেনে ধারণক্ষমতার বাইরেও অতিরিক্ত যাত্রীদের দৃশ্য। অন্যদিকে অদক্ষ চালক দিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে সাধারণত প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। তবুও যাত্রীরা কিন্তু মৃত্যুকে ভয় করছে না। এ সংগ্রাম যেন মানুষের ঈদে গ্রামে ফেরার একমাত্র সংগ্রাম। এর সঙ্গে তীব্র যানজট তো রয়েছেই; যা মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। উল্লেখ্য, ঈদের ছুটির আগে থেকেই একশ্রেণির অসাধু বাস মালিক অধিক মুনাফা লাভের আশায় ফিটনেস বা রোড পারমিটবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় বাসগুলো মেরামত করতে শুরু করছে; যা রাস্তায় চলার অযোগ্য। আর প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ফিটনেসবিহীন বাসগুলো ঈদের সময় রাস্তায় নামবে।

বাংলাদেশের মতো পরিবহণ সেক্টরে এত অব্যবস্থাপনা বিশ্বের আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। বস্তুত দেশের সড়কপথে এক ধরনের নৈরাজ্য চলছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতিবছর ১২ লাখ মানুষ দুর্ঘটনার কারণে মৃত্যুবরণ করে। এক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে এ হার ৪০-৫০ গুণ বেশি। অর্থাৎ ঈদেই সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। ঈদে ঘরমুখো মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে দেশবাসী শঙ্কিত। তবে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নতুন আইন করা হয়েছে। এ আইনে চালকদের জেল ও জরিমানা এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ আইনের প্রয়োগ নিয়েও অনেক বিতর্ক রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সরকার নতুন আইন করলেও প্রচলিত আইনেও শাস্তির বিধান রয়েছে। প্রকৃত বাস্তবতা হলো বাস, ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহনের চালকরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অন্য একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ট্রেন লাইনচ্যুতির কারণে ৮৩ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে। এর কারণ মূলত রেলপথের মান নষ্ট হওয়া ও লাইনে পর্যাপ্ত পাথর না থাকা।

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুসহ কেউ কেউ চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। তবুও সড়কপথে মৃত্যু থামানো যাচ্ছে না। শুধু চালকের বেপরোয়া গতিই দুর্ঘটনার একমাত্র কারণ নয়। অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্রটিপূর্ণ যানবাহন, ভুয়া লাইসেন্স ও অতিরিক্ত পণ্যসামগ্রী বা যাত্রী পরিবহণ এবং চালকের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অসচেতনতার অভাব ও চলন্তবাস-ট্রাকে মোবাইল ফোন ব্যবহার। আসন্ন ঈদে ঘরেফেরা মানুষের জীবনের নিরাপত্তার জন্য সরকারকে অবশ্যই সড়ক ও মহাসড়কের ক্রটিপূর্ণ অদক্ষ চালকদের গতিবেগের ওপর নজরদারি বৃদ্ধি করা বিশেষ প্রয়োজন। চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই স্বচ্ছতা আনার পাশাপাশি তাদের আরও দায়িত্বশীল ও সচেতন হতে হবে। তবে আইনের সঠিক প্রয়োগই দুর্ঘটনা অনেকটা রোধ করতে পারে। মানুষ যাতে বাড়িতে নির্বিঘ্নে যেতে পারে, সেই সঙ্গে জনগণের জানমাল ও জীবনের নিশ্চয়তাও সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। এর মধ্যে পরিবারের প্রধানদেরও কিছুটা দায়িত্ব থেকে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে নৌ ও সড়কপথে ডাকাতি ও চাঁদাবাজির ঘটনায় ঈদে ঘরমুখী মানুষ আতঙ্কিত থাকে। তাই ঈদে সাধারণ মানুষ যেন নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারে, সে কথা চিন্তা করে নিয়মমাফিক অতিরিক্ত পরিবহণ সেবা চালু করা জরুরি। এর পাশাপাশি নিরাপদ সড়কের জন্য নিয়মিত রাস্তাঘাট মেরামতসহ গতিবিধি মেনে গাড়ি চালানোর ব্যবস্থা করতে পারলে অনেকাংশেই দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। তবে গতিবিধি না মেনে গাড়ি চালালে তার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সত্যিকার অর্থে যে কোনো স্তরের হোক না কেন, দায়িত্বের কাছে দায়বদ্ধতা নেই বলে এত দুর্ঘটনা। তবে সব ক্ষেত্রে দায়িত্বে গাফিলতির ভাব থেকেই যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারের একার পক্ষে সবকিছু মোকাবিলা করা সম্ভব নয়; তাই নিজ নিজ দায়িত্ববোধ থেকে আমাদের এসব দুর্ঘটনা রোধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য আমাদের স্বভাব ও মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে।

মহাসড়কে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে পর্যাপ্ত রেকার রাখা যেতে পারে। বিশেষত পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতু ও অন্যান্য সেতুর ওপর গাড়ি নষ্ট হলে তা দ্রুত অপসারণ করতে হবে। এছাড়া সড়ক ও মহাসড়কের তীব্র যানজটপ্রবণ এলাকাগুলোয় কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। আর রাস্তায় পুলিশের টহল বাড়াতে হবে। এতে যানজট তুলনামূলক কমে আসবে আর স্বস্তির সঙ্গে ও নিরাপদে ঘরমুখী মানুষ স্বজনদের কাছে যেতে পারবে। অন্যদিকে বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ঠেকাতে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, ঈদযাত্রায় যাত্রী হয়রানি, ভাড়া নৈরাজ্য ও অসহনীয় যানজট কমানোর পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের জনগণ যানজট ও দুর্ঘটনামুক্ত নিরাপদ সড়ক চায়। এতে দেশবাসী উপকৃত হবে বলে সুশীল সমাজ মনে করে।

ড. মো. রফিকুল ইসলাম : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম